কোনো ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেনি। যদিও এই মুনাফার ওপর ভর করে কিন্তু শহরভিত্তিক একটা বাণিজ্যিক পুঁজিপতি শ্রেণী তৈরি হয়েছিল।
১৭৯০ সালের দশকে ইউরোপে বিদ্যমান নেপোলিয়নীয় যুদ্ধের দামামায় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে বাংলার রপ্তানিবাণিজ্য মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৮১৩ সালে অবাধ বাণিজ্যনীতিতে বাংলার বস্ত্র রপ্তানি প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ১৮২০-এর দশকে ইউরোপ থেকে বস্ত্র আমদানি শুরু হয়। খুব স্বল্প সময়ের এই রপ্তানি পতনে তাঁত শিল্পের সঙ্গে জড়িত তাঁতি সম্প্রদায় ছাড়াও বেনিয়া, আড়তদার, পাইকাররা বেকার হয়ে পড়ে।
এ-সময়ে রপ্তানি বাণিজ্য থেকে যে-বিপুল অর্থ বাংলায় অনুপ্রবেশ করেছিল, সেই পুঁজি চলে আসে ভূমি নিয়ন্ত্রণে। নবাগত ভূস্বামী ও জমিদার শ্রেণীটি তাদের অর্জিত পুঁজির সামান্য অংশ ব্যয় করেছিলেন ভূমি ক্রয়ে বাকি পুঁজি উজাড় হয়েছে রাজ্যের অনুৎপাদনশীল খাতে, যেমন বিবাহ, শ্রাদ্ধ, পূজা-পার্বণ, মন্দির, ঘাট, পুকুর, প্রাসাদ প্রভৃতি নির্মাণে। পুঁজির আরেক অংশ চলে আসে মহাজনি ঋণদান ও শস্যব্যবসায়।
বাংলার তৎকালীন অর্থনৈতিক-সামাজিক অবস্থা পর্যালোচনা করলে সবচেয়ে বড় যে-সত্যটি আবিষ্কার করি আমরা, সেই সময়ের ধনীদের মনোভাব ছিল সামন্তবাদী, পুঁজিপতিদের মতো নয়।
সমান্তরালভাবে, আঠারোশো শতকের শুরুতে তুলার চাহিদা হ্রাস পাওয়া শুরু করলে তার জায়গা নেয় নীল চাষ। আবার ১৮৫০ সালের দিকে কমতে থাকে নীলের চাহিদা। নীলচাষীদের সংগঠিত প্রতিরোধের মুখে ইউরোপীয় নীলকররা বিনিয়োগ তুলে নেয়। উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত পাটচাষ নগণ্য ছিল। ব্যাপক হারে পাটচাষ এবং পাট-আঁশের বাণিজ্যিকীকরণ শুরু হয়ে ১৮৭০-এর দশকে। এই সময় থেকে শুরু করে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত পাটের স্বর্ণযুগ। ১৯৩০-এর বিশ্বমন্দাতে পাটের বাজার পুরোপুরি ধসে পড়ে।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ও আধুনিক পুঁজিবাদের চাপে বাংলার অর্থনীতি ক্ষয়িষ্ণু হতে থাকে। এক বিকৃত ঔপনিবেশিক অর্থনীতি তৈরি হয়, যার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, স্থবিরতা, দারিদ্র্য, বৈষম্য, ঘনঘন দুর্ভিক্ষ ও পুষ্টিহীনতা। এই অর্থনীতিই ছিল পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের উত্তরাধিকার। এর সঙ্গে যুক্ত হয় পশ্চিম পাকিস্তানের বিমাতাসুলভ কেন্দ্রীয় নীতি। ১৯৫১ সালের আদমশুমারিমতে পূর্ব বাংলার জনসংখ্যা ছিল চার কোটি ১৯ লক্ষ ৩২ হাজার। এর মাঝে ৬৪টি মহকুমা শহরের অধিবাসী
