শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৫:৩৮ পূর্বাহ্ন

ভুশণ্ডীর মাঠে

  • Update Time : বুধবার, ২০ মার্চ, ২০২৪, ১০.৩০ পিএম

পরশুরাম

সৈয়দ মুজতবা আলী’র মতে রাজশেখর বসু’র লেখা না পড়লে বাংলা সাহিত্য  ও বিশ্ব সাহিত্যের সেরা সৃষ্টি থেকে বঞ্চিত থাকতেই হবে।
রাজশেখর বসু পুরোদস্তুর বিজ্ঞানের মানুষ হলেও, পরিণত বয়সে তিনি বাংলা সাহিত্যে যে ভিন্ন ধারা’র সূচনা করেন ও সফল হন- তার বিকল্প সৈয়দ মুজতবা আলী’র মতে আর হয়নি।
রাজশেখর বসু ভাষা বিষয়ক কাজ ছাড়া বাদবাকী সাহিত্য রচনা করেছেন “পরশুরাম” ছদ্মনামে।
নতুন প্রজম্মের পাঠকদের জন্যে রাজ শেখর বসু’র  পরশুরাম ছদ্মনামে লেখা এ গল্পটি সারাক্ষণে প্রকাশ করা হলো।- সম্পাদক



শিবু  ভট্টাচার্যের নিবাস পেনেটি গ্রামে। একটি স্ত্রী, তিনটি গরু, একতলা পাকা বাড়ি, ছাব্বিশ ঘর যজমান, কিছু ব্রহ্মোত্তর জমি, কয়েক ঘর প্রজা ইহাতেই স্বচ্ছন্দে সংসার চলিয়া যায়। শিবুর বয়স বত্রিশ। ছেলেবেলায় স্কুলে যা একটু, লেখাপড়া শিখিয়াছিল এবং বাপের কাছে সামান্য যেটুকু সংস্কৃত পড়িয়া- ছিল তাহা সম্পত্তি এবং যজমান- রক্ষার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু শিবুর মনে সুখ ছিল না। তাহার স্ত্রী নৃত্যকালীর বয়স আন্দাজ প’চিশ, আঁটো-সাঁটো মজবুত গড়ন, দুর্দান্ত স্বভাব। স্বামীর প্রতি তাহার যত্নের ত্রুটি ছিল না, কিন্তু শিবু সে যত্নের মধ্যে রস খুঁজিয়া পাইত না। সামান্য খুঁটিনাটি লইয়া স্বামী-স্ত্রীতে তুমূল ঝগড়া বাধিত। পাঁচমিনিট বকাবকির পরেই শিবুর দম ফুরাইয়া যাইত, কিন্তু নৃত্যকালীর রসনা একবার ছুটিতে আরম্ভ করিলে সহজে নিরস্ত হইত না। প্রতিবারে শিবুরই পরাজয় ঘটিত। স্ত্রীকে বশে রাখিতে না পারায় পাড়ার লোকে শিবুকে কাপুরুষ, ভেড়ো, মেনী- মুখো প্রভৃতি আখ্যা দিয়াছিল। ঘরে বাহিরে এইরূপে লাঞ্ছিত হওয়ায় শিবুর অশান্তির সীমা ছিল না।

একদিন নৃত্যকালী গুজব শুনিল তাহার স্বামীর চরিত্রদোষ ঘটিয়াছে। সেদিনকার বচসা চরমে পৌছিল-নৃত্যকালীর ঝাঁটা শিবুর পৃষ্ঠ স্পর্শ করিল। শিবু বেচারা ক্রোধে ক্ষোভে কষ্টে চোখের জল রোধ করিয়া কোনও গতিকে রাত কাটাইয়া পরদিন ভোর ছ-টার ট্রেনে কলিকাতা যাত্রা করিল।

শেয়ালদহ হইতে সোজা কালীঘাটে গিয়া শিবু, নানা উপাচারে পাঁচ টাকার পূজা দিয়া মানত করিল-‘হে মা কালী, মাগীকে ওলাউঠোয় টেনে নাও মা। আমি জোড়া পাঁঠার নৈবিদ্যি দেব। আর যে বরদাস্ত হয় না। একটা সুরাহা ক’রে দাও মা, যাতে আবার নতুন ক’রে সংসার পাততে পারি। মাগীর ছেলেপুলে হ’ল না, সেটাও তো দেখতে হবে। দোহাই মা!”

