( রাখাইনের অভ্যন্তর থেকে দেয়া সাক্ষাৎকার অবলম্বনে সারাক্ষণ ডেস্ক)
আরাকান আর্মি গত বছরের নভেম্বর মাসে মিয়ানমারের পশ্চিম অঞ্চলে জান্তার বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করার পর থেকে রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলের বেশ কিছু শহর দখল করে নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে রাজধানী সিটওয়ে সীমান্তবর্তী পন্যাগুন এবং রাঠেডং, যা রাখাইনে জান্তা প্রশাসনের মূল কেন্দ্র।
আরকান আর্মি সমুদ্র উপকূল ধরে দক্ষিণে এগিয়ে সিটওয়ে নিকটবর্তী বুথিদং এবং মংডো জেলাগুলো দখল নেওয়ার জন্য এগিয়ে চলেছে যা মূলত তাদেরকে পুরো রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নেবার সাফল্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
নভেম্বরে আক্রমণ শুরু করার আগেও রাখাইন জাতিগত এই সশস্ত্র গ্রুপটি রাখাইনের বেশিরভাগ গ্রামীণ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করত।
যুদ্ধ চলাকালীন, উত্তর রাখাইনের বেশিরভাগ বাসিন্দা গ্রামগুলোতে আশ্রয় নিচ্ছে, যেখানে তারা গুরুতর খাদ্য সংকট এবং অন্যান্য কষ্টের মুখোমুখি হচ্ছে। মিয়ানমারের একটি নির্বাসিত সংবাদসংস্থা সম্প্রতি উত্তর রাখাইনে বাস্তুচ্যুত মানুষের দুর্ভোগ এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতি সম্পর্কে একজন বাসিন্দার সাক্ষাৎকার নিয়েছে।
রাখাইন জুড়ে বর্তমান পরিস্থিতি কি?
রাঠেডংয়ে (সিটওয়ের উত্তরে) যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ। কয়েক দিন আগে একটি ভারী বোমা হামলা হয়েছিল। জানুয়ারি থেকে রাঠেডং জনশূন্য হয়ে পড়েছে। আরকান আর্মি এখনো এলাকাটি পরিষ্কার করছে ( তারা মূলত গত রবিবার শহরটি দখল নিয়েছে)।
পন্যাগুনে (সিটওয়ের উত্তর-পূর্বে 30 কিমি) আরাকান আর্মির দখলের পর থেকে বন্দুকের গুলি থেমে গেছে। সেখানে শুধু কয়েকটি বোমা হামলা হয়েছে, তাই বলা যায় শহরটি আরকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। তবে পন্যাগুন শহর এবং আশপাশের গ্রামের বাসিন্দারা এখনো বাড়ি ফিরতে পারছে না। নিরাপত্তার জন্যে আরকান আর্মি মাইন পরিষ্কার করছে আর এ কারণে স্থানীয়দের কয়েক দিন পরে এলাকায় ফেরার জন্যে বলছে।
রামরিও শহরও আরকান আর্মির দখলে চলে গেছে এবং ভূমি মাইনের ঝুঁকির কারণে শহরের বাসিন্দাদের দূরে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
১৭ মার্চ সামরিক সরকার আবার আরেকটি শহর মরাউক-উতে বোমা হামলা চালিয়েছে। শহরটি ধ্বংস হয়ে গেছে। বাসিন্দারা যুদ্ধ থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় তাদের জিনিসপত্র নিতে পারেনি। আরকান আর্মি চুরি প্রতিরোধের জন্য বাসিন্দাদের শহরে প্রবেশ করতে নিষেধ করেছে।
সিটওয়েতে পরিস্থিতি কেমন?