ছিল মাত্র ১৮ লক্ষ ২০ হাজার। শহরের জনসংখ্যা ছিল মোট জনসংখ্যার ৪.৩ শতাংশ; মূলত তদানীন্তন পূর্ব বাংলা ছিল গ্রামীণ অর্থনীতির। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে পূর্ব বাংলায় খাজনাভোগী কাঠামো গড়ে ওঠে। ছোট আকারের ভূসম্পত্তির মালিক ও একই সঙ্গে ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণী, যারা অবাণিজ্যিক পেশায় নিয়োজিত হয়। একই পরিবারে খাজনাভোগী জমিদার ও চাকরিজীবী উভয় ভূমিকায় থাকতে দেখা যায়।
দেশভাগের পরে ক্ষুদ্র ও মাঝারি বুর্জোয়া হিসেবে মুসলমানেরা ছিল অত্যল্প। এই অর্থনৈতিক দুর্বলতা ঐতিহাসিক কারণে সৃষ্ট সামাজিক উৎপাদনে শ্রমবিভাগেরই ফল। বাঙালি মুসলমান ঐতিহ্যগতভাবে কৃষিকাজ ও হস্তশিল্পের ধারক ও বাহক। আর বাঙালি হিন্দুরাই মূলত ব্যবসা-বাণিজ্য, মহাজনি কারবার নিয়ন্ত্রণ করত। এমনকি ছোট ছোট শিল্পোৎপাদনেও এদের দখল বেশি ছিল। দেশভাগের পরে বহুসংখ্যক হিন্দু মহাজন ও ব্যবসায়ীর বিপুল অর্থসম্পদসহ দেশত্যাগের কারণে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও মাঝারি বুর্জোয়াদের অবস্থানে শূন্যতা তৈরি হয়। ১৯৪৭ থেকে ‘৫১ সালে এই শূন্যতার সুযোগে পশ্চিম পাকিস্তানি বুর্জোয়া ব্যবসায়ী শিল্পোদ্যোগীরা এবং প্রবল সহযোগী হিসেবে কমার্শিয়াল ব্যাংকগুলো জেঁকে বসে।
সর্বভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে পাকিস্তানে যে-শিল্পায়ন হয় তার সিংহভাগ শহরকেন্দ্রিক। সমগ্র পাকিস্তানে এ-সময় একচেটিয়া পুঁজিপতি পরিবারের জন্ম হয়। ১৯৬২ সালে সারা পাকিস্তানের ব্যক্তিমালিকানাধীন ফার্মের অধীনে মোট যত সম্পদ ছিল তার ৭৩ শতাংশ ছিল ৪৩টি পরিবারের দখলে। এই ৪৩টি পরিবারের মধ্যে একটি মাত্র পরিবার ছিল বাঙালি পরিবার। এ.কে. খানের
দেশভাগের পর পূর্ব বাংলায় ব্যবসায়িক ও লগ্নি পুঁজিকেই কৃষিতে মূলধন সঞ্চয়ের গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে ধরা হয়। যদিও এখান থেকে মুনাফার সামান্য অংশই উৎপাদনে পুনঃবিনিয়োগ করা হতো। সংগঠিত কৃষিঋণ অপ্রচলিত ও অজনপ্রিয় ছিল, কারণ প্রচলিত কৃষি আইনে জমি হস্তান্তর বা খণ্ডকরণের সীমাবদ্ধতার জন্য ঋণদানকারী সংস্থাগুলো জমি বন্ধক রেখে ঋণদানে আগ্রহ দেখাত না। ফলে মহাজনি ঋণের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য হতো কৃষক। ঋণদাতা জমির স্বত্ব লাভ করে, অনেক সময় বন্ধকি জমির ফসল থেকেই ঋণ শোধ হয়ে গেলে, মূল মালিকের কাছে জমি ফেরত যায়। আবার জমির মালিকের অধীনে চাষবাস হয়, উৎপাদিত ফসলের অর্ধেক ঋণদাতাকে ঋণকিস্তি হিসেবে দিতে হয়। মহাজনি ঋণ পাওয়ার জন্য কৃষক যে-কোনো শর্তেই রাজি হতে বাধ্য থাকত। আর ঋণের বেশিরভাগ অংশই ব্যয় হতো নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য, কাপড়-চোপড়, ওষুধপথ্যের মতো অত্যাবশ্যকীয় কাজে। যে-কাজের জন্য ঋণ নেওয়া হয়েছে হালের বলদ, বীজ, সার তার জন্য সামান্য অংশই অবশিষ্ট থাকত। এই দুষ্টচক্রে পড়ে কৃষক ভূমিহীন হতো। ভূস্বামী মহাজনেরাও জমিতে অর্থ না খাটিয়ে নগদ ঋণদানেই আগ্রহী ছিল। জরিপে দেখা যায়, পূর্ব পাকিস্তানে ৬৬ থেকে ৮৭ শতাংশ পরিবারই ঋণগ্রস্ত ছিল। তৎকালীন বিশ্বের তুলনায় উচ্চফলনশীল বীজ, রাসায়নিক সারের ব্যবহারে পিছিয়ে থাকায় জমির উৎপাদনক্ষমতা ছিল অনেক কম। জমির স্বল্পতা ও বিক্ষিপ্ত অবস্থান পুরো কৃষি উৎপাদনের চক্রকে অনাধুনিক করে রেখেছিল।
