শশাঙ্ক মণ্ডল
দ্বিতীয় অধ্যায়
সুন্দরবনের মানুষের জীবনে নদী অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত; এককথায় বলা যেতে পারে নদীই তার জীবন- চাইল্ড অফ দ্য রিভার। নদী তার বৈষয়িক সাংস্কৃতিক জীবনকে জড়িয়ে ধরে আছে-সৌভাগ্য দুর্ভাগ্যের নিত্য সাক্ষী। সুন্দরবনের এই বিশাল এলাকায় যোগাযোগের ক্ষেত্রে নদীর ভূমিকাই প্রধান। নদীতীরবর্তী বাঁধ হল তার সড়কপথ; এই পথ দিয়েই এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াত করতে হয়। স্বাধীনতা পূর্ববর্তীকালে পাকা সড়ক দু-একটি তৈরি হয়েছিল প্রশাসনিক কাজের সুবিধার জন্য তবু তার পরিমাণ খুবই কম। বাখরগঞ্জ জেলায় রাস্তা ছিল না বলাই চলে। বিংশ শতাব্দীর শুরুতেও সুন্দরবন এলাকায় কোন উল্লেখযোগ্য সড়ক গড়ে ওঠেনি। কিন্তু প্রাচীনকাল থেকে নৌপরিবহণের সুবিধা এলাকার মানুষ পেয়েছে এবং প্রাকৃতিক কারণে তাকে এই পরিবহণ- ব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে চলতে হয়েছে।
সে যুগে নানা ধরনের নৌকার প্রচলন ছিল। গ্রামীণ কুটিরশিল্প হিসাবে সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় নৌকা তৈরির মিস্ত্রিরা বনের কাঠ দিয়ে নৌকা তৈরি করত। সুন্দরবনে অনেক গঞ্জ ছিল সে যুগে যেখানে নানা মাপের নৌকা বিক্রয়ের জন্য মজুদ থাকত। ব্যাপারীরা দূর-দুরান্ত থেকে নৌকা কিনে নিয়ে এসে লাভের উদ্দেশ্যে আবার বিক্রয়ের ব্যবস্থা করত। নানা ধরনের নৌকার প্রচলন ছিল, মানও ছিল বিভিন্ন। কোন নৌকা যাত্রী বহনে নিয়োজিত হত আবার কোন নৌকা মাল পরিবহণে লাগান হত। এসব নৌকার ছিল ভিন্ন ভিন্ন নাম।
বালাম, গোধা, সুপ, সম্পান, কোঁদা, গুরাব বজরা, মাসুয়া পাতিলা জালিয়া, জেলে, ময়ূরপঙ্খী, বাওলিয়া, ডিঙ্গি প্রভৃতি নানা ধরনের নৌকার প্রচলন ছিল। প্রতিটি গ্রামবাসী তার নিজস্ব প্রয়োজনে ছোট নৌকা-ডিঙ্গি নৌকা রাখতে বাধ্য হত আর গরিব মানুষরা তাদের দৈনন্দিন প্রায়োজনে যোগাযোগ, হাট বাজার, প্রভৃতি কাজে এক ধরনের ছোট ডোঙা ব্যবহার করত। একজন মানুষ অল্প জিনিসপত্র নিয়ে ডোঙায় উঠে এক জায়গা থেকে অন্য যায়গায় যেতে পারত। সাধারণত খালে বিলে ডোঙা চলত। দুরন্ত স্রোতে ডোঙা ব্যবহার করা যায় না, তাল গাছের গোড়ার অংশ দিয়ে এই ডোঙা তৈরি হত। সুপারি গাছ থেকে নৌকা তৈরি করা হত বরিশাল খুলনার সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায়।
এসব নৌকা ৮/১০ হাতের ওপর করা যেত না। আর চওড়া হত ২.৫০/৩ হাত। সুপারি গাছ থেকে চটা তৈরি করে পেরেক দিয়ে কাঠের সাথে জোড়া হত। জল বন্ধ করার জন্য ধানের কুড়ো গাঁবের আঠা মিশিয়ে নৌকার গায়ে প্রলেপ লাগান হত। এ-সব নৌকা বেশ কয়েক বছর কাজে লাগত। সস্তায় নৌকা তৈরি করে গৃহস্থরা তাদের প্রয়োজন মেটাত। সুন্দরবনের বিভিন্ন হাটে সে যুগে বিভিন্ন ধরনের নৌকা বিক্রয়ের জন্য আসত। বড়দল, নবেকী, ঝালকাটী বরিশাল, মগরাহাট, নামখানা, ডায়মন্ডহারবার, হিঙ্গ লগঞ্জ, হাসনাবাদ প্রভৃতি গঞ্জে নৌকা তৈরি হত বিক্রয়ের জন্য। বরিশাল জেলার বাউফল থানার কালি শুড়ির মেলায় নৌকা বিক্রয়ের জন্য পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে কারিগররা নৌকা নিয়ে আসত।
Leave a Reply