মন্দির হইতে ফিরিয়া শিবু বড় এক ঠোঙা তেলেভাজা খাবার, আধ সের দই এবং আধ সের অমৃতি খাইল। তার পর সমস্ত দিন জন্তুর বাগান, জাদুঘর, হগ সাহেবের বাজার, হাইকোর্ট ইত্যাদি দেখিয়া সন্ধ্যাবেলা বীডন স্ট্রীটের হোটেল-ডি-অর্থোডক্সে এক প্লেট কারি, দু স্লেট রোস্ট ফাউল এবং আটখানা ডেভিল জলযোগ করিল। তার পর সমস্ত রাত থিয়েটার দেখিয়া ভোরে পেনেটি ফিরিয়া গেল।

মা-কালী কিন্তু উলটা বুঝিয়াছিলেন। বাড়ি আসিয়াই শিবুর ভেদবমি আরম্ভ হইল। ডাক্তার আসিল, কবিরাজ আসিল, ফলে কিছুই হইল না। আট ঘণ্টা রোগে ভুগিয়া স্ত্রীকে পায়ে ধরাইয়া কাঁদাইয়া শিবু, ইহলোক পরিত্যাগ করিল।

গ্রামে আর মন টিকিল না। শিবু, সেই রাত্রেই গঙ্গা পার হইল। পেনেটির আড়পাড় কোন্নগর। সেখান হইতে উত্তরমুখ হইয়া রুমে রিশড়া, শ্রীরামপুর, বৈদ্যবাটীর হাট, চাঁপদানির চটকল ছাড়াইয়া আরও দু-তিন ক্রোশ দূরে ভূশন্ডীর মাঠে পৌছিল। মাঠটি বহুদূর বিস্তৃত, জনমানবশূন্য। এককালে এখানে ইটখোলা ছিল সেজন্য সমতল নয়, কোথাও গর্ত, কোথাও মাটির ঢিপি। মাঝে মাঝে আসশ্যাওড়া, ঘোট, বুনো ওল, বাবলা প্রভৃতির ঝোপ। শিবুর বড়ই পছন্দ হইল। একটা বহুকালের পরিত্যক্ত ইটের পাঁজার এক পাশে একটা লম্বা তালগাছ সোজা হইয়া উঠিয়াছে, আর একদিকে একটা নেড়া বেলগাছ ত্রিভঙ্গ হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। শিবু, সেই বেলগাছে ব্রহ্মদৈত্য হইয়া বাস করিতে লাগিল।

যাঁহারা স্পিরিচুয়ালিজম বা প্রেততত্ত্বের খবর রাখেন না তাঁহাদিগকে ব্যাপারটা সংক্ষেপে বুঝাইয়া দিতেছি। মানুষ মরিলে ভূত হয় ইহা সকলেই শুনিয়াছেন। বিন্তু এই থিওরির সলো স্বর্গ’, নরক, পুনর্জন্ম খাপ খায় কিরূপে? প্রকৃত তথ্য এই। -নাস্তিকদের আত্যা নাই। তাঁহারা মরিলে অক্সিজেন হাইড্রোজেন নাইট্রোজেন প্রভৃতি গ্যাসে পরিণত হন। সাহেবদের মধ্যে যাঁহারা আস্তিক, তাঁহাদের আত্যা আছে বটে, কিন্তু পুনর্জন্ম নাই। তাঁহারা মৃত্যুর পর ভূত হইয়া প্রথমত একটি বড় ওয়েটিংরুমে জমায়েত হন। তথায় কল্পবাসের পর তাঁহাদের শেষ বিচার হয়। রায় বাহির হইলে কতগুলি ভূত অনন্ত স্বর্গে’ এবং অবশিষ্ট সকলে অনন্ত নরকে আশ্রয়লাভ করেন। সাহেবরা জীবদ্দশায় যে স্বাধীনতা ভোগ করেন, ভুতাবস্থায় তাহা অনেকটা কমিয়া যায়। বিলাতী প্রেতাত্মা বিনা পাসে ওয়েটিংরুম ছাড়িতে পারে না। যাঁহারা seance দেখিয়াছেন তাঁহারা জানেন বিলাতী ভূত নামানো কি-রকম অনী- কঠিন কাজ। হিন্দুর জন্য অন্যরূপ বন্দোবস্ত, কারণ আমরা পুনর্জন্ম, স্বর্গ’, নরক, কর্ম’ফল, স্তির তৃয়া হৃষীকেশ, নির্বাণ, মুক্তি সবই মানি। হিন্দু মরিলে প্রথমে ভভূত হয় এবং যত-তত স্বাধীনভাবে বাস করিতে পারে-আবশ্যক-মত ইহলোকের সঙ্গে কারবারও করিতে পারে। নকার এটা একটা মস্ত সুবিধা। কিন্তু এই অবস্থা বেশী দিন স্থায়ী নয়। কেহ কেহ দু-চার দিন পরেই পুনর্জন্ম লাভ করে, কেহ-বা দশ-বিশ বৎসর পরে, কেহ-বা দু-তিন শতাব্দী পরে।