পূর্ব পাকিস্তানে কৃষক পরিবারের ধনী হওয়ার মূল বাসনা ছিল সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষা। ধন-সম্পদ, পরিবারের শিক্ষা-দীক্ষা, সম্মান, উচ্চবংশে বৈবাহিক আত্মীয়তা সামাজিক মর্যাদার মাপকাঠি। সঞ্চিত অর্থে জমি কিনে মর্যাদা বৃদ্ধির একটা স্বাভাবিক প্রবণতা ছিল সমাজে। আবার জমির পাশাপাশি সামাজিক মর্যাদা এবং আর্থিক সচ্ছলতার উৎস হিসেবে দ্বিতীয় প্রধান সম্পদ ধরা হয় শিক্ষাকে। শিক্ষিত লোক স্থানীয় প্রশাসনে, শহরে চাকরি করে পরিবারের সম্পদ বৃদ্ধি করে।
দেশভাগের পরে পূর্ব বাংলার উৎপন্ন পাট কলকাতার পাটকলে রপ্তানি হওয়ার যে- নিয়ম প্রচলিত ছিল তা ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হতে থাকে। সরকার-নির্ধারিত পাটের ক্রয়মূল্যের চেয়ে রপ্তানিতে লাভ বেশি হয়, মুনাফা বাড়ে। পাটশিল্পের বড় ধরনের পুঁজি বিনিয়োগকারীদের অনেকেরই বৈদেশিক বাণিজ্যের অভিজ্ঞতা ছিল, যেমন আদমজী, বাওয়ানী, ইস্পাহানী। ‘ক্রিসেন্ট জুট মিলস লি’-এর পরিচালনার দায়িত্বে ছিল র্যালি ব্রাদার্স ও ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়ের খোজা গোষ্ঠী। শুরু থেকেই মুসলিম মেমন সম্প্রদায় (আদমজী, বাওয়ানী) এবং ইসমাইলিয়া খোজা প্রধান পাট রপ্তানিকারক ও বিনিয়োগকারী হিসেবে দেখা দেয়।
পূর্ব বাংলা এমনিতেই পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় শিল্পশক্তি ও অবকাঠামোতে পিছিয়ে ছিল। ব্যাংকিং ছিল অনুন্নত। মূলত পাকিস্তানের অভ্যুদয়ের শুরুর দিকে সরকার ও রাষ্ট্রীয় প্রশাসনই ছিল দেশের অর্থনৈতিক উদ্যোগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। সেই উদ্যোগ আবার পরিচালিত হতো প্রধানত পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বিকাশেই। যেহেতু ১৯৪৭-এর পরে পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পভিত্তি ছিল অনেক শক্তিশালী, পূর্ব বাংলার তুলনায় শিল্পোৎপাদন, বৃহৎ পুঁজি, অবকাঠামো, বাজেটের সিংহভাগ আঞ্চলিক বৈষম্যকে প্রকট করে তোলে। কারণ এখানে মুদ্রা সঞ্চয় এবং পুঁজি বিনিয়োগ দুই ক্ষেত্রেই পশ্চিম পাকিস্তান এগিয়ে থাকে। জমির স্বল্পতা এবং শিল্পাঞ্চলে তার উচ্চমূল্য পূর্ব পাকিস্তানে পুঁজি বিনিয়োগের অন্যতম প্রতিবন্ধকতা। সেই দিকে বেশির ভাগ বাঙালি পুঁজিপতিই ছিল ছোট বা মাঝারি। অনগ্রসর অর্থনৈতিক কাঠামোতে সঞ্চয়ের সিংহভাগ আসত কৃষিখাত এবং ক্ষুদ্র শিল্পখাত থেকে।
