ড. সুবীর বন্দ্যোপাধ্যায়
লাতিন আমেরিকা মহাদেশ-এর নানা ধরনের বৈশিষ্ট্য আছে। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক টানাপোড়েন, দ্বন্দ্ব, উত্থান-পতনের ইতিহাস নিয়ে স্বতন্ত্র চরিত্র এই লাতিন আমেরিকার। বিভিন্ন দেশ, ছোট ছোট এলাকার নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ধর্ম, রীতি-নীতি। কোনো কোনো সময় একটা দেশ যেখানে ছিল এবং যে গঠনবিন্যাসে ছিল তার পরিবর্তন ঘটেছে।
এই পরিবর্তন ঘটার মূলে ছিল প্রধানত রাজনৈতিক এবং দখলদারি একনায়কত্ব। ছোট মহাদেশ হলেও বিভিন্ন দেশ অন্য দেশের সঙ্গে ঝগড়া- বিবাদ এমনকি যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। চিলি, ভেনেজুয়েলা, গুয়াতেমালা, বলিভিয়া ইত্যাদি দেশের মধ্যে সীমানা-বিরোধ ছিল অনেক বছর। এর ফলে এক দেশের কিছু অঞ্চল অন্য অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেশের একটা সীমানা অঞ্চল বদল হয়েছে। এই অঞ্চল বদল, অঞ্চল অন্তর্ভূক্তি এবং সামগ্রিকভাবে ভৌগোলিক চিত্রপটের পরিবর্তন সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করেছিল। মোদ্দাকথা হিসেবে বলা যায় লাতিন আমেরিকার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস নানা ঘটনাবলীর টানাপোড়েনে তৈরি। কখনো একনায়ক, আবার কখনো গণতান্ত্রিক শাসন আবার সেই শাসনকে হটিয়ে নতুন একনায়ক। এবং এই ঘটনার মধ্যে সাধারণ মানুষের দুরবস্থা, দারিদ্র্য সংগ্রাম যুক্ত হয়ে অন্য এক মাত্রা গড়ে উঠেছে।
উদাহরণ হিসেবে চিলির কথা বলা যায়। চিলির প্রথম দিক হল ১৫৪১-এর পেদ্রো দে ভালদিয়ার আঞ্চলিক সরকার। এরপর নানা বাধাবিপত্তির চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৮১০-এ স্বাধীনতা লাভ। কিন্তু তারপরেও ছিল ব্যাপক সাধারণ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা, বেঁচে থাকার জন্য নানা দাবিসহ সংগ্রাম। ১৯৪৯ সালে কমিউনিস্ট শাসক রাষ্ট্রপতি এ্যালেন্দের আগমন এই শাসন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সহ কিছু বিষয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ আনতে পেরেছিল। কিন্তু ২৪ বছর পর ১৯৭৩ সালে ঘটল কুদেতা। আলেন্দে হত্যার মধ্য দিয়ে সরকারের পতন ঘটেছিল।
এরপর ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত চালু ছিল অগস্তো পিনোচেতের একনায়কতন্ত্র। এবং এরপর আবার প্রগতিশীল সরকার। এই ঘনঘন পালাবদল চিলি ছাড়া লাতিন আমেরিকার অন্য ছোট ছোট ভূখণ্ডের ক্ষেত্রেও ঘটেছিল। লাতিন আমেরিকার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক নানা চিত্রনাট্যের নানা কাহিনীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে তিনটি সভ্যতা। বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চল মোটামুটিভাবে ক্রমপর্যায়ে মায়া, ইনকা, আজতেকসভ্যতা ছড়িয়ে ছিল।
এক সভ্যতার মধ্যে ছিল কয়েকটি ভৌগোলিক অঞ্চল। আবার অন্য কয়েকটি দেশে প্রসারিত হয়েছিল অন্য একটি সভ্যতা। এইভাবে এক সভ্যতা আরেক সভ্যতাকে প্রভাবিত করেছিল। সেইদিক থেকে বলা যায় কোনো কোনো সময় মায়া ও ইনকা সমসাময়িক হয়ে গিয়েছিল। এই ধারাবাহিকতা এবং সমসাময়িক এবং পারস্পরিক অবস্থান সামগ্রিকভাবে লাতিন আমেরিকার সামাজিক ইতিহাসকে ব্যঞ্জনাময় করে তুলেছে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়।
আলোচ্য গ্রন্থে মায়া, ইনকা, আজতেক-এর সমাজ, সভ্যতা, নরতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপট, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন, ধর্মীয় ঐতিহ্য, লোকবিশ্বাস-এর উপর একটি নৈর্বক্তিক বীক্ষা করার চেষ্টা করা হয়েছে। কোথায়, কীভাবে এবং কখন কার্যকরণের সমন্বয়ে তিন সভ্যতা তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমাদের কাছে ধরা দিয়েছে সে বিষয়টির বিশ্লেষণ করার প্রচেষ্টা করা হয়েছে। প্রথমে আমরা সারস্বত অভিযান শুরু করব মায়া সভ্যতাকে নিয়ে।
(চলবে)
Leave a Reply