পিওতর মান্তেইফেল
ধেড়ে ই’দুরের সঙ্গে যুদ্ধ
একসময় মস্কোর ঘর-বাড়ি, তল-কুঠরি আর গুদামে গিজগিজ করত ধেড়ে ইন্দুর। চিড়িয়াখানারও সর্বত্র সোধিয়েছিল ওরা। ইদুর ছিল প্রতিটি খোঁয়াড়ে, প্রতিটি খোলা চত্বরে, প্রতিটি বাসা-বাড়ি আর আপিসে। জানোয়ারদের খাদ্য চুরি করত তারা, নড়বড়ে করে দিত দেয়াল-খুটি, প্রাণনাশ ঘটাত প্রাণীদের। জলাশয়ের ধারে ওঁৎ পেতে থাকত তারা ছোটো ছোটো জলচর পাখি ধরার জন্যে। পুকুর আর অ্যাকোয়ারিয়মে টুক করে ডুব দিয়ে মাছ মারত। এদের সঙ্গে লড়ার কিছু একটা উপায় ভেবে বার করা দরকার। কেননা বিষ বা ইনজেকশন চিড়িয়াখানায় অচল, তাতে ই’দুরের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য জন্তুও মারা পড়তে পারে বিষে। কল পেতে ধরার চেষ্টা করলাম আমরা, ছোটো ক্যালিবারের বন্দুক দিয়ে গুলি
চালালাম। কিন্তু তাতে যা ধ্বংস হল তাদের জায়গা নিল আশেপাশের পাড়া থেকে আসা নতুন অক্ষৌহিণী।
চিড়িয়াখানার জীবনে নিজেদের বেশ খাপ খাইয়ে নিয়েছিল ই’দুরেরা। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড যেসব পাখি কেবল পচা মাংস খেয়ে থাকে, তাদের ডেরায় অসঙ্কোচে মাতব্বরি করে বেড়াত তারা। তবে তিতির-বাজদের খাঁচায় ঢং মারার ঝুঁকি নিত কদাচিৎ, এদের ‘খাদ্য-তালিকায়’ এই চটপটে তীক্ষ্যদন্তীরাই ছিল সবচেয়ে উপাদেয় ডিশ। রাতে পে’চাদের কাছে কদাচ না গেলেও ই’দুরেরা তাদের খাবার মারত দিনের বেলায়। এ রকম হামলায় তাদের দুশ্চিন্তার কিছু ছিল না, কেননা দিনের বেলায় পেট্য নিশ্চল হয়ে বসে থাকে। এই শিকারী পাখিরা সাধারণত শিকার ধরতে শুরু করে অন্ধকার নামলে।
ফেজন্ট আর ময়ূরদের চত্বরে ই’দুরদের উৎপাত ছিল খুবই বেপরোয়া। রাত্রে তারা এসে হামলা করত আর আইনসঙ্গত ঘরের মালিকদের রাত কাটাতে হত গাছের ডালে। এমনকি বেড়ালেরাও মাঝে মাঝে হটে যেত এই ইঁদুর অক্ষৌহিণীর ঔদ্ধত্যের সামনে।
এই ঘোর শত্রুর সঙ্গে লড়াইয়ে আমরা ফেজন্টদের অন্য জায়গায় সরিয়ে সেখানে ঈগল-পে’চাদের বসাই কয়েকবার। তখন সকালে তন্দ্রালু পোঁচাদের নখে দেখা যেত আধ-খাওয়া ই’দুর। কিন্তু সেইটেই সব নয়। মাটিতে চিহ্ন দেখে বোঝা যেত রাতে এখানে তুমুল সংঘর্ষ হয়ে গেছে। যারা ডিউটিতে থাকত সত্যিকারের যুদ্ধ দেখেছে তারা। পে’চার হাতে ধরা পড়া ই’দুরের ডাকে উত্তেজিত হয়ে তাকে প্রায়ই আক্রমণ করত আরো কয়েক ডজন ক্ষিপ্ত তীক্ষ্যূদন্তী। প্রকাণ্ড এই নৈশ পাখিটা সে আক্রমণ ঠেকাত, ধারালো নখে চেপে ধরত তার শত্রুদের, পিষে টুকরো টুকরো করে ফেলত। তাহলেও ই’দুরদের হামলায় এমন ভয়ঙ্কর শিকারী পাখিকেও তার শিকারটি নিয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছে গাছে। আর তার চেয়ে কমজোরী অন্য জাতের ছেয়ে রঙের পে’চাদের আমরা সকালে কখনো কখনো দেখেছি ইদুরের আক্রমণে ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে আছে।
তবে যতই দাপট করুক, ঈগল-পে’চার সঙ্গে দু’দিন লড়াইয়ের পর ই’দুরেরা বহুদিন এখানে আর টিকি দেখাত না।