১৯৫০-৫২ সালের কোরিয়া যুদ্ধে পাট ও পাটজাত পণ্যের ভারতমুখী প্রবণতা কমে বিদেশি বাজারে চাহিদা বেড়ে যায়। কিন্তু কোরিয়ান যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলে পাকিস্তানের পাট ও তুলার রপ্তানি বাজারের আকাল দেখা দেয়। কাঁচামালের দাম যায় কমে। এর মাঝে তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পূর্ব পাকিস্তানে ৩৬টি নতুন পাটকল স্থাপিত হয়, কাঁচামাল হিসেবে পাটের ব্যবহার বৃদ্ধি পায়। কিন্তু পাটের উৎপাদন ৬৫০ হাজার টনের মধ্যে রয়ে যায়। ফলে অভ্যন্তরীণ চাহিদার প্রাধান্য দিতে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তান পাটবাজারের বিশ্ববাজার হারায়। সামগ্রিকভাবে পূর্ব পাকিস্তানের নির্ভরতা এমন ছিল যে, পাটকলের যন্ত্রাংশ বড় কারখানাগুলোর মেকানিক্যাল ওয়ার্কশপে তৈরি হতো। আদমজী পাটকল, প্লাটিনাম জুবিলি এবং আরো কয়েকটি পাটকলের এ-ধরনের ওয়ার্কশপ ছিল; কিন্তু কারখানাগুলোর মালিক ছিল অবাঙালি বুর্জোয়ারা। সাধারণ বয়নশিল্প বা টেক্সটাইল শিল্পেরও একই অবস্থা, যন্ত্রাংশ নির্মাণের দশটি কারখানার আটটিই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। আদমজী, বাওয়ানী, ইস্পাহানী, আমিন গ্রুপ, খোজা ইসমাইলিরা ছাড়াও হাবিব পরিবার, দাউদ পরিবার, দাদা পরিবার, সায়গল পরিবার, মোহাম্মদ বশীর পরিবার, কলোনি গ্রুপ, নবাব হেতি পরিবার, মাওলা বক্স পরিবার, সাত্তার পরিবার। পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতিতে আরো উল্লেখযোগ্য গ্রুপগুলো হচ্ছে রশিদ এজেন্সিজ, গুল এজেন্সিজ ও গ্লোব এজেন্সিজ নামে পশ্চিম পাকিস্তানি কোম্পানির সম্মিলিত গ্রুপ।
ধনী বাঙালি বুর্জোয়াদের উদ্ভব ঘটেছিল অসম প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে। পাকিস্তানি বৃহৎ পুঁজিপতিদের তুলনায় বাঙালি মুসলমান বুর্জোয়ারা সাংগঠনিক ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল। তাছাড়া ঐতিহ্যগতভাবে বাঙালি বুর্জোয়ারা পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষ উৎসাহী ছিল না। এরা ব্যবসায়ের মধ্যস্থতা, সুদের কারবার ও জমির মালিকানাকেই প্রাধান্য দিত। যৎসামান্য বাঙালি বুর্জোয়ার অধিকাংশই ছিল শিল্প-বাণিজ্য বুর্জোয়া। সামান্য কিছু শিল্পোৎপাদনে তারা জড়িত ছিল মূলত পাট, সুতা-বস্ত্র, কাগজ, ইট ও দিয়াশলাইয়ের মতো শিল্পে সীমাবদ্ধ। যেমন ১৯৭১ সালের তথ্য অনুযায়ী বাঙালি মালিকানাধীন ৩৪টি পাটকলের ২৮টিই কাজ শুরু করেছিল ষাটের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে এবং মালিকানার অংশীদার বাঙালি মালিকদের অভিজ্ঞতা ছিল কম, এরা পূর্বে কোনো শিল্পোৎপাদনের সঙ্গে জড়িত ছিল না।
