-মোহাম্মদ মাহমুদুজ্জামান
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইটের নামে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।
রাজারবাগে স্থাপিত বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে রাখা এই ওয়্যারলেসেই পাকিস্তানি আর্মির আক্রমণের খবর জানানো হয়।
সাধারণ মানুষকে হত্যার পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পিলখানা ইপিআর এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনস ছিল তাদের অন্যতম টার্গেট।
রাজারবাগের পুলিশ সদস্যরা মধ্য মার্চ থেকেই পাকিস্তানের পতাকার বদলে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন শুরু করেন।
ফলে পুলিশ সদস্যদের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর ক্ষোভ ছিল চরমে। তারই সূত্র ধরে অন্তত আটশ সেনার বহর নিয়ে সাঁজোয়া যান, ট্যাংক ও ভারী অস্ত্র নিয়ে তারা রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে আসে।
বাঁশের বেড়ার তৈরি পুলিশ ব্যারিকেড থেকে কোনো ধরনের প্রতিরোধ তারা আশা করে নি। কিন্তু বাংলায় নিসার আলী তিতুমীর এক সময় বৃটিশদের বিরুদ্ধে বাঁশের কেল্লা তৈরি করে লড়াই করেছিলেন।
১৯৭১ সালে রাজারবাগ হয়ে ওঠে পুলিশের বাঁশের কেল্লা। অস্ত্র বলতে কিছু থ্রি নট থ্রি রাইফেল। এই নিয়েই অসীম সাহসে পুলিশ সদস্যরা বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন।
২৫ মার্চ রাতে এক পর্যায়ে রাজারবাগের পুলিশ সদস্যরা বুঝতে পারেন তাদের পাকিস্তানি আর্মি ঘিরে ফেলেছে। এর আগে তেজগাঁও পেট্রোল থেকে একটি মেসেজ রাজারবাগে আসে।
সেখানে লেখা ছিল, ‘ সার্কল-৭ ফর বেস, অ্যাবাউট ৩৭ ট্রাকস লোডেড উইথ পাক আর্মি প্রসেডিং টুয়ার্ডস ঢাকা সিটি।’
এই মেসেজ পেয়ে রাজারবাগের পুলিশের বেতার চালক মো. শাহজাহান মিয়া একটি জরুরি বার্তা সব পুলিশ লাইনে পাঠাতে থাকেন।
বার্তাটি ছিল: ‘বেস ফর অল স্টেশন অফ ইস্ট পাকিস্তান পুলিশ, কিপ লিসলিং, ওয়াচ, উই আর অলরেডি অ্যাটাকড বাই দি পাক আর্মি, ট্রাই টু সেভ ইওরসেলফ, ওভার।’
এই মেসেজ পেয়ে রাজশাহী, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, পাবনা, কুষ্টিয়াসহ বড় পুলিশ লাইনগুলোতে পুলিশ সদস্যরা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
ঢাকাতে রমনা থানা, কোতয়ালী থানা, বংশাল ফাঁড়ি, বাবুপুরা ফাঁড়ি, বাবুবাজার ফাড়িসহ বিভিন্ন স্থানে পুলিশ সদস্যগণ পাকিস্তানিদের প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। এসব প্রতিরোধে ঢাকায় ৭৮ জন পুলিশ সদস্য শহীদ হন।
অনেক পুলিশ সদস্য রাজারবাগ থেকে অস্ত্র নিয়ে বিভিন্ন স্থানে চলে যান। তারা এসব অস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহার করেন।
সারা দেশে অনন্ত চোদ্দ হাজার পুলিশ সদস্য কর্মক্ষেত্র ছেড়ে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। এগারো শ’য়ের বেশি সদস্য শহীদ হন।
আহত বা নির্যাতিত হন আরো অনেকে। অনেকে কর্মক্ষেত্রে থেকেও মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করেন।
পাকিস্তানি শাসকযন্ত্র ক্ষিপ্ত হয়ে ২৬ মার্চের পর বাঙালি ইন্সপেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ পদে তসলিম উদ্দিন আহমদকে সরিয়ে দিয়ে অবাঙালি মোজাফ্ফর আহমেদ চৌধুরীকে নিয়োগ দেয়।
পুলিশ সদস্যগণ মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তারা বিভিন্ন ক্যাম্পে অস্ত্র প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পান। পুলিশ সদস্যদের দৃঢ়তার পরিচয় পাওয়া যায় মুজিবনগর সরকারের পুলিশ প্রধান আবদুল খালেকের এক বাণী থেকে।
যুদ্ধ চলাকালে তিনি পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশ্যে লেখেন, “সাড়ে সাত কোটি নিরস্ত্র বাঙালি আজ মরিয়া হয়ে ইয়াহিয়া খানের সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।
আমরা বাংলাদেশের সন্তান, আমরা বাঙালি, আমরা বাংলাদেশের পুলিশ, আমরা মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের।
….আমরা এ কথাই মনে রাখবো যে, আমরা বাংলাদেশের সন্তান-বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রাম- আমাদের বাঁচার সংগ্রাম। আমরা লড়েছি সত্যের জন্য, ন্যায়ের জন্য। এই সংগ্রামে আমরা জয়ী হবই।”
লেখক: সাংবাদিক
Leave a Reply