রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যে আরেকটি নতুন যুগ সৃষ্টি হয়েছিলো। ভাষাকে মানুষের মুখের ভাষার কাছে নিয়ে আসা নয়, সাহিত্যে’র বিষয়ও হয়েছিলো অনেক বিস্তৃত। সাহিত্যে উঠে এসেছিলো পরিবর্তিত মন ও সমাজের নানান প্রাঙ্গন। সময়ের পথ ধরে সে যুগটি এখন নিকট অতীত। আর সে সাহিত্যও চিরায়ত সাহিত্য। দূর অতীত ও নিকট অতীতের সকল চিরায়ত সাহিত্য মানুষকে সব সময়ই পরিপূর্ণ মানুষ হতে সাহায্য করে। চিরায়ত সাহিত্যকে জানা ছাড়া বাস্তবে মানুষ তার নিজেকে সম্পূর্ণ জানতে পারে না।
সারাক্ষণের চিরায়ত সাহিত্য বিভাগে এবারে থাকছে মানিক বন্দোপধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য।
দিবারাত্রির কাব্যে’র ভূমিকায় মানিক বন্দোপধ্যায় নিজেই যা লিখেছিলেন …..
দিবারাত্রির কাব্য আমার একুশ বছর বয়সের রচনা। শুধু প্রেমকে ভিত্তি করে বই লেখার সাহস ওই বয়সেই থাকে। কয়েক বছর তাকে তোলা ছিল। অনেক পরিবর্তন করে গত বছর বঙ্গশ্রীতে প্রকাশ করি।
দিবারাত্রির কাব্য পড়তে বসে যদি কখনো মনে হয় বইখানা খাপছাড়া, অস্বাভাবিক,- তখন মনে রাখতে হবে এটি গল্পও নয় উপন্যাসও নয়, রূপক কাহিনী। রূপকের এ একটা নূতন রূপ। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের Projection-মানুষের এক এক টুকরো মানসিক অংশ।
দিবা রাত্রির কাব্য
মানিক বন্দোপাধ্যায়
আনন্দ সামনের দিকে তাকিয়ে নিরানন্দ স্বরে বলল, ‘তার মানে আমার জন্য খারাপ লাগছে? আচ্ছা লোক যাহোক আপনি!’
হেরম্ব অনুযোগ দিয়ে বলল, ‘আমার মন কত খারাপ হয়ে গেছে জানলে তুমি রাগ করতে না আনন্দ।’
আনন্দ বলল, ‘মন বুঝি খালি আপনারই খারাপ হতে জানে? সংসারে আর কারো বুঝি মন নেই? হেঁয়ালি করা সহজ। কারণ তাতে বিবেচনা থাকে না। লোকের মনে কষ্ট দেওয়া পাপ। এমনিতেই মানুষের মনে কত দুঃখ থাকে।’
আনন্দের অভিমানে হেরম্বের হাসি এল।
‘তোমার দুঃখ কিসের আনন্দ?’
‘আপনারই বা মন খারাপ হওয়া কিসের? চাঁদ উঠেছে, এমন হাওয়া দিচ্ছে, এখুনি প্রসাদ খেতে পাবেন, তারপর আমার নাচ দেখবার আশা করে থাকবেন-আপনারই তো ষোলো আনা সুখ। দুঃখ হতে পারে আমার। আমি এত মন্দ যে লোককে মিছিমিছি কখন শাস্তি দি, নিজে তা টেরও পাই না। আমার কাছে বসতে হলে লোকের এমনি বিশ্রী লাগে, আমি মিষ্টি মিষ্টি কথা বললেও। হু, আমার দুঃখের নাকি তুলনা আছে!’
হেরম্ব ভাবল, আজ নিজের কথা ভেবে লাভ নেই। নিজের কথা ভুল করে ভেবে এতদিন জীবনটা অপচয়িত হয়ে গেছে, এখন নির্ভুল করে ভাবতে গেলেও আজ রাত্রিটা তাই যাবে। আনন্দের অমৃতকে আত্মবিশ্লেষণের বিষে
নষ্ট করে আগামীকালের অনুশোচনা বাড়ানো সঙ্গত হবে না।
‘খারাপ লাগছে কেন জান?’