ভূতদের মাঝে-মাঝে চেঞ্জের জন্য স্বগে’ ও নরকে পাঠানো হয়। এটা তাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল, কারণ স্বগে’ খুব ফুর্তি’তে থাকা যায় এবং নরকে গেলে পাপ ক্ষয় হইয়া সুক্ষতশরীর বেশ হালকা ঝরঝরে হয়, তা ছাড়া সেখানে অনেক ভাল ভাল লোকের সঙ্গ্যে দেখা হইবার সুবিধা আছে। কিন্তু যাহাদের ভাগ্যরুমে ‘কাশীলাভ হয়, অথবা নেপালে পশুপতিনাথবা রখের উপর বামনদর্শ’ন ঘটে, কিংবা যাঁহারা স্বকৃত পাপের বোঝা হৃষীকেশের উপর চাপাইয়া নিশ্চিন্ত হইতে পারেন, তাহাদের পুনর্জন্ম ন বিদ্যতে একেবারেই মুক্তি।

দু-তিন মাস কাটিয়া গিয়াছে। শিবু, সেই বেলগাছেই থাকে। প্রথম প্রথম দিনকতক নূতন স্থানে নূতন অবস্থায় বেশ আনন্দে কাটিয়াছিল, এখন শিবুর বড়ই ফাঁকা-ফাঁকা ঠেকে। মেজাজটা যতই বদ হউক, নত্যের একটা আন্তরিক টান ছিল, শিবু এখন তাহা হাড়ে হাড়ে অনুভব করিতেছে। একবার ভাবিল-দূর হ’ক, না-হয় পেনেটিতেই আড্ডা গাড়ি। তার পর মনে হইল-লোকে বলিবে বেটা ভূত হইয়াও স্ত্রীর আচল ছাড়িতে পারে নাই। নাঃ, এইখানেই একটা পছন্দমত উপদেবীর যোগাড় দেখিতে হইল।

ফাল্গুন মাসের শেষবেলা। গঙ্গার বাঁকের উপর দিয়া দক্ষিণা হাওয়া ঝির-ঝির করিয়া বহিতেছে। সূর্যদেব জলে হাবুডুবু খাইয়া এইমাত্র তলাইয়া গিয়াছেন। ঘে’টুফুলের গন্ধে শুশন্ডীর মাঠ ভরিয়া গিয়াছে। শিবুর বেলগাছে নূতন পাতা গজাইয়াছে। দূরে আকন্দ ঝোপে গোটাকতক পাকা ফল ফট করিয়া ফাটিয়া গেল, একরাশ তুলোর অশি হাওয়ায় উড়িয়া মাকড়শার ককালের মত ঝিকমিক করিয়া শিবুর গায়ে পড়িতে লাগিল।

লজ্জায় জিব, কাটিয়াছিল

 

একটা হলদে ভাঙর প্রজাপতি শিশুর সংক্ষঃশরীর ভেদ করিয়া উড়িয়া গেল। একটা কাল গুবরে পোকা ভরার করিয়া শিবুকে প্রদক্ষিণ করিতে লাগিল। অদূরে বাবলা গাছে একজোড়া দাঁড়কাক বসিয়া আছে। কাক গলায় সড়েসুড়ি দিতেছে, কাকিনী চোখ মুদিয়া গদগদ হবে মাকে- মাঝে ক-অ-এ করিতেছে। একটা কটকটে ব্যাং সদ্য ঘুম হইতে উঠিয়া গুটিগুটি পা ফেলিয়া বেলগাছের কোটর হইতে বাহিরে আসিল, এবং শিশুর দিকে ড্যাবডেনে চোখ মেলিয়া টিটকারি দিয়া উঠিল। একদল ঝিঝিপোকা সন্ধ্যার আসরের জন্য যন্ত্রে সূর বাঁধিতেছিল, এতক্ষণে সংগত ঠিক হওয়ায় সমস্বরে রিরিরিরি করিয়া উঠিল।

শিবুর যদিও রক্তমাংসের শরীর নাই, কিন্তু মরিলেও স্বভাব যাইবে কোথা। শিবুর মনটা খাখা করিতে লাগিল। যেখানে হৃৎপিণ্ড ছিল সেখানটা ভরাট হইয়া ধড়াক ধড়াক