ব্যক্তি পর্যায়ে নিজেদের পুঁজি দিয়ে তারা শিল্পে অংশগ্রহণ করত না বললেই চলে। এ-ধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো হয় সরকারি করপোরেশনের অধীনে ছিল, অথবা গুটিকয়েক অবাঙালি পরিবারের মালিকানাধীন। বাঙালিদের বিনিয়োগের অধিকাংশই ছিল ঋণপুঁজি। অংশীদারিত্বের মোট মূল্যের ৬০ শতাংশই ছিল ঋণপুঁজি। ১৯৬২-৬৩ সাল থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বাঙালি শিল্পোদ্যোক্তাদের একটা ৬৩ সাল থেতেরির নীতি কাজ করতে শুরু করে। যদিও পূর্ব পাকিস্তানে শুধু ২২ এলিটারের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া বৃহৎ ব্যবসায়ের সংস্পর্শে আসা প্রায় অসম্ভব ছিল।
১৯৭১ সালের জরিপ অনুযায়ী, বস্ত্রশিল্পে ৪৫টি চালু শিল্প প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২৪টি ছিল বাঙালি অংশীদারিত্বের। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এ.কে. খান, ইসলাম ছিল বা আফিল, ফকিরচান্দ, হাওলাদার, বি রহমান, রহমান-কাউয়ুম, সাত্তার, আলহাজ মুসলিমউদ্দিন ও ফিল্স মাশরিকি। লক্ষণীয়, বাঙালি শিল্পোদ্যোক্তাদের আলহাঋণের প্রচুর ব্যবহার তাদের অবশ্যম্ভাবী ঋণীতে পর্যবসিত করেছে। ব্যাংকাংশ বাঙালি কোম্পানি বা গ্রুপের অর্থনৈতিক ক্ষমতা তাদের সক্রিয় পুঁজির অধিকাংশ কারে যা মনে হতো, বাস্তবিকপক্ষে তা ছিল তার থেকে অনেক কম। আশির দশকে গার্মেন্টস শিল্পের ক্ষেত্রেও সেই একই ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে আমাদের শিল্পপতিরা।
পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি ব্যবসায়ীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন এ.কে. খান (আবুল কাশেম খান); ইসলাম গ্রুপ (জহুরুল ইসলাম); ভূঁইয়া বা গাওসিয়া গ্রুপ (আলহাজ গুলবক্স ভূঁইয়া), রহমান কাইউম গ্রুপ (মকবুল রহমান, কাজী জহিরুল কাইউম), ফকির চাঁদ গ্রুপ (আলহাজ মোহাম্মদ ফকির চাঁদ), আলহাজ মুসলিমউদ্দিন গ্রুপ, নর্দান পিপলস, আফিল গ্রুপ, রহমান ব্রাদার্স, সাত্তার গ্রুপ, আশরাফ গ্রুপ, ভাণ্ডারি গ্রুপ, ডেলটা, সবদার আলী, আনোয়ার নিউ স্টার, ইব্রাহিম মিয়া অ্যান্ড সন্স।
বাংলাদেশের ধনীদের মোটা দাগে তিন ভাগে ভাগ করা যায় প্রথম ভাগে আছে পারিবারিকভাবে যারা ব্যবসায়ী ও শিল্পোদ্যোক্তা। ইস্পাহানী, ইসমাইলি, সওদাগর, সাহা গোত্রের লোক এই শ্রেণীতে। দ্বিতীয় শ্রেণীতে আছে রাজনৈতিক পরিবারগুলো। এদের কারো কারো পূর্বপুরুষ সরকারি কর্মকর্তা ছিলেন, সরকারের সকল সুবিধা নিয়ে নৈতিক-অনৈতিকভাবে ধনী হয়েছেন। কিন্তু রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হওয়ায় এদের শিল্পকারখানা ও স্থাবর সম্পত্তি হাতবদল হয়েছে। এদের অনেকেই কয়েক দশকের বেশি টিকে থাকতে পারেননি। তৃতীয় শ্রেণীতে আছেন তারা যারা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে শুধু উদ্যোগ ও পরিশ্রমের মাধ্যমে নিজের যোগ্যতায় বিশাল শিল্প-কলকারখানা ও সাম্রাজ্য গড়েছেন। আধুনিক