শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:৪০ অপরাহ্ন

‘মব জাস্টিসের’ শিকার তোফাজ্জল হোসেনের পরিবার বলছে তাদের কাছে টাকা চাওয়া হয়েছিল

  • Update Time : শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১.২৭ পিএম
তোফাজ্জল হোসেন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক আবাসিক হলে শিক্ষার্থীদের পিটুনিতে নিহত তোফাজ্জল হোসেনের পরিবার বলছে, তাদের কাছে দুই লক্ষ টাকা দাবী করা হয়েছিল। অন্যথায় হোসেনকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হয়।

“ফোন করে হুমকি দেয়, ২ লাখ টাকা পাঠান। না হলে তাকে মেরে ফলবো। তখন আমি ভয় পেয়ে যাই। আমি গ্রামের চৌকিদারকে জানাই। পরে সকালে জানতে পারি তাকে মেরে ফেলা হয়েছে, ” তোফাজ্জল হোসেনের বড় ভাইয়ের স্ত্রী শরিফা বেগম বৃহস্পতিবার ভিওএকে বলেন।

বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) রাতে তোফাজ্জল হোসেনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।

কী হয়েছিল বুধবার রাতে

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, বুধবার সন্ধ্যায় তোফাজ্জল লুকিয়ে ফজলুল হক মুসলিম হলে ঢুকে পড়েন। এ সময় কয়েকজন শিক্ষার্থী তাকে চোর সন্দেহে ধরে এনে আগের দিন হল থেকে ছয়টি মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ চুরির বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে।

জিজ্ঞাসাবাদের মুখে তিনি বলেন, যদি তাকে কিছু খেতে দেওয়া হয়, তাহলে তিনি ‘আসল চোরদের’ কথা বলবেন।

শিক্ষার্থীরা তাকে ভাত খাওয়ান। কিন্তু তিনি চোরদের বিষয়ে তথ্য দিতে পারেননি। এরপর ঐ শিক্ষার্থীরা খেপে গিয়ে রাত ১০টা থেকে শুরু করে দুই ঘণ্টা তাকে মারধর করেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান।

বিষয়টি প্রক্টরিয়াল টিমকে জানানো হলে তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে গুরুতর আহত তোফাজ্জলকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

পরিবারের দাবী তাদের কাছে টাকা চাওয়া হয়েছিল

তোফাজ্জলকে হত্যার আগে ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে তার পরিবারের কাছে টাকা চাওয়া হয়েছিল বলে দাবী করেছেন তার বড় ভাইয়ের স্ত্রী শরিফা বেগম।

শরিফা বেগম ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “রাতে আমার মোবাইলে ফোন আসে, বলে আমি তোফাজ্জল। মোবাইল চুরির কারণে ধরা পড়েছি। আমারে টাকা পাঠাও।”

শরিফা বেগম বাড়িতে দুটো ছোট বাচ্চা নিয়ে একা থাকেন। তিনি ওই ফোনের ঘটনায় খানিকটা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন বলে জানান।

কিছুক্ষন পরে আবার ফোন করে হুমকি দেয়, ২ লাখ টাকা পাঠান। না হলে তাকে মেরে ফলবো। তখন আমি ভয় পেয়ে যাই।

শরিফা বেগম বলেন, “এরপর ওই নাম্বার থেকে আবার ফোন করেন একজন। আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়- তোফাজ্জলকে আমি চিনি কিনা? আমি বলছি সে আমার দেবর হয়। তখন বলে, সে চুরিতে ধরা খেয়েছে। তাকে নেওয়ার ব্যবস্থা করেন। তখন বলেছি, ভাই আমি মহিলা মানুষ, গ্রামে থাকি। কিভাবে কি করবো। আসলে সে চোর না, অনার্স-মাস্টার্স করা ছেলে। মাথায় সমস্যা আছে।”

“তখন আমাকে বলা হয়, মাথায় সমস্যা থাকলে এতোগুলো নাম্বার কিভাবে মুখস্থ বলে। তখন আমি বলি, তার জ্ঞান ভালো। আমার কথা বিশ্বাস না হলে গ্রামের তার আত্মীয়-স্বজনদের কাছে খোঁজ নিতে পারেন। এরপর ফোন কেটে দেয়,” বলে উল্লেখ করেন শরিফা বেগম।

এরপর আবারও শরিফা বেগমকে ফোন করে দুই লাখ টাকা দেয়া না হলে তোফাজ্জলকে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়, “কিছুক্ষন পরে আবার ফোন করে হুমকি দেয়, ২ লাখ টাকা পাঠান। না হলে তাকে মেরে ফলবো। তখন আমি ভয় পেয়ে যাই। তারপর তার আমি পাশের একজন চাচাকে বিষয়টি জানাই। তখন তিনি আমাকে বলে, কেউ দুষ্টামি করছে তুই ঘুমায় যা। তারপর আমি গ্রামের চৌকিদারকে জানাই। পরে সকালে জানতে পারি তাকে মেরে ফেলা হয়েছে।”

কে ছিলেন তোফাজ্জল হোসেন

তোফাজ্জল বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কাঁঠালতলী ইউনিয়নের বাসিন্দা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কেউ কেউ জানান, তোফাজ্জল হোসেন মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন।