গোবর-গোলা জল ছড়াইয়া যায়

 

করিতে লাগিল। মনে পড়িল-ভুশন্ডীর মাঠের প্রান্তস্থিত পিটুলি-বিলের ধারে শ্যাওড়া- গাছে একটি পেত্নী বাস করে। শিবু তাহাকে অনেকবার সন্ধ্যাবেলা পলো হাতে মাছ ধরিতে দেখিয়াছে। তার আপাদমস্তক ঘেরাটোপ দিয়া ঢাকা, একবার সে ঢাকা খুলিয়া শিবুর দিকে চাহিয়। লজ্জায় জিব কাটিয়াছিল। পেত্নীর বয়স হইয়াছে, কারণ তাহার গাল একটু তোব- ড়াইয়াছে এবং সামনের দুটো দাঁত নাই। তাহার সঙ্গে ঠাট্টা চলিতে পারে, কিন্তু প্রেম হওয়া অসম্ভব।

একটি শাঁকচুন্নী কয়েকবার শিবুর নজরে পড়িয়াছিল। সে একটা গামছা পরিয়া আর একটা গামছা মাথায় দিয়া এলোচুলে বকের মত লম্বা পা ফেলিয়া হাতের হাঁড়ি হইতে গোবর-গোলা জল ছড়াইতে ছড়াইতে চলিয়া যায়। তাহার বয়স তেমন বেশী বোধ হয় না। শিবু, একবার রসিকতার চেষ্টা করিয়াছিল, কিন্তু শাঁকচুন্নী ক্রদ্ধ বিড়ালের মত ফ্যাচ করিয়া ওঠে, অগত্যা শিবুকে ভয়ে চম্পট দিতে হয়।

শিবরে মন সবচেয়ে হরণ করিয়াছে এক ডাকিনী। ভূশন্ডীর মাঠের পূর্বদিকে গঙ্গার ধারে ক্ষীরী-বামনীর পরিত্যক্ত ভিটায় যে জীর্ণ ঘরখানি আছে তাহাতেই সে অল্পদিন হইল আশ্রয় লইয়াছে। শিবু, তাহাকে শুধু একবার দেখিয়াছে এবং দেখিয়াই মজিয়াছে। ডাকিনী তখন একটা খেজুরের ডাল দিয়া রোয়াক ঝাঁট দিতেছিল। পরনে সাদা থান। শিবুকে দেখিয়া নিমেষের তরে ঘোমটা সরাইয়া ফিক করিয়া হাসিয়াই সে হাওয়ার সঙ্গে মিলাইয়া যায়। কি দাঁত! কি মুখে! কি রং। নৃত্যকালীর রং ছিল পানতুয়ার মত। কিন্তু ডাকিনীর রং যেন পানতুয়ার শাঁস।

খেজুরের ডাল দিয়া রোয়াক ঝাঁট দিতেছিল

 

 

 

শিব একটি সুদীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়িয়া গান ধরিল-

আহা, শ্রীরাধিকে চন্দ্রাবলী

কারে রেখে কারে ফেলি।

সহসা প্রান্তর প্রকম্পিত করিয়া নিকটবর্তী তালগাছের মাথা হইতে তীব্রকণ্ঠে শব্দ উঠিল-

চা রা রা রা রা রা

আরে ভজুয়াকে বহিনিয়া ভগ্‌লুকে বিটিয়।

কেক্‌রাসে সাদিয়া হো কেব্লাসে হো-ও-ও-ও-

শিবু, চমকাইয়া উঠিয়া ডাকিল-‘তালগাছে কে রে?’

 

সড়াক্ করিয়া নামিয়া আসিল

 

উত্তর আসিল-‘কারিয়া পিরেত বা।’

শিবু। কেলে ভূত? নেমে এস বাবা।

মাথায় পাগড়ি, কাল লিকলিকে চেহারা, কাঁকলাসের মত একটি জীবাত্মা সড়াক করিয়া বালগাছের মাথা হইতে নামিয়া ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিয়া বলিল-গোড় লাগি বরমদেওজী।’

শিবু। জিতা রহো যেটা। একট, তামাক খাওয়াতে পারিস?

কারিয়া পিরেত। ছিলম বা?