বাংলাদেশে এরাই বৃহত্তম। পূর্বাপর ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিশেষ কিছু অভূতপূর্ব সুযোগ এদের ধনসম্পদ বাড়াতে সাহায্য করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ একটা শ্রেণীকে ধনী করেছে। পাকিস্তানের অভ্যুদয় আরেক শ্রেণীকে। আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর অবারিত মুক্তবাজার অর্থনীতি, পুঁজিবাদের অবাধ বিচরণক্ষেত্র, বৈদেশিক সাহায্য সবচেয়ে বড় অংশকে ধনী করেছে। বৈদেশিক মুদ্রা, ব্যাংক ঋণ,আমদানি-রপ্তানি প্রাথমিক পর্যায়ে সরকার নিয়ন্ত্রিত ছিল বলে সরকারি কর্মচারী ও রাজনৈতিক ক্ষমতাবানদের নব্য ধনী হওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়। নব্য ধনীদের অনেকেই দেশে টিকে গেছেন, কিন্তু অনোপার্জিত অর্থের ওপর গড়ে ওঠা শিল্প- কলকারখানা অনেকেই ধরে রাখতে পারেননি।
বাংলাদেশের ধনীদের কিছু সাধারণ সাদৃশ্য চোখে পড়ে। এরা সকলেই বুদ্ধিমান, সাহসী পরিশ্রমী এবং সুদূরপ্রসারী চিন্তার অধিকারী। প্রথমদিকের ধনীরা ধর্মভীরু সাধারণ বাঙালি। সকলেই ভাগ্যে বিশ্বাসী, ধার্মিক এবং ক্ষেত্রবিশেষে অনেকে নানা ধরনের পীর-ফকিরের ক্ষমতায়ও বিশ্বাসী।
আশির দশকে বাংলাদেশের রেডিমেড গার্মেন্টস সেক্টর গড়ে ওঠে। সস্তা শ্রম ও প্রাকৃতিকভাবে পানির প্রাচুর্য টেক্সটাইল ও গার্মেন্টস সেক্টরকে প্রসারিত করে। সরকার ও রাজনৈতিক অনুগ্রহভাজন ছাড়াও একেবারে শূন্য থেকে শিল্পোদ্যোক্তা একটি শ্রেণী গার্মেন্টস সেক্টরকে দাঁড় করিয়েছে। দুর্বিষহ আমলাতান্ত্রিক জটিলতার পরেও বাংলাদেশে এই নব্য ধনীদের শিল্পোদ্যোগে গড়ে উঠেছে অসংখ্য কলকারখানা। বিশাল এই জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানে সরকারের অবদান অতি সামান্য। বেসরকারিভাবে সংগঠিত এই কর্মসংস্থান আমাদের বিশ্ববাজারে মাথা উঁচু করেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই শ্রেণীটির বড় অংশ দুর্নীতি না করেই নিজেদের মেধা ও অমানুষিক পরিশ্রমে গার্মেন্টসপণ্য রপ্তানিতে বাংলাদেশকে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে দীর্ঘ কয়েক দশক পরিচিত করিয়েছে।
অন্যদিকে প্রতিবছর প্রবাস থেকে বৈদেশিক রেমিট্যান্স এনেছে যে নিম্নমধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠী, এরা মূলত তাদের পরিবারের শ্রেণী উত্তরণে নিয়ামকের মতো নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে। দেশের নিম্নবিত্ত শ্রেণীটি মধ্যপ্রাচ্যে ও ইউরোপের কয়েকটি দেশের শ্রমবাজার থেকে প্রতিবছর বিশাল অংকের রেমিট্যান্স নিয়ে এসেছে নিয়মিত। কিন্তু সেই উপার্জিত পুঁজি ও বিত্ত-ভূসম্পত্তি ক্রয় ও নানা ভোগবিলাসে ব্যয়িত হয়ে থাকে। প্রবাস থেকে আসা যথেচ্ছ পুঁজি দেশের শিল্পবিনিয়োগে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না; বরং