‘কি করে জানব? বলেছেন?’ আনন্দ আশান্বিত হয়ে উঠল।
‘তোমার কাছে বসে আছি বলে যে খারাপ লাগছে একথা মিথ্যে নয় আনন্দ।’
‘তা জানি।’
‘কিন্তু কেন জান?’
আনন্দ রেগে বলল, ‘জানি জানি। আমার সব জানা আছে। কেবল জান জান করে একটা কথাই একশোবার শোনাবেন তো!’
‘একটা কথা একশোবার আমি কারুকেই শোনাই না। এমন কথা শোনাব, কখনো তুমি যা শোননি।’
‘থাক। না শুনলেও আমার চলবে। আপনি অনেক কথা বলেছেন, ফুসফুস হয়তো আপনার ব্যখা হয়ে গেছে। এইবার একটু চুপ করে বসুন।’ ‘আর তা হয় না আনন্দ। তোমাকে শুনতেই হবে। তোমার কাছে বসে আমার মনে হচ্ছে এতকাল তোমার সঙ্গে কেন আমার পরিচয় ছিল না?
তাই খারাপ লাগছে।’
আনন্দের নালিশ করবার পর থেকে বিনা পরামর্শেই তাদের গলা নীচু হয়ে গিয়েছিল। নিজের কথা নিজের কানেই যেন শোনা চলবে না।
হেরম্ব নয়, সে-ই যেন মিথ্যা কথা বলেছে এমনিভাবে আনন্দ বলল, ‘আপনি এমন বানিয়ে বলতে পারেন!’
আরতি শেষ করে আনন্দ আজ মন্দিরে নাচবে না শুনে মালতী মন্দিরের দরজায় তালা দিল।
‘এসে থেকে ঠায় বসে আছ সিঁড়িতে। ঘরে চলো হেরম্ব। তুই এই বেলা কিছু খেয়ে নেনা আনন্দ?’
বাড়ির দিকে চলতে আরম্ভ করে আনন্দ বলল, ‘প্রসাদ খেলাম যে?’
‘প্রসাদ আবার খাওয়া কিলো ছুড়ি? আর কিছু খা। নাচবেন বলে মেয়ে আমার খাবেন না, ভারি নাচনেউলি হয়েছেন।’
আনন্দ তাকে ভয় দেখিয়ে বলল, ‘শোন মা, শোন। আজ যদি আমায় বক, সেদিনের মতো হবে কিন্তু।’
হেরম্ব দেখে বিস্মিত হল যে, একথায় মালতী সত্য সত্যই ভড়কে গেল।
‘কে তোকে বকছে বাবু! শুধু বলেছি কিছু খা। খেতে বলাও দোষ?’
হেরম্ব জিজ্ঞাসা করল, ‘সেদিন কি হয়েছিল?’
আনন্দ বলল, ‘বোলো না মা।’
মালতী বলল, ‘আমি একটু বকেছিলাম। বলেছিলাম, উপোস করে থাকলে নাচতে পারবি না আনন্দ। এই শুধু বলেছি, আর কিছুই নয়। যেই বলা-‘
আনন্দ বলল, ‘যেই বলা! কতক্ষণ ধরে বকেছিলে মনে নেই বুঝি?’ মালতী বলল, ‘হ্যারে হ্যাঁ, তোকে আমি সারাদিন ধরে শুধু বকেছি।
খেয়ে-দেয়ে আমার আর কাজ নেই। তারপর মেয়ে আমার কি করল জান হেরম্ব? কান্না আরম্ভ করে দিল। সে কি কান্না হেরম্ব, বাপের জন্মে আমি অমন কান্না দেখিনি। কিছুতেই কি থামে! লুটিয়ে লুটিয়ে মেয়ে আমার কাঁদছে তো কাঁদছেই। আমরা শেষে ভয় পেয়ে গেলাম। আমি আদর করি, উনি এসে কত বোঝান, মেয়ের কান্না তবু থামে না। দু’জনে আমরা হিমসিম খেয়ে গেলাম!’
হেরম্ব ফিসফিস করে মালতীকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আনন্দ পাগল নয় তো, মালতী-বৌদি?’
‘কি জানি। ওকেই জিজ্ঞেস কর।’
আনন্দ কিছুমাত্র লজ্জা পেয়েছে বলে মনে হল না। সপ্রতিভভাবেই সে বলল, ‘পাগল বই কি! আমি অভিনয় করেছিলাম, মজা দেখেছিলাম।’
Leave a Reply