পিওতর মান্তেইফেল
নবজাতকের জীবন
পুকুরটা বরাবরকার মতোই। চিড়িয়াখানায় অশ্রান্ত কাকলী।
কিশোর একজন জীববিদের সঙ্গে যাচ্ছিলাম তাঁর দিয়ে। হঠাৎ চোখে পড়ল ‘একজন ডুবছে’। পড়ে ছিল সে তীরের কাছেই, রোদ্দুরের কাঁপা কাঁপা ছোপ পড়ছিল তার গায়ে। ‘ডুবন্তটি’ হল চোখ-না-ফোটা ছোট্ট একটা বিড়াল-ছানা। সবুজ শ্যাওলায় তার গা জড়ানো, যেন ছাতা পড়েছে।
আমার সহযাত্রী ওটিকে টেনে তুলল। নিথর প্রাণীটা থেকে জীবনের কোনো লক্ষণই মিলল না। মনে হল বাচ্চাটা অনেক আগেই ডুবে মরেছে।
আমরা যখন ওকে খুঁটিয়ে দেখছিলাম, তখন ডুবন্তের নাক থেকে জল ঝরতে লাগল, আমাদের হাতের গরমে শরীরটা তার গরম হয়ে উঠল খানিকটা, হঠাৎ সামান্য কে’পে উঠল বেড়াল-ছানা।
ধীরে ধীরে জীবন ফিরে পেল সে।
বে’চে-ওঠা বাচ্চাটাকে মানুষ করার জন্যে দেওয়া হল চিড়িয়াখানার যে বিড়ালীর কাছে, কয়েকটা কালো মেঠো বেড়াল-ছানাকে পালছিল সে। তার যত্নে পোষ্যটি দ্রুত শক্ত-সমর্থ হয়ে ওঠে, তারপর বড়ো হয়ে ঠাঁই নেয় আমাদের একজন বৈজ্ঞানিক কর্মীর বাড়িতে।
এত সহজে ছানাটা প্রাণ ফিরে পেল কেন? সে তো ছিল পুকুরের জলের মতোই ঠান্ডা।
আসলে, ভ্রূণাবস্থায় সমস্ত প্রাণীই তাদের সুদূর পূর্বপুরুষদের বিবর্তনের (ঐতিহাসিক বিকাশের) বিভিন্ন স্তরের পুনরাবর্তন করে একটা নির্দিষ্ট মাত্রায়।
জন্মের ঠিক পরে পরে, বাচ্চাদের সঙ্গে বয়স্ক জরদের জেয়ার থাকে অনেক ব্যাপারেই, অনেক নিচু স্তরে বিকশিত তাদের অতীত পূর্বপুরুষদের কিছু কিছু লক্ষণ তাতে ফুটে ওঠে। যেমন, অধিকাংশ স্তন্যপায়ী জীবের সাধারণ দেহতাপ হল ৩৭-৩৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মতো। কিন্তু বাইরে থেকে তাপ না পেলে (যেমন, মা-বাপের গা ঘে’ষে গরম না হলে) এসব জীবের বাচ্চা, বিশেষ করে চোখ যাদের সঙ্গে সঙ্গে না ফোটে, তারা তাড়াতাড়ি ঠান্ডা হতে থাকে। মৃত্যু না ঘটিয়ে একটা বয়স্ক কুকুরের তাপমাত্রা ২৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে নামানো প্রায় অসম্ভব; সদ্যোজাত কুকুর-ছানার তাপমাত্রা কিন্তু ১০ ডিগ্রির নিচেও নামানো গেছে। তখন তারা একেবারেই নিশ্চল হয়ে যায়, কিন্তু খানিকটা গরম করলেই ফের সজীব হয়ে ওঠে। আমরা এমন অনেক ঘটনাই জানি, যখন বন্য পশুর পুরো একপাল বাচ্চা এমন ঠান্ডা হয়েছে যে মনে হবে মরা। কিন্তু একটু গরম হতেই তারা ‘বে’চে উঠেছে’ এবং পরে বেড়ে উঠেছে স্বাভাবিকভাবেই। একবার রাতে খুব ঠান্ডা পড়ায় চিড়িয়াখানায় ইউরোপীয় জাতের মিল্ক ফার- পশুর দুটো বাচ্চা জমে যায়, চুল্লিতে গরম করায় তারা ‘বে’চে ওঠে’।
বাচ্চাদুটো মারা যায় নি বটে, তবে প্রাণশক্তি তাদের এত ক্ষীণ ছিল যে চোখে দেখে বা হাতে ছ’য়ে তা আমরা টের পাই নি। শূন্যের খানিকটা নিচু তাপমাত্রায় জমে যাওয়া খরগোস-ছানাদের গরম কামরাতে আনার পর তারা শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলে, হয়ে মাই খেতে শুরু করেছে।