শি্বু। তামাকই নেই তা ছিলিম। যোগাড় কর না।

প্রেত ঊর্ধ্বে, উঠিল এবং অল্পক্ষণমধ্যে বৈদ্যবাটির বাজার হইতে তামাক টিকা কলিকা আনিয়া আগ শুঙ্গাইয়া শিশুর হাতে দিল। শিশু, একটা কচুর ডাঁটার উপর কলিকা বসাইয়া টান দিতে দিতে বলিল-‘তার পর, এলি কবে? তোর হাল চাল সব বল্।’

কারিয়া পিরেত যে ইতিহাস বলিল তার সারমম’ এই।-

তাহার বাড়ি ছাপরা জিলা। দেশে এককালে তাহার জরু, গরু জমি জেরাত সবই ছিল। তাহার স্ত্রী মুংরী অত্যন্ত মুখেরা ও বদমেজাজী, বনিবনাও কখনও হইত না। একদিন প্রতিবেশী ভজয়ার ভগ্নীকে উপলক্ষ্য করিয়া স্বামী-স্ত্রীতে বিষম ঝগড়া হয়, এবং তীর পিঠে এক ঘা লাঠি কশাইয়া স্বামী দেশ ছাড়িয়া- কলিকাতায় চলিয়া আসে। সে আজ বিশ বৎসরের কথা। কিছুদিন পরে সংবাদ আসে যে মুংরী বসন্ত রোগে মরিয়াছে। স্বামী আর দেশে ফিরিল না, বিবাহও করিল না। নানা স্থানে চাকরি করিয়া অবশেষে চাঁপদানির মিলে কুলীর কাজে ভর্তি হয় এবং কয়েক বৎসর মধ্যে সর্দারের পদ পায়। কিছুদিন পূর্বে একটি লোহার কড়ি হাফিজ অর্থাৎ কপিকলে উত্তোলন করিবার সময় তার মাথায় চোট লাগে। তার পর একমাস হাসপাতালে শয্যাশায়ী হইয়া থাকে। সম্প্রতি পণ্ডত্বপ্রাপ্ত হইয়া প্রেতরূপে এই তালগাছে বিরাজ করিতেছে। শিশু একটা লম্বা টান মারিয়া কলিকাটি কারিয়া পিরেতকে দিবার উপক্রম করিতেছিল, এমন সময় মাটির ভিতর হইতে ভাঙা কাঁসরের মত আওয়াজ আসিল ভায়া, কলবেটায় কিছু আছে না কি?’

 

বেলগাছের কাছে যে ইটের পাঁজা ছিল তাহা হইতে খানকতক ইট খসিয়া গেল এবং ফাঁকের ভিতর হইতে হামাগুড়ি দিয়া একটি মূর্তি’ বাহির হইল। স্কুল খব’ দেহ, থেলো হাঁকার খোলের উপর একজোড়া পাকা গোঁফ গজাইলে যে-রকম হয় সেই প্রকার মুখ, মাথায় টাক, গলায় রুদ্রাক্ষের মালা, গায়ে ঘুন্টি-দেওয়া মেরজাই, পরনে ধুতি, পায়ে তালতলার চটি। আগন্তুক শিবুর হাত হইতে কলিকাটি লইয়া বলিলেন ব্রাহ্মণ? দণ্ডবৎ হই। কিছু সম্পত্তি ছিল, এইখানে পোঁতা আছে। তাই যক্ষি হয়ে আগলাচ্ছি। বেশী কিছু নয়-দু- পাঁচশো। সব বন্ধকী তমসুক দাদা-ইন্টাম্বর কাগজে লেখা নগদ সিক্কা একটিও পাবে না । খবরদার, ওদিকে নজর দিও না-হাতে হাতকড়ি পড়বে, থুঃ থুঃ। শিবুর মেঘদূত একটু আধটু জানা ছিল। সসম্ভ্রমে জিজ্ঞাসা করিল যক্ষ মহাশয়, আপনিই কি কালিদাসের-‘যক্ষ। ভায়রাভাই। কালিদাস আমার মাসতুতো শালীকে বে করে। ছোকরা হিজলিতে নিমকির গোমস্তা ছিল, অনেক দিন মারা গেছে। তুমিতার নাম জানলে কিসে হ্যা?

শিব্বু। আপনার এখানে কতদিন আগমন হয়েছে?

যক্ষ। আমার আগমন? হ্যা, হ্যা! আমি বলে গিয়ে সাড়ে তিন কুড়ি বছর এখানে আছি। কত এল দেখলুম, কত গেল তাও দেখলুম। আরে তুমি তো সেদিন এলে, কাটপি পড়ে তাড়িয়ে তিনবার হোঁচট খেয়ে গাছে উঠলে। সব দেখেছি আমি। তোমার গানের শখ আছে।

 

সব বন্ধকী তমসুক দাদা

 

দেখেছি-বেশ বেশ। কালোয়াতি শিখতে যদি চাও তো আমার শাগরেদ হও দাদা। এখন আওয়াজটা যদিচ একটু খোনা হয়ে গেছে, তবু মরা হাতি লাখ টাকা।

শিবু। মশায়ের ভূতপূর্ব পরিচয়টা জিজ্ঞাসা করতে পারি কি?