স্তেপের কোরসাক জাতের অনতিবৃহৎ ক্ষিপ্র শেয়ালটাও ই’দুরদের জব্দ করে সমান সাফল্যে। শত্রু সংহারের জন্যে তাকে যে জায়গাটা ‘দেওয়া হয়’, সকালে তা দেখা যেত শবদেহে আকীর্ণ: এখানে ওখানে পড়ে থাকত প্রচুর পরিমাণ ইদুর, মাথার খুলি তাদের টুকরো টুকরো, আর কিছুই যেন হয় নি, এমনি ভাব করে গুটিসুটি মেরে কোরসাক নিশ্চিন্তে নিদ্রা দিত কোণটিতে।
১৯৩৫ সালের বসন্তে মস্কোয় আসেন লন্ডন জ-এর ডিরেক্টর উইওয়ের্স। আমাদের চিড়িয়াখানায় এসে তিনি জানান যে তাঁদের পশূদ্যানে ই’দূরের সঙ্গে সফল লাড়াই চালানো হয় একটি উদ্ভিদের একস্ট্র্যাক্ট দিয়ে। উদ্ভিদটি হল সামুদ্রিক পেয়াজ (Scilla maritima), বন্য অবস্থায় তা পাওয়া যায় ভূমধ্যসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরের কূলে। ওটা আমাদের ‘প্রলেসকা’র স্বগোত্র, তার খুবই কাছাকাছি জাতের উদ্ভিদ পাওয়া যায় কৃষ্ণ সাগর তীরে, সুখুমি এলাকায়।
লন্ডনে ফিরে ডক্টর উইওয়ের্স পরীক্ষার জন্যে আমাদের এক বোতল একস্ট্র্যাক্ট পাঠান। লেবেলে লেখা ছিল, বিষটা কেবল তীক্ষন্মদন্তীদের ওপর কাজ করে, অন্য জভুদের পক্ষে তা একেবারে নিরাপদ। তাহলেও বিজ্ঞাপনকে বিশ্বাস করতে ভরসা হল না। ঠিক হল আগে কয়েকটা পরীক্ষা করে দেখা যাক। বিশেষভাবে ধরা ই’দুর, বেড়াল আর চড়ুইদের দেওয়া হল বিষ-মেশানো খাবার। একদিন বাদে ই’দূরের খাঁচায় দেখা গেল ই’দুরের দেহের পশ্চাদ্ভাগ অসাড় হয়ে গেছে, কিন্তু বেড়াল আর চড়ুই দিব্যি আছে আগের মতোই।
বিজ্ঞাপন তাহলে মিছে কথা বলে নি। পরীক্ষা শেষ করার পর আমরা ই’দুরগুলোকে নির্দিষ্ট সময়ে খাবার খেতে আসতে অভ্যন্ত করাই খাবার দেওয়া হত দুধে ভেজানো শাদা রুটি। তারপর একস্ট্র্যাক্ট মেশানো দুধে দু’কিলোগ্রাম শাদা রুটি ভিজিয়ে চিড়িয়াখানার ওইসব জায়গাগুলোয় তা রেখে দিয়ে ফলাফলের অপেক্ষায় রইলাম। পরের দিনই ইঁদুর অদৃশ্য হল। শুধু কখনো-সখনো দু’- একটা চোখে পড়ত রাস্তায়, শরীরের পেছনের দিকটা তাদের অবশ।
জলচর পাখিদের খাবার জায়গায় বরাবরই কয়েক শ’ করে ই’দুর দেখা যেত। এবার কিন্তু পাখিদের জন্যে দেওয়া খাবারের কাছে আসে কেবল চারটি ই’দুর-ছানা। চিড়িয়াখানার এলাকায় সর্বদাই আশ্রয় নিত বহু, বেড়াল। মুষিক অক্ষৌহিণীকে তারা খানিকটা ভয় পেলেও মোটেই উপোস দিত না। চিড়িয়াখানায় বিষ ছড়াবার পর বেড়ালেরা পড়ল মুশকিলে: ই’দুর না থাকায় তারা জলচর পাখি শিকার করতে শুরু করল। অগত্যা গুলি করে মারতে হল বেড়ালদের।
ব্যাপারটা এতেই চুকল না: ইদুরের ফাঁকা গর্তগুলো থেকে রাস্তায় বেরিয়ে আসতে লাগল পিসু কীট, দর্শকরা চুলকিয়ে মরত।
তবে মস্কো ইদুর বিদূরণ সম্ভব হয় কেবল তখন, যখন শুধু চিড়িয়াখানায় নয়, মস্কোর সমস্ত মহল্লাতেই সংগঠিত সংগ্রাম চলে তাদের বিরুদ্ধে। এখন রাজধানীতে ইদুর দেখা যায় কালে-ভদ্রে। আমাদের দক্ষিণ অঞ্চলে চাষ হচ্ছে সামুদ্রিক পে’য়াজের, কেননা ওষুধ হিশেবেও তা প্রযুক্ত হচ্ছে।
Leave a Reply