১০ বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় তোফাজ্জল হোসেনের বাবা মারা যান। তার চার বছরের মধ্যে মাকে হারান তিনি। তখন থেকে বড় ভাই ছিল তার অভিভাবক। কিন্তু ভাইও ক্যান্সারে মারা গেলে তিনি অসহায় হয়ে পড়েন বলেন ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানিয়েছেন তার চাচা আব্দুল জলিল।

বাল্যবন্ধু সুমন ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানান, তোফাজ্জল পাথরগাটা স্কুল থেকে এসএসসি এবং ফজলুল হক ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। এবং পরে পিরোজপুর সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে অনার্স-মাস্টার্স করেছেন।

এক সময় তোফাজ্জল হোসেন পাথরঘাটা উপজেলার কাঠালতলী ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাথে যুক্ত ছিলেন।

বিগত ২ থেকে ৩ বছর তোফাজ্জল প্রায়ই ঢাকা বিশবিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াত। আমাদের এলাকার যারা ওরে চিনত সবাই সহযোগিতা করত।

তোফাজ্জলের প্রতিবেশী সাইফুল ইসলাম বলেন, “শুনেছি, প্রেম করতো একটা। পরে মেয়েটা তাকে ছেড়ে চলে গেলে কিছুটা মানসিক সমস্যা দেখা দেয় তার।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তোফাজ্জল একজন পরিচিত মুখ ছিলেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী আরিফুজ্জামান আল ইমরান এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, “বিগত ২ থেকে ৩ বছর তোফাজ্জল প্রায়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াত। আমাদের এলাকার যারা ওরে চিনত সবাই সহযোগিতা করত।…আমি দেখা হলে ওরে খাবার খেতে বলতাম বা খাওয়ার জন্য টাকা দিতাম অথবা ও মাঝেমধ্যে চেয়ে নিত।”

ছয় শিক্ষার্থী আটক

তোফাজ্জলকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগে ছয় শিক্ষার্থীকে আটক করেছে পুলিশ।

আটক শিক্ষার্থীরা হলেন, ফজলুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জালাল মিয়া; মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের শিক্ষার্থী মোত্তাকিন সাকিন; পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ সুমন মিয়া; ভুগোল বিভাগের আল হুসাইন সাজ্জাদ এবং আহসানউল্লাহ ও ওয়াজিবুল আলম নামের দুই শিক্ষার্থী। তারা সবাই ফজলুল হক মুসলিম হলের আবাসিক শিক্ষার্থী।

এর আগে এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় মামলা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কী বলছে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “হত্যাকাণ্ড ঘটনায় অভিযুক্ত নেতা জালাল আহমেদ বহিরাগত ছিল। আসলে এরা আগের নিয়মে হল থাকছেন। সে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল। কিন্তু আমরা দায়িত্ব নেওয়ার পরে একটা নিয়ম করে দিয়েছিলাম যে ২০১৭-১৮ সেশনের আগের কেউ হলে থাকতে পারবে না। সেই বাছাইয়ের কাজ চলছিল। গতকালও সেই কাজ চলছিল। এরমধ্যে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে গেছে।”

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য অধ্যাপক ড. নিয়াজ আহমেদ খানের সঙ্গে ভয়েস অফ আমেরিকার পক্ষে থকে একাধিবার যোগাযোগ করেও বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

ঘটনার প্রতিবাদ

মব জাস্টিসের বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন উল্লেখ করে বৃহস্পতিবার সকালে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, “আইন নিজেদের হাতে তুলে নেওয়ার অধিকার কারও নেই। কেউ অন্যায় করলে তাকে আইনের হাতে সোপর্দ করুন, অন্যথায় নয়।”

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক এবং অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এই হত্যার ঘটনাকে দুঃখজনক উল্লেখ করে বিচারের দাবী জানিয়েছেন সামাজিক মাধ্যমে।

ঢাকা গেল তাকে পিটিয়ে মেরে ফেললো। একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে কিভাবে মেরে ফেলে। আমরা এর বিচার চাই।

এদিকে এই ঘটনার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী বৃহস্পতিবার ভোরে টিএসসি এলাকায় বিক্ষোভ করেছেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুই সমন্বয়ক সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহ ‘মব জাস্টিসের বিপক্ষে সামাজিক মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে পোষ্ট দিয়েছেন এবং এই সমন্বয়করা হত্যার ঘটনায় অপরাধীদের শাস্তির দাবী জানিয়েছেন।

হত্যার ঘটনায় নিন্দা জানিয়েছে বিএনপি ছাত্র সংগঠন ছাত্র দল।

নিহতের চাচা আব্দুল জলিল ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেছেন, “ঢাকা গেল তাকে পিটিয়ে মেরে ফেললো। একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে কিভাবে মেরে ফেলে। আমরা এর বিচার চাই।”

তোফাজ্জল হোসেনের মরদেহ তার বরগুনার গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হয়েছে।

তোফাজ্জল হোসেনের চাচাতো ভাই শাহাদাত হোসেন ভয়েস অফ আমেরিকাকে জানিয়েছেন শুক্রবার সকালে তার দাফন করা হবে।

(এই প্রতিবেদনের কিছু তথ্য ইউএনবি থেকে নেওয়া হয়েছে।)

ভয়েস অব আমেরিকা বাংলা

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024