যক্ষ। বিলক্ষণ। আমার নাম শুনদেরচাঁদ মল্লিক, পদবী বসু, জাতি কায়স্থ, নিবাস রিশড়ে, হাল সাকিন এই পাঁজার মধ্যে। সাবেক পেশা দারোগাগিরি, ইলাকা রিশড়ে ইস্যক ভদ্রেশ্বর। জর্জ’টি সাহেবের নাম শুনেছ? হুগলির কালেক্টর-ভারি ভালবাসত আমাকে। মূল্লকের শাসনটা তামাম আমার হাতেই ছেড়ে দিয়েছিল। নাদু মল্লিকের দাপটে লোকে ত্রাহি ত্রাহি ডাক ছাড়ত।

শিবু। মশায়ের পরিবারাদি কি?

যক্ষ দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন-‘সব সুখ কি কপালে হয় রে দাদা! ঘরসংসার সবই তো ছিল, কিন্তু গিন্নীটি ছিলেন খাণ্ডার। বলব কি মশায়, আমি হলুম গিয়ে নাদু মল্লিক-কোম্পানির ফৌজদারী নিজামত আদালত যার মুঠোর মধ্যে-আমারই পিঠে দিলে কিনা এক ঘা চেলা-কাঠ কশিয়ে! তার পরেই পালাল বাপের বাড়ি। তিন-শ চব্বিশ ধারায় ফেলতুম, কিন্তু কেলেঙ্কারির ভয়ে গ্রেপ্তারী পরোয়ানা আর ছাড়লুম না। কিন্তু যাবে কোথা? গুরু আছেন, ধর্ম আছেন। সাতচল্লিশ সনের মড়কে মাগী ফৌত হ’ল। সংসারধর্মে’ আর মন বসল না। জর্জটি সাহেব বিলেত গেলে আমিও পেনশন নিয়ে এক শখের যাত্রা খুললুম। তার পর পরমাই ফরুলে এই হেথা আড্ডা গেড়েছি। ছেলেপুলে হয় নি তাতে দুঃখ নেই দাদা। আমি করব রোজগার, আর কোন্ আবাগের-বেটা-ভূত মানুষ হয়ে আমার ঘরে জন্ম নিয়ে সম্পত্তির ওয়ারিস হবে-সেটা আমার সইত না। এখন তোফা আছি, নিজের বিয়ে নিতে আগলাই গণার হাওয়া খাই আর বব-বম, করি। থাক, আমার কথা তো সব পনেলে, তোমার কেচ্ছা বল।’

নেলে এমন হয় মতিহাস সমস্ত বিবৃত করিল, কারিয়া পিরেতের পরিচয়ও দিল। যক্ষ বলিলেন-সব স্যাভাতের একই হাল দেখছি। পুরনো কথা ভেবে মন খারাপ ক’রে ফল নেই, এখন একটু, গাওনা-বাজনা করি এস। পাখোয়াজ নেই-তেমন জুত হবে না। আচ্ছা, পেট চাপড়েই ঠেকা দিই। উইং-চনচন করছে। বাবা ছাতুখোর, একট, এ’টেল-মাটি চটকে এই মধ্যিখানে খাবড়ে দে তো। ঠিক হয়েছে। চৌতাল বোঝ? ছ মাত্রা, চার তাল, দুই ফাঁক।

ধাধা বিন তা কং তা গে, গিন্নী ঘা দেন কর্তা কে।

বোল শোন-

করে তাড়া ক’রে খিটখিটে কথা কয় ধুর্তা গিন্নী কর্তা গাধারে।

ঘাড়ে ধরে ঘন ঘন খা কত ধুম ঘুম দিতে থাকে।

উিট টিপে ক’টি ধরে উলটে পালটে ফ্যালে গিয়ী হয়েটির ক্ষমতা কম নয়;

ধাক্কা হকেকি দিতে ত্রুটি ধনী করে না নগণ্য নির্ধন কর্তা গাধা-

‘ধা’-এর উপর সম। ধিন তা তেরে কেটে গদি ঘেনে ধা।

এই বা ফসকালেই সব মাটি। গলাটা ধরে আসছে। খোট্টাভূত, আর এক ছিলিম সাজ বেটা।’