উত্তর রাখাইনে আরাকান আর্মির অভিযানের অগ্রগতির সাথে সাথে সরকারি কর্মচারী এবং সাধারণ মানুষ শহর ছেড়ে পালিয়েছে।
শহরে খুব বেশি লোক অবশিষ্ট নেই।
মিয়ানমানের সামরিক সরকারের বাহিনী’র গোলাবর্ষণে সিটওয়ের শহরাঞ্চলের ওয়ার্ডগুলোতে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে, একইসময়ে মিয়ানমার নৌবাহিনী নৌকায়োগে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা লোকদের উপর গুলি চালিয়েছে।
শহরে শুধুমাত্র মুসলমান [রোহিঙ্গা] জনগোষ্ঠী রয়ে গেছে। তাদের পালানোর কোন জায়গা নেই। নাগরিকত্বের আইডি নেই। সুতরাং, সামিরক সরকার তাদের শোষণ করছে। সিটওয়ে, বুথিদং, মংডো এবং কিয়াউকফ্যুর মুসলমানদের সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে বাধ্য করা হয়েছে।
আরকান আমি কিভাবে দখলকৃত শহরগুলোতে প্রশাসন পরিচালনা করছে?
১৩ নভেম্বর সর্বশেষ সংঘর্ষ শুরুর আগেই আরকান আর্মি এবং এর রাজনৈতিক শাখা, ইউনাইটেড লীগ অফ আরাকান, বিচার ব্যবস্থাসহ তাদের প্রশাসন পরিচালনা করছিল। এগুলো স্বাভাবিকভাবেই চলছে। তবে, আরকান আর্মিকে এখন সামরিক বিষয়ে মনোনিবেশ করতে হচ্ছে, এবং রাখাইনের স্থানীয় মানুষ তাদের বাড়ি থেকে উদ্বাস্তু হয়েছে।
যুদ্ধের ফলে রাখাইনের অর্থনীতির অবস্থা কি, স্থানীয়রা কীভাবে জীবিকা নির্বাহ করছে?
নভেম্বরে যুদ্ধ শুরুর আগে কিছু কৃষক তাদের ধান ক্ষেত এবং ফসল কাটতে সক্ষম হয়েছিল। তবে, সামরিক সরকারের অবস্থানের কাছাকাছি গ্রামের কৃষকরা ফসল ঘরে তুলতে পারেনি। এবং যুদ্ধের কারণে পরিবহন ব্যবস্থা গুরুতরভাবে ব্যাহত হওয়ায় কৃষকরা ফসল বাজারে পাঠাতে পারেনি, এবং ক্রেতাও নেই। বুথিদং এবং মংডোর মাধ্যমে সীমান্ত বাণিজ্য মাসের পর মাস বন্ধ রয়েছে। রাঠেডং, বুথিদং এবং মংডোতে লড়াই চলার কারণে বাণিজ্য পরিচালনা করা যাচ্ছে না। এবং লোকজনকে সীমান্ত পার হতে দেওয়া হচ্ছে না।
অন্যদিকে সামরিক সরকার রাখাইন এবং দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মধ্যে সড়ক ও জলপথও অবরোধ করে রেখেছে।
মানুষ কীভাবে নিজেদের খাবারের ব্যবস্থা করছে?
নভেম্বরে যুদ্ধ শুরু হওয়ার চার মাস পেরিয়ে গেছে। খাদ্য মূল্যবৃদ্ধির কারণে পরিস্থিতি কঠিন হয়ে উঠেছে। মানুষের নিয়মিত আয় না থাকায় এবং প্রায়ই পালাতে হওয়ায় সংসার চালাতে সংগ্রাম করছে। তাদের যা আছে তা দিয়ে চালাতে হচ্ছে।
রাখাইনে উৎপাদিত লবণ ও মরিচের দাম আকাশছোঁয়া হয়েছে, অন্যদিকে পেঁয়াজ ও রসুন সম্পূর্ণ ফুরিয়ে গেছে। চাল মজুদ শেষ হয়ে আসছে। দাতব্য সংস্থাগুলো চাল এবং খাবার সরবরাহ করছে, কিন্তু উদ্বাস্তুদের বেশিরভাগকেই নিজেদেরই খাবার খুঁজে বের করতে হচ্ছে।
মানুষ তাদের উঠানে জন্মানো সবজি এবং কলা খাচ্ছে। কেউ কেউ নদী এবং খাল থেকে মাছ ধরছে। মানুষ ক্ষুধা মোকাবিলা করতে বিভিন্ন উপায়ের আশ্রয় নিচ্ছে।
রাখাইনে যুদ্ধের কারণে কতজন উদ্বাস্তু হয়েছে?*