চাঙ্গা পাখিদের বেলায় এটা আরো খাটে, স্তন্যপায়ীদের মতো এদেরও সুদূর পূর্বপুরুষ ছিল প্রাচীন সরীসৃপ, বাঁধা দেহতাপ তাদের ছিল না। বয়স্ক পাখিদের কায়েমী দেহতাপ অবশ্য উঁচু: ছোটো ছোটো পাখিদের বেলায় তা ৪৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত ওঠে। তবে অন্য অনেক লক্ষণে পাখিরা সরীসৃপের সমতুল্য। সাদৃশ্যটা দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রেই: সরীসৃপদের মতোই পাখিদেরও ঘাম আর চর্বি নিষ্কাশনের ম্যান্ড নেই (শুধু লেজের গোড়ায় ককসিক্সের গ্ল্যান্ডটা বাদ দিলে); সরীসৃপদের মতো পাখিদের নিষ্ঠীবনেও থাকে ইউরিক অ্যাসিড; ল্যান্ডরেল বা উটপাখির মতো কিছু কিছু পাখির বেলায় এখনো পর্যন্ত ডানার ডগায় সরীসৃপ-নখর থেকে গেছে, সমস্ত পাখির পায়েই আছে শৃঙ্গজাতীয় আঁশ। যেসব পাখির ছানা চোখ না ফুটে আর বিনা পালকে গজায়, সরীসৃপের সঙ্গে তাদের মিল খুব বেশি: চট করেই তাদের দেহতাপ ঠান্ডা হতে থাকে। গরম হবার জায়গা না থাকলে তাদের প্রাণ-লক্ষণ চোখে পড়ে কম। বাইরে থেকে তাপ পেলে এরা শুধু বে’চেই ওঠে না, প্রাণশক্তি বাড়ে আগের চেয়ে অনেক। এককালে অতীতের কিশোর জীববিদ, বর্তমানে বৈজ্ঞানিক গবেষক ন. কালাবুখভ, আ. ব্রিউমিন একবার চড়ুই-ছানাদের ঠান্ডা করেন ৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে।
সে অবস্থায় মনে হল ছানাগুলো যেন জমে কাঠ হয়ে গেছে; কিন্তু গরম করার পর তারা সজীব হয়ে ওঠে, ঠোঁট ফাঁক করে খেতে চায়।
একাধিকবার আমি দেখেছি, বাচ্চাদের গা গরম রাখে যারা, সেই মা-বাপকে বাসা থেকে তাড়িয়ে দিলে খারাপ আবহাওয়ায় কত দ্রুত ঠাণ্ডা হয়ে যায় সদ্য ফোটা ছানারা। ছানাদের তখন রোঁয়া না থাকলেও এই সাময়িক শীতলতায় ক্ষতি হয় নি তাদের। পরে একেবারে স্বাভাবিকভাবেই তারা বেড়ে উঠেছে।
মুরগী, হাঁসজাতীয় যেসব পাখির ছানা জন্মের কিছু পরেই স্বাধীনভাবে ছোটাছুটি শুরু করে, তাদের বেলাতেও এই ঘটে। এ সময় তাদের কাছে চুল্লির কাজ করে মা, গিয়ে গরম হয়ে নেওয়া যায়।
নিশ্চয়ই সবাই দেখেছে, আঙিনায় চরে বেড়াবার সময় মুরগী মাটিতে বসে পড়ে তার ছানাগুলোকে জুটোয় পাখার তলে। নিজের গায়ের সঙ্গে ঠেসে ধরে গরম করে তোলে ওদের।
তাই, মুরগী-ছানাদের গায়ের তাপ বেশ ঘন ঘনই বদলায়। মায়ের কাছ-ছাড়া হয়ে ছোটার সময় এই ঠান্ডায় কাঁপছে, এই আবার মায়ের পাখার তলে গিয়ে গরম হচ্ছে। আমরা লক্ষ্য করেছি যে তাপমাত্রার এই লাফালাফিতে শক্ত হয় মুরগী-ছানা, ত্বরান্বিত হয় তার বাড়। সরীসৃপদের বেলাতেও এ ব্যাপারটা দেখা যায়, আর তাপমাত্রার দোলনের দিক থেকে বয়স্ক মুরগীর চেয়ে সরীসৃপের সঙ্গেই মুরগী-ছানার বেশি মিল। দিনের বেলায় রোদে গরম হয়ে উঠে রাতে ভয়ানক ঠান্ডা হয়ে যায় সরীসৃপ। সমান মাত্রার একই রকম উচু তাপমাত্রায় তাদের শরীর খারাপ লাগে। তাই চিড়িয়াখানায় যে বাক্সে সাপ, গিরগিটি আর কাছিম থাকে, সেখানে তারা গিয়ে জোটে বিজলী বাতির তলে, তারপর দেহ ৩৬-৩৭ ডিগ্রি গরম হলে তারা খুব প্রাণচঞ্চল হয়ে ওঠে এবং সরে যায় ছায়ায়। বাতাসের তাপমাত্রা বরাবর উচু থাকলে এরা বন্দিদশা তেমন সইতে পারে না।
গৃহপালিত পাখির এইসব বৈশিষ্ট্যের কথা জানা থাকলে তা ব্যাবহারিক কাজেও ফল দেয়।
কিছুকাল আগেও পোলট্রি খামারগুলোয় ছানাদের রাখা হত বরাবরই উচু তাপমাত্রায়, মাত্র কয়েক ডিগ্রি তাপ নামাতেও ভয় পেত লোকে। এখনো সকলের সে ভয় কাটে নি, আর তা থেকে বেড়ে উঠত দুর্বল অপুষ্ট ছানা।
কোনো একটা প্রাণীর স্বাভাবিক বিকাশের ব্যবস্থা করতে হলে পরিবেশের কাছে তার দেহযন্ত্রের কী দাবি ঐতিহাসিকভাবে গড়ে উঠেছে, সেটা হিশেবে রাখা দরকার বেশি।
Leave a Reply