ট্রেংযোগী পুরুষের লক্ষ্মীলাভ অনিবার্য’। অনেক কাকুতি-মিনতির পরে ডাকিনী শিবরে ঘর করিতে রাজী হইয়াছে। কিন্তু সে এখনও কথা বলে নাই, ঘোমটাও খোলে নাই, তবে ইশারায় সম্মতি জানাইয়াছে। আজ ভৌতিক পদ্ধতিতে শিবুর বিবাহ। সূর্যাস্ত হইবামার শিব, সর্বালো গঙ্গামত্তিকা মাখিয়া স্নান করিল, গাবের আটা দিয়া পইতা মাজিল, ফণি-মনসার বরেশে দিয়া চুল আঁচড়াইল, টিকিতে একটি পাকা তেলাকুচা বাঁধিল। ঝোপে কোপে বনজপালে ঘুরিয়া ঘুরিয়া একরাশ ঘেটুফল, বঁইচি, কয়েকটি পাকা নোনা ও বেল সংগ্রহ করিল। তারপর সন্ধ্যায় শেয়ালের ঐকতান আরম্ভ হইতেই সে ক্ষীরী বামনীর ভিটায় যারা করিল।

সেদিন শক্লেপক্ষের চতুর্দশী। ঘরের দাওয়ায় কচুপাতার আসনে ডাকিনীর সম্মুখে বসিয়া শিবু, মন্ত্রপাঠের উদযোগ করিয়া উৎসুক চিত্তে বলিল-‘এইবার ঘোমটাটা খুলতে হচ্ছে।’

ডাকিনী ঘোমটাটা সরাইল। শিবু চমকিত হইয়া সভয়ে বলিল-‘অ্যাঁ! তুমি নেত্য’ নত্যকালী বলিল-হ্যাঁরে মিনসে। মনে করেছিলে ম’রে আমার কবল থেকে বাঁচবে। পেরা শাঁকচুন্নীর পিছু পিছু ঘুরতে বড় মজা, না?’

শি্বু। এলে কি করে? ওলাউঠোয় নাকি?

নৃত্যকালী। ওলাউঠো শত্রুরের হ’ফ। কেন, ঘরে কি কেরোসিন ছিল না?

শিবু। তাই চেহারাটা ফরসাপানা দেখাচ্ছে। পোড় খেলে সোনার জলুস বাড়ে। ধাতটাও

একটু, নরম হয়েছে নাকি?

শুভকর্মে’ বাধা পড়িল। বাহিরে ও কিসের গোলযোগ? যেন একপাল শকুনি-গৃধিনী ঝুটোপটি কাড়াকাড়ি ছোঁড়াছি’ড়ি করিতেছে। সহসা উল্কার মত হটিয়া আসিয়া পেত্নী ও শাঁকচুন্নী উঠানের বেড়ার আগড় ঠেলিয়া ভীষণ চেচামেচির আত জয়ি আছিয়া বানার দেবতাগণের সুবিধার জন্য চন্দ্রবিন্দু, বাদ দিলাম, পাঠকগণ ইচ্ছামত বসাইয়া লইবেন)। পেত্নী। আমার সোয়ামী তোকে কেন দেব লা?

লকিয়েী। আ মর বাড়ী, ও যে তোর নাতির বয়সী।

পেত্নী। আহা, কি আমার কনে বউ গা।

শাঁকচুন্নী। দূরে মেছোপেত্নী, আমি যে ওর দু-জন্ম আগেকার বউ। পেত্নী। দুর গোবরচুন্নী, আমি যে ওর তিন জন্ম আগেকার বউ।

শাঁকচুন্নী। মর চে’চিয়ে, ওদিকে ডাইনি মাগী মিনসেন্সকে নিয়ে উধাও হ’ক। তখন পেত্নী বিড়বিড় করিয়া মন্ত্র পড়িয়া আগড় বন্ধ করিয়া বলিল-‘আগে তোর খাড় বেটীকে খাব।’

মটকাব তার পর ডাইনি কামড়াকামড়ি চুলোচুলি আরম্ভ হইল। একা নৃত্যকালীতেই রক্ষা নাই তাহার উপর পূর্বতন দুই জন্মের আরও দুই পরী হাজির। শিব্বু হাতে পইতা জড়াইয়া ইষ্টমন্ত্র জপিতে লাগিল। নৃত্যকালী রাগে ফুলিতে লাগিল।

এমন সময় নেপথ্যে যক্ষের গলা শোনা গেল-

ধনী, শুনছ কিবা আনমনে, ভাবছ বুঝি শ্যামের বাঁশি ডাকছে তোমায় বাঁশবনে।

ওটা যে খ্যাঁকশেয়ালী, দিও না কুলে কালী।

রাত-বিরেতে শ্যালকুকুরের ছুঁচোপ্যাঁচার ডাক শুনে। কাছে আসিয়া বলিলেন-‘ভায়া; এখানে হচ্ছে কি? এত গোল কিসের?’