মুদ্রাস্ফীতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অবশ্যই স্বাধীন বাংলাদেশের বিশাল নিম্নবিত্তদের বড় একটি অংশের মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে উত্তরণ ঘটেছে। শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের পাশাপাশি স্বল্পশিক্ষিত আরো একটি মধ্যবিত্ত সমাজ এখন দেশজুড়ে। পুরো পৃথিবী যখন পুঁজিবাদের চূড়ান্ত ফলন দেখতে পাচ্ছে, এই ভোগবাদী বস্তুতান্ত্রিক সমাজে ক্রয়ক্ষমতাসম্পন্ন বিশাল এই মধ্যবিত্তরা দেশের অর্থনীতির বিকাশে অবদান রাখছে বইকি।
বাংলাদেশের ধনীদের ভেতরে সামাজিক ও মানবিক কর্মকাণ্ডে অবদান রেখেছেন এমন দৃষ্টান্ত মাত্র হাতে গোনা কয়েকজনের। এঁদের মাঝে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন রণদা প্রসাদ সাহা। তিনি বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ববর্তী সময়ে খাদ্যশস্য ক্রয়ের চুক্তি পেয়ে বিশাল সম্পদের অধিকারী হন। একে একে পাটকল, ডকইয়ার্ড, বেঙ্গল রিভার সার্ভিস, পাওয়ার হাউজ, ট্যানারি ব্যবসা করেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষভাগে তাঁর সমস্ত ব্যবসা থেকে যে-আয় হয় তা দিয়ে একটি দাতব্য ট্রাস্ট গঠন করেন, যা কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট নামে সুবিখ্যাত। এছাড়া রয়েছে মির্জাপুরের কুমুদিনী হাসপাতাল, ভারতেশ্বরী হোমস, কুমুদিনী হাসপাতালের স্কুল অব নার্সিং, কুমুদিনী কলেজ, এস.কে হাইস্কুল, দেবেন্দ্র কলেজ ইত্যাদি। তাঁর মতো সংস্কারমুক্ত অসাম্প্রদায়িক ধনী বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরে হিন্দু জমিদারদের পূজা-পার্বণে যথেচ্ছ অপচয়ের পরও হাসপাতাল, বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় করে যাওয়ার প্রবণতা আমাদের সমাজকে এগিয়েছে। আধুনিক বাংলাদেশের ধনীদের মাঝে সামাজিক ও মানবিক খাতে অবদান রাখার কোনো প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় না। রাজস্ব প্রদানেও এদের বড় ধরনের অনীহা কাজ করে। বেশিরভাগ ধনী পরিবার ও শিল্প গ্রুপের সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে সুসম্পর্ক থাকে দেয়া-নেয়ার। ছোট উদ্যোক্তাদের ব্যাপারে রাজস্ব বিভাগ খড়গহস্ত থাকলেও বড় ধনীদের ব্যাপারে চরম ঔদাসীন্য দেখায়। সামাজিক দুর্নীতির কথা আগে পত্রিকা অথবা মিডিয়াতে আসার সম্ভাবনা ছিল। জনসচেতনতা ছিল। এখনকার নব্য ধনীদের নিজস্ব ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া থাকে। আরেকটি লক্ষণীয় ব্যাপার হচ্ছে, আশির দশকের আগে রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীর দূরত্ব ছিল। পরপর কয়েকটি সামরিক শাসনে জর্জরিত হতে হতে দেখা গেল, দেশের ব্যবসায়ী সমাজের একটি বড় অংশ রাজনীতিতে চলে এসেছে। গত কয়েকটি সংসদের সিংহভাগ সংসদ সদস্য ব্যবসায়ী পরিবারের এবং তাদের প্রত্যেকের চলমান শিল্প-কলকারখানা বিদ্যমান।
