প্রবল বৃষ্টি’র জল সারি সারি তাবুর চারপাশ ডুবিয়ে বয়ে যাচ্ছে।
ভিজে যাচ্ছে তাবুর ভেতরে বিছানো খড় কুটোর ওপর পাতা কম্বল। কখনো কখনো ভিজে যাচ্ছে ওই কম্বলের ওপর শুয়ে থাকা মানব শিশু নামের অদ্ভূত আকৃতির কিছু শিশুর শরীর।
তাবুর আলো আধারির মধ্যে একটু সুর্যের আলো নিতে পারলে বা অন্য কোন আরো ফেললে দেখা যেতো, নানান গুটিকায় ভরা চামড়ার নিচের হাড়গুলো দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে বুকের ভেতরে থাকা হৃদযন্ত্রটির ওঠানামা। হৃদযন্ত্রটি ওঠানামা করলেও নিস্তেজ হয়ে শুয়ে আছে শিশুটি, শান্ত নয় বলে, জ্বরে তাকে অমনি প্রায় অচেতন করে রেখেছে। এমন দৃশ্যছিলো গোটা বর্ষাকাল জুড়ে প্রতিটি তাবুতে।
আর অক্টোবরের শেষ বা নভেম্বর জুড়ে প্রতিটি তাবুর সামনে রোদে একটা ময়লা কাপড়ে শুইয়ে বা বসিয়ে রাখা হয়েছে অমনি মানব শিশু -যারা হারিয়ে ফেলেছে মানবাকৃতির প্রায় সবটুকু।
এপ্রিল থেকে শুরু হলেও জুন থেকে ডিসেম্বর অবধি এই ছিলো মোটা দাগে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, মেঘালয়, আসাম, ত্রিপুরা, মধ্যপ্রদেশ, উত্তর প্রদেশ এবং আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে বাংলাদেশের শরণার্থী শিশুদের চিত্র। এর সঙ্গে আরো বাড়তি একটু যোগ হতে পারে গ্রীষ্মের খরতাপের সময় মধ্যপ্রদেশ ও উত্তর প্রদেশের তাবুর শিশুদের শরীরে ভেতর ও বাইরের তাপের যন্ত্রনা।
কত শিশু সেদিন মারা গিয়েছিলো তার সঠিক হিসেব নেই। করাও হয়নি। ইউনিসেফ ও কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা অক্টোবর অবধি মোটা দাগে একটা হিসেবে করেছিলো তখন- তাতে বলা হয়েছিলো সংখ্যা আট লাখের বেশি হবে।
আমেরিকার সিনেটর জন এফ কেনেডির ওই শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের সময় এএফপি’র রিপোর্টার লিখেছিলেন, অবিলম্বে বাড়তি খাবার না এলে পৃথিবীর সব থেকে বড় শিশু হত্যার মহাযজ্ঞ হবে ভারতের এই শরণার্থী শিবির। না, সেদিন পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে খুব বেশি কোন বাড়তি খাবার আসেনি। সেদিনের দরিদ্র ভারত আর ভারতের দরিদ্র জনগোষ্টি যতটুকু পারে তাই দিয়েছিলো শুধু।
এ জন্যে বাস্তবতাকে স্বীকার করে এএফপির রিপোর্টার লিখেছিলেন, যদি এখানে বাড়তি খাবার এবং প্রকৃত চিকিৎসার ব্যবস্তা না করা হয়- তাহলে এই শিশু মৃত্যু’র চিত্র হিরোশিমা বা নাগাসাকির থেকেও ভয়াবহ হবে।
হিরোহিমা বা নাগাসাকিতে একটি শিশু’র শরীর গলে যেতে বা একটি শিশুকে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে সময় লেগেছিলো কয়েক ঘন্টা। আর সেদিনের ভারতে এই বাংলাদেশের শিশুরা কয়েক মাস, কয়েক সপ্তাহ তীব্র যন্ত্রনা সহ্য করেই মারা গিয়েছিলো।
পৃথিবীতে সব সময়্ই মৃত্যু অতি স্বাভাবিক বিষয়। বিশেষ করে সে মৃত্যু যদি হয় সাধারনের। যারা শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছিলেন তারা তো সাধারণই। তাই সে সব নাম না জানা লাখ লাখ শিশুর মৃত্যু প্রবাহমান পৃথিবী’র স্বাভাবিক গতির সঙ্গে হারিয়ে গেছে। এমনকি হারিয়ে গেছে বাঙালির মন থেকেও । কোন দিন কোন অবকাশেও একবার স্মরণ হয় না ওই শিশুরা। তারা এখন শুধু একটি “সংখ্যা”- কোন কোন দিবসের নানান বক্তব্যে। অথচ একটি রাষ্ট্র তৈরির জন্যে লাখ লাখ শিশু সমুদ্রের কূলের গাছের অনেক কুড়ি যেমন ফোটার আগেই সমুদ্র বক্ষে ঝরে পড়ে তেমনি তারাও ধরিত্রি মাতার গর্ভে চলে গিয়েছিলো। সমুদ্রের ঢেউ ভরা জল তার তীরের গাছের না ফোটা মুকুলগুলোকে অনেকটা পথ বয়ে নিয়ে যায়। অথচ রাষ্ট্র নামক সমুদ্র কতটুকু বুকে রেখেছে না ফোটা ওই মানব মুকুলগুলোকে- তা জানে না কেউ।
আজ পঁচিশে মার্চ- গণহত্যা দিবস। এ দিবসে এই রাষ্ট্র তৈরির যুদ্ধে তিলে তিলে জীবন দেয়া সাধারণ শরণার্থী শিশুরা কেবলই সংখ্যা। এমনকি আজ তাদের মায়েরাও নেই যে নিভৃতে দুফোঁটা চোখের জল ফেলবে তাদের জন্যে। অথচ ওদের মৃতদেহ ঠিকই গড়ে দিয়েছে রাষ্ট্রের বেদিমূল।
Leave a Reply