শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৫:৫৬ পূর্বাহ্ন

নিক্সনের ক্ষমার অযোগ্য অপরাধের বিপরীতে ইন্দিরার নান্দনিক কূটনৈতিক প্রতিবাদ

  • Update Time : মঙ্গলবার, ২৬ মার্চ, ২০২৪, ১২.০১ এএম

 

ইন্দো-পাকিস্তান যুদ্ধের এক দশক পর Washington post- এ Jonathan Power কে দেয়া ইন্দিরা গান্ধির বিশেষ সাক্ষাৎকার-

Power : হিন্দু দর্শন কি যা বাইরের দেশে সবসময় নিস্ক্রিয় এবং প্রশ্নবিহীন হিসেবে বিবেচিত হয়।

বা এই হিন্দু দর্শন কি? যে আপনি এই মাত্র বললেন এমন যে ,বর্হিজগতের ধারনা অনুযায়ী চুপচাপশুধু নিস্ক্রিয় প্রশ্নবিহীন অনুগত ভক্ত হয়ে বসে থাকা ।

এটা এমন কিছু যা তোমার অন্তর থেকে তোমাকে শক্তি দেবে ।

আমরা যে কোন ক্ষেত্রে যতটুকু করা দরকার তা করি না, এমনটি আ্মেরিকানরা মনে করে। । তবে যে যাই মনে করুক না কেন, যুদ্ধের সময় যে অবস্থা আসুক না কেন আমাদের জন্যে সত্য হলো, তুমি অবশ্য এই অবস্থার মুখোমুখি দাঁড়াবে। তুমি তোমার সবকিছু দেবে । তোমারসর্বোচ্চ তুমি করবে, তারতাহলেই তুমি কিছু করতে পারবে।

Power: আপনি যখন মিঃনিক্সন এর সাথে কথা বলছিলেন, তখন তার অপ্রাসাঙ্গিক কথা আপনার জন্যে বিব্রতকর ছিলো।

Gandhi: আমি অপ্রাসাঙ্গিক কথা পছন্দ করি না । বিশ্বে অনেক মজার মজার ঘটনা ঘটে থাকেতবে সেগুলো গুরুত্বহীন নয়।

প্রেসিডেন্ট নিক্সন আসলে আদৌ ইন্ডিয়ার কী ঘটছে এ বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন কিনা বা তিনি ভারতবর্ষকে জানেন কিনা এটা আমি ঠিক বুঝতে পারেনি।

 

ইন্দিরা গান্ধী ও রির্চাড নিক্সন

 

Power: আমি জানি যে, আপনি একাধিক বিদেশ সফরের ফলে অবশ্য ক্লান্ত ছিলেন, কিন্তু এখন তার পরিবর্তে ডেইজী ফুলের মত তাজা এবং সবটুকু রিলাক্সড।

Gandhi: কারণ আমি একজন ইন্ডিয়ান , আমি সব কিছু বিশ্লেষণ করি।

Power: আমি জানি আপনার কথায় মিঃ নিক্সন বেশ নার্ভাস হয়েছিলেন ?

মিসেস গান্ধীর উওর ছিল টিপিক্যাল – তুমি petter seller এর film the “party” কথা জান? এইছায়াছবিতে petter seller একজন ইন্ডিয়ান। সে সবসময় এটা মনে রাখে। সে extremely বোকাকিন্তু খুবই জনপ্রিয় । এটা সব চলচ্চিত্র লোকদের মধ্যে ঘটে থাকে ।

ডিরেক্টর গরীব বালিকাকে বললো ,তুমি যদি আমার সঙ্গে বেডে যাও ,তাহলে তোমাকে নায়িকাবানাব বা তোমাকে পার্ট দিব।ডিরেক্টর জলদি seller কে ঝাপটে ধরে এবং বলে তুমি কি মনে করছো, তোমাকে কে কি মনে করবে?

Seller উওর দেয় – কেন আাম ইন্ডিয়ান। ইন্ডিয়ানরা জানে সে কে। তাই কে কি মনে করলো তা নিয়ে চিন্তা করে না।

 

বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে নেয়ার পর পাকিস্তানের বিভিন্ন পত্রিকায় এই ছবি ছাপানো হয়

 

প্রাইম মিনিষ্টার ইন্দিরা গান্ধী অক্টোবরের শেষের দিকে ইউরোপের বড় বড় রাজধানী গুলিতে সফরকরেছিলেন । সবখানে তিনি গিয়েছিলেন এবং সব দেশের সরকার প্রধানদের কাছে থেকেরিফিউজিদের জন্য সহানুভুতি অর্জন করেছিলেন এবং সকলকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন, ইন্ডিয়া কী রিফিউজিদের জন্যে কী ভার বহন করে চলেছে। যার ফলে তারা সকলেই আর্থিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন কিন্তু কেউ ই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ নেয়নি।

অন্যদিকে কিসিঞ্জারের নীরব কুটনীতি জটিল অবস্থা সুচনা করে ত্রিমুখী অবস্থানের। আন্তর্জাতিকসম্প্রদায় ইন্ডিয়াকে উপদেশ দেয় ধৈর্য ধারণ করতে এবং তারা তাকে এও বলেন মিসেস ইন্দিরাগান্ধির উচিত জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক গ্রহন করা এবং শান্তিপূর্ন কোন পথ খুঁজে বের করা।