যক্ষ বেড়ার কারিয়া পিরেত হাঁকিল-‘এ বরম পিচাস, আরে দরবাজা তো খোল।’

শিবুর সাড়া নাই।

প্রচন্ড ধাক্কা পড়িল, কিন্তু মন্ত্রবন্ধ আগড় খুলিল না, বেড়াও ভাঙ্গিল না। তখন কারিয়া পিরেত তারস্বরে উৎপাটনমন্ত্র পড়িল-

 

মারে জ জুয়ান-হে’ইয়া

আউর ভি থোড়া-হে’ইয়া

পর্বত তোড়ি হে’ইয়া

চলে ইঞ্জন-হে’ইয়া

ফটে বয়লট-হে’ইয়া

খবরদার-হা-ফিজ।

 

মড় মড় করিয়া ঘরের চাল, দেওয়াল, বেড়া, আগড় সমস্ত আকাশে উঠিয়া দূরে নিক্ষিপ্ত হইল।

 

ডাকিনী, অর্থাৎ নৃত্যকালীকে দেখিয়া যক্ষ বলিলেন-‘একি, গিন্নী! এখানে? বেহ্মদত্যি- টার সঙ্গে! ছি ছি-লজ্জার মাথা খেয়েছ?’ ডাকিনী ঘোমটা টানিয়া কাঠ হইয়া বসিয়া রহিল।

কারিয়া পিরেত বলিল-‘আরে মুংরী, তোহর শরম নহি বা?’

   *                                            *                                                *

 

তার পর যে ব্যাপার আরম্ভ হইল তাহা মনে করিলেও কলমের কালি শুখাইয়া যায়। শিবুরে তিন জন্মের তিন স্ত্রী এবং নিত্যকালীর তিন জন্মের তিন স্বামী-এই ডবল তাংস্পর্শাযোগে ভুশন্ডীর মাঠে যুগপৎ জলস্তম্ভ, দাবানল ও ভূমিকম্প শুরু হইল। ভাত প্রেত, দৈত্য, পিশাচ, তাল, বেতাল প্রভাতি দেশী উপদেবতা যে যেখানে ছিল, তামাশা দেখিতে আসিল। শুকে, পিক্সি, নোম, গবলিন প্রভাতি গোঁফ-কামানো বিলাতি ভূত বাঁশি বাজাইয়া নাচিতে লাগিল। জিন, জান, আজিদ, মারীদ প্রভৃতি লম্বা-দাড়িওয়ালা কাবুলী ভূত দাপা দাপি আরম্ভ করিল। চিং চ্যাং, ফ্যাচাং ইত্যাদি মাকুন্দে চীনে-ভূত ডিগবাজি খাইতে লাগিল।

রাম রাম রাম। জয় হাড়িকি চণ্ডী আজ্ঞা কর মা! কে এই উৎকট দাম্পত্যসমস্যার সমাধান করিবে? আমার কম নয়। ভূতজাতি অতি নাছোড়বান্দা, ন্যায্যগণ্ডা ছাড়িবে না। পুরুষের পুরুষত্ব, নারীর নারীত্ব ভূতের ভতেত্ব, পেত্নীর পেরীত্ব-এসব তাহারা বিলক্ষণ বোঝে। অতএব সনির্বন্ধ অনুরোধ করিতেছি-শ্রীযুক্ত শরৎ চাটুজো, চারু, বাঁড়জো, নরেশ সেন এবং যতীন সিংহ মহাশয়গণ যুক্তি করিয়া একটা বিলি-ব্যবস্থা করিয়া দিন-যাহাতে এই ভূতের সংসারটি ছারেখারে না যায় এবং কোনও রকম নীতি-বিগহি’ত বিদু কুটে ব্যাপার না ঘটে। নিতান্ত যদি না পারেন, তবে চাঁদা তুলিয়া গয়ায় পিন্ড দিবার চেষ্টা দেখুন যাহাতে বেচারারা অতঃপর শান্তিতে থাকিতে পারে।

 

ভারতবর্ষ, ফাল্গুন ১৩৩০ (১৯২৩)

 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024