মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন।
মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে।
তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু।
তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক
মাহমুদুল হক
রাজীব ভাই খোকার পিঠে একটা হাত রেখে বললে, ‘শক্ত হবার চেষ্টা করো। এভাবে মুষড়ে প’ড়ে কোনো লাভ নেই। আমি বেরিয়ে
দেখছি এখনো কোনো উপায় আছে কি না।’
মুখের কথা প্রায় মুখেই থেকে যায়, চতুর্দিকে মুহুর্মুহু প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ ফেটে পড়তে থাকে। প্রাণভয়ে ভীত রাস্তার মানুষজন আত্মরক্ষার জন্যে যে যেদিকে পারছে ঘুটঘুটে অন্ধকারে এলোপাতাড়ি দুদ্দাড় ক’রে ছুটে পালাচ্ছে।
ছুটতে ছুটতে কে একজন চিৎকার ক’রে বললে, ‘সাবধান ভাইসব! আপনারা আত্মরক্ষার জন্য প্রস্তুত থাকুন! সৈন্যরা পাগল হয়ে গেছে!
কুত্তার বাচ্চারা গরু-ছাগলের মতো মানুষ মারছে এখন।’
খুব কাছাকাছি হড়াম করে একটা মর্টারের শেল এসে পড়লো। বিস্ফোরণের প্রচণ্ড শব্দে গোটা বাড়ি থরথর ক’রে কেঁপে ওঠে। বৃষ্টির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটে আসছে। ধরাশায়ী মানুষজনের চিৎকার- আর্তনাদে দ্রুত নারকীয় পরিস্থিতি নেমে আসে চতুর্দিকে। জানালার পাল্লা ভেদ ক’রে উপর্যুপরি কয়েকটি বুলেট দেয়ালে এসে পড়ায় ঝুরঝুরিয়ে পলেস্তারা খ’সে পড়ে। এক অলিখিত নিয়মে হামাগুড়ি দিয়ে সকলেই খাটের তলায় আশ্রয় নিলো। হাত-পা পড়ে গিয়েছে খোকার। চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছে। তার মাথার খুলির ফোকরে ভয়ঙ্কর এক শূন্যতায় লেলিহান অগ্নিশিখার মতো করাল মৃত্যু লকলকে জিভ বের ক’রে অবিরাম ভয়াবহ অট্টহাসিতে ফেটে পড়তে থাকে।
তারপর দু’টি রাত, মাঝখানে একটি দিন।
খোকা জানে না কিভাবে সময় কেটেছে। কোনো হিশেব নেই তার কাছে। কেবল এইটুকু মনে আছে, অনৈসর্গিক আচ্ছন্নতার ভিতর জুবড়ে থেকেও সে অনুমান করতে পারছিলো কি পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের বিভীষিকা চলেছে শহরময়। জানালার ফাঁকে চোখ রাখলেই দেখা যায় চতুর্দিকে ছত্রাখান মৃতদেহ, ছিন্নভিন্ন, ঝাঁঝরা; শহর জুড়ে দাউ দাউ ক’রে জ্বলছে আগুন, তপ্ত বাতাসের হলকায় দগ্ধ মাংস আর বারুদের কটু গন্ধ।
ইতস্তত বিক্ষিপ্ত গুলির আঘাতে মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছিলো দেয়াল। জানালার সামনে একটা খাট খাড়া করতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়লো রাজীব ভাই, গুলি লাগলো মুখে।
ঠিক কখন রাজীব ভাইয়ের মৃত্যু হয়, খোকার তা জানা নেই। অন্ধকার প্রেতপুরীতে তিনটি জড়বৎ প্রাণী রুদ্ধশ্বাসে কেবল প্রহর গুনেছে। সবকিছু আয়ত্তে এলেই ঘরে ঘরে ঢুকে নির্মম হত্যাকাণ্ড চালাবে উন্মুক্ত সৈন্যদল, একটি প্রাণীও বাঁচবে না, এই এখনও যেমন কুকুর-বিড়াল সামনে যা পড়ছে তোপের মুখে উড়িয়ে দিচ্ছে এক ধারসে,–থেকে থেকে এইসব ভেবে শিউরে উঠছিলো খোকা।
সকালের আলোয় রাজীব ভাইয়ের মুখ দেখে তার রক্ত হিম হ’য়ে গিয়েছিলো, মনে হয়েছিলো নিষ্ঠুর ব্যঙ্গ, বিকৃত তিরস্কার। গুলিতে রাজীব ভাইয়ের মুখের একপাশের চোয়াল উড়ে গিয়েছিলো।
সন্ধ্যার আগেই শুরু হয়েছিলো মুখের দিকে পচানি ধরার। অনির্দিষ্ট- কালের জন্যে কারফিউ, কোনো প্রশ্নই ওঠেনি সৎকারের। প্রতি মুহূর্তেই গোলাগুলির তুমুল শব্দ, মাঝে মাঝে দূরে কোথাও ঘটছে উচ্চণ্ড বিস্ফোরণ; ব’সে ব’সে নিজের মাথার চুল ছেঁড়া ছাড়া কারো কিছুই করণীয় ছিলো না।
এই প্রথম জীবনের চেয়েও বড় ব’লে মনে হয়েছিলো এক একটি রাত্রিকে: বিস্ফোরণের শব্দ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করেছিলো প্রতিটি পল অনুপলকে। জীবনের অর্থ তখন একটাই,-প্রাণের ভার; নারকীয়তার এমন রুদ্রমূর্তি আর কখনো দেখেনি খোকা।
Leave a Reply