দেশের খ্যাতনামা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে এই মুহূর্তে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- এ কে খান গ্রুপ, বেক্সিমকো, স্কয়ার, আনোয়ার গ্রুপ, আকিজ গ্রুপ, রহিম-আফরোজ, প্রাণ আরএফএল, ইউনাইটেড গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, যমুনা গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ। দার্শনিকভাবে ধনী ও শিল্পোদ্যোক্তাদের মৌলিক প্রবণতা থাকে পুঁজি বাড়ানো, মুনাফা বৃদ্ধি করে জীবনের নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তা বাড়ানো। কিন্তু তাদের এই উদ্যোগের সাথে সাথে অর্থনৈতিক অবকাঠামো গড়ে ওঠে, সমাজের লাভ হয়, দেশের আর্থসামাজিক পরিবর্তন হয়। বাংলাদেশ এই ধনী সম্প্রদায়ের উদ্যোগে খাদ্য উৎপাদনে নিত্যনতুন প্রযুক্তির দেখা পেয়েছে। দেশের বস্ত্রশিল্পের সঙ্গে সঙ্গে ওষুধ শিল্পে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছি। বহু ক্ষেত্রে আমাদের আমদানি নির্ভরতা একেবারে কমে গেছে। আমরা হয়ে গেছি রপ্তানিমুখী দেশ। আমাদের বস্ত্রশিল্প, চামড়াশিল্প, কুটিরশিল্প, ওষুধশিল্প দিয়ে বিশ্ববাজারে আমাদের নাম পৌছে গেছে। বাংলাদেশের ধনী সম্প্রদায়ের প্রধানতম অবদান হচ্ছে কর্মসংস্থান। কর্মসংস্থানের ফলে একটা উদীয়মান জাতির কর্মক্ষমতা বেড়েছে, গার্মেন্টস সেক্টর প্রসারে নারীশিক্ষা ও নারী স্বাধীনতা বেড়েছে এবং শিল্পোদ্যোক্তা এই ধনীদের অবদানে বাংলাদেশ আজ উন্নত দেশের তালিকাভুক্তির জন্য অপেক্ষমাণ। কিন্তু সামাজিক ও মানবিক ক্ষেত্রে এদের অবদান অর্থনৈতিক সক্ষমতার তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল এবং অকিঞ্চিৎকর।
রেফারেন্স
১। পূর্ব বাংলা: অর্থনৈতিক উন্নয়নের বৈশিষ্ট্য (১৯৪৭-১৯৭১)। এস এস বারানভ। সাহিত্যপ্রকাশ। জুলাই ১৯৮৬।
২। বাংলাদেশের কয়েকজন শিল্পোদ্যোগীর জীবনকাহিনী। সম্পাদনা: আবদুল্লাহ ফারুক। ব্যবসায় গবেষণা সংস্থা। সেপ্টেম্বর ১৯৮৪।
৩। বাংলাদেশের ইতিহাস ১৭০৪-১৯৭১; ১ম খণ্ড রাজনৈতিক ইতিহাস; ২য় খণ্ড অর্থনৈতিক ইতিহাস; ৩য় খণ্ড সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস। সম্পাদক: অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম। মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রা. লি., ডিসেম্বর ১৯৯৩।
৪। দৈনিক পত্রিকা ও অনলাইন গবেষণা।
লেখক পরিচিতি: মোহাম্মদ জাহিদুর রহমান
টেক্সটাইল প্রকৌশলী। শিল্পকারখানায় কর্মজীবন শুরু করে দীর্ঘ কয়েক দশক বাংলাদেশের অন্যতম রপ্তানিমুখী গার্মেন্টস ও টেক্সটাইল শিল্পে জড়িত আছেন। সাহিত্যরসিক এই লেখক ব্লগ ও অনলাইন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করেন।
Leave a Reply