রাখাইনে উদ্বাস্তুদের সংখ্যা নথিভুক্ত করছে এমন কোনো সংস্থা নেই। তবে উত্তর রাখাইনের সমস্ত শহর, যার মধ্যে কিয়াউকটাও, মরাউক-উ, মিনবিয়া, রাঠেডং, মাইবন, সিটওয়ে এবং পাউকটাও রয়েছে, এসব এলাকার সকল মানুষই তাদের বাড়ি ঘর ত্যাগ করে চলে গেছে। তারা তাদের আত্মীয়স্বজনের কাছে বা গ্রামাঞ্চলে পালিয়েছে। যাদের সামর্থ্য আছে তারা ইয়াংগুনের মতো শহরে চলে গেছে। উত্তর রাখাইনের প্রায় সমস্ত বাসিন্দা তাদের বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে।
কিছু মানুষ আরকান আর্মির অনুমতিক্রমে তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে। অন্যরা রাস্তার পাশে অস্থায়ী তাঁবুতে বসবাস করছে। কেউ কেউ স্কুল, মঠ এবং ধর্মীয় ভবনগুলোতে থাকছে। যদিও বাস্তুচ্যুতদের জন্য কোনো শিবির নেই, আরকান আর্মিপ্রতিবন্ধীদের জন্য প্রাথমিক খাদ্য সামগ্রী প্রদান করছে।
তারা কি স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে?
কিছু লোক কাছাকাছি হাসপাতাল এবং ক্লিনিকে যা সামান্য ওষুধ আছে তাই দিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছে। কেউ কেউ ধর্মীয় কোন গুরুরকাছে সাহায্য চাইছে। উত্তর রাখাইনে ফোন এবং ইন্টারনেট পরিষেবা ব্যবহার করা যাচ্ছে না, এমনকি অন্য শহরে আমাদের আত্মীয় এবং বন্ধুদের কী হয়েছে তা জানি না।
স্বাস্থ্যসেবা কোন অগ্রাধিকার নয়; মানুষ শুধু নিরাপদ স্থান খুঁজছে এবং বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে।
পরিবহন ব্যবস্থা কেমন?
উত্তর রাখাইনে সমস্ত প্রধান রুট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে এখন যেহেতু আরকান আর্মি মিয়ানমারের সামরিকব্যাটালিয়নগুলোকে পরাজিত করেছে, মরাউক-উ, কিয়াউকটাও এবং মিনবিয়া জেলায় মানুষ মোটরসাইকেলে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতে পারে। তবে জ্বালানির চড়া দাম এবং সংকটের কারণে মানুষ খুব কম ভ্রমণ করে।
এক লিটার জ্বালানি ২৫০০০ থেকে ৩০,০০ কিয়াত (প্রায় ১২- ১৪ মার্কিন ডলার) বিক্রি হচ্ছে এবং লোকেরা আগের মতো নৌকা বা বাইকে খুব বেশি ভ্রমণ করে না। আমরা গ্রামের মধ্যে রাস্তা, জেলার মধ্যে রাস্তা এবং শহরের মধ্যে রাস্তায় যাতায়াত করতে পারি। কিন্তু জ্বালানির দাম বেশি হওয়ায় মানুষের চলাচল কমে গেছে।
ইন্টারনেট এবং ফোন লাইন বিচ্ছিন্ন হওয়ায় তথ্যের জন্য মানুষকে রেডিও এবং পিএসআই স্যাটেলাইট ডিশের উপর নির্ভর করতে হয়।
রাখাইনের মানুষ গৃহযুদ্ধ নিয়ে নিয়ে কী ভাবছে?
রাখাইনবাসীরা আরকান আর্মিকে সমর্থন করলেও, তারা জান্তার চার-কাটা কৌশলের শিকার হচ্ছে। মানুষ আরকান আর্মি’র বিজয়ে উৎসাহিত, কিন্তু একই সাথে তারা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যুদ্ধ শেষ হোক তা চায়। তারা এখন মূলত একটি দুর্ভিক্ষের কাছাকাছি পৌঁছে গেছে।
Leave a Reply