ইন্দিরা গান্ধি বিভিন্ন প্রেস এর সাথে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বাস্তবে “ ভারত তারবর্ডারের নিরাপত্তার জন্য ,অখন্ডতা এবং স্থিতিশীলতা রক্ষা করার জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহনকরবে। এটা অন্য সরকার কি বলেছেন বা কি করছেন তার উপর নির্ভর করে না । এছাড়া শেখমুজিবর রহমান এবং পাকিস্তান হাইকমান্ডের মধ্যে আলোচনা শুরু করা উচিত বলে তিনি যে প্রশ্ন তুলেছিলেন তার প্রতি সমর্থনের অভাব দেখে , তিনি হতাশ হয়েছিলেন।

তিনি সব সময় এই সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্যে বলেছিলেন।

প্রাইম মিনিস্টার ইন্দিরা গান্ধি B.B.C (British Broadcasting Corporation’s) মাইকেল চার্নসটনকে যে সাক্ষাৎকার দেন তা ছিলো বাস্তবে শিক্ষনীয়। তিনি ইন্দিরা গান্ধিকে জিজ্ঞাসাকরেছিলেন , পরিস্থিতি প্রশমিত করার জন্য সীমান্তের উভয়দিকে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক নিয়োগেরপ্রস্তাব কেন ভারত গ্রহন করতে প্রস্তুত ছিল না ? আর এ বিষয়ে ভারত কেন ধৈর্যশীল হচ্ছে না?

ওই ইন্টারভিউ আমি টেলিভিশনে দেখেছিলাম। এক বছর পরে আমি ইন্দিরা গান্ধীকে দেখি। বাস্তবে প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ইন্দিরা জ্বলে ওঠেন।

 

শরনার্থী শিবির

 

বদলে যায় তার মুখের আকৃতি। তার কোমল মুখে সহসা এসে যায় নেহরুর কড়া চোয়াল। যে চোয়াল ছিলো শক্তিশালী প্রাইম মিনিষ্টারের । তার জ্বলে ওঠা চোখ ছিলো বাস্তবে যে কাউকে ইমপ্রেস করার মত। তার গ্রীবা ছিল উত্তেজনাপূর্ণ ,এবং স্বচ্ছ ত্বকের নীচেরশিরাগুলো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিলো।

ইন্দিরা বেশ রাগান্বিত স্বরে বিশ্ব নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেন।

এরফলে কি গন হত্যা কি বন্ধ হবে ? রেপ বন্ধ হবে?

বরং আপনার প্রশ্নে মনে হচ্ছে – আমরা গণহত্যাকে অনুমোদন দেই? আপনি কি গনহত্যা সমর্থন করেন? আপনার প্রশ্ন কিন্তু বাস্তবে গনহত্যার পক্ষে।

যেখানে সবচেয়ে খারাপ সহিংসতা হয়েছে । যখন জনাব হিটলার তান্ডব চালিয়েছিল ? আপনি কি চুপ করে ছিলেন বাকী ইহুদিদের মরার জন্য।

আপনি কিভাবে মানুষের বাস্তুত্যাগ ঠেকাবেন? ওই পরিস্থিতিতে যদি পৃথিবীশুদ্ধ লোক জেগে না উঠত,তাহলে এটা এত সহজে বন্ধ হত না ।

যুদ্ধ অনিবার্য বলে তিনি ভারতে ফিরে আসেন। তিনি অনুভব করেছিলেন যাহোক প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সাথে দেখা করার জন্য মার্কিন যুক্ত রাষ্ট্রের এই সফর ছিল এটা প্রমাণ করার জন্য ইন্দিরা খোলা মনের ছিলেন , পরিস্থিতি যুদ্ধের দিকে যাওয়ার আগে তিনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কথা শোনার জন্যও প্রস্তুত ছিলেন। তিনি আমেরিকার জনগনকে বাংলাদেশের পক্ষ নেয়ার জন্যে ধন্যবাদওজানাতে চেয়েছিলেন ।

১৯৭১ এ শরণার্থী শিবির এ থাকা মানুষের জীবনচিত্র

মিসেস গান্ধী যখন পরবর্তি ওয়াশিংটন সফর করেন তখন ছিল ডিসেম্বর মাস। লাজুক ,তরুণ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এর আগের সফরের পর পাঁচ বছর কেটে গেছে ।

ভারত মার্কিন সমর্থকের ক্রমবর্ধমান উষ্ণতার প্রতীক হিসেবে তাকে লাল গোলাপ দিয়ে স্বাগত জানানো হয়েছিল।

কিন্তু ১৯৭১ সালে তার সফর ছিল অন্য ধাঁচের । তিনি কঠোর ,দৃঢ়সংকল্প ছিলেন। তিনি যতটা ভয়ংকর ছিলেন ,ততটাই তিনি বিনীত ছিলেন।

যে সাহায্যকারীরা তার সাথে ওয়াশিংটন সফরে এসেছিলেন তারা তার ক্রোধ সম্পর্কে সচেতন ছিলেন এবং রাষ্ট্রপতি নিক্সন এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির মধ্যে বৈঠকের ফলাফল সম্পর্কে শংকিত ছিলেন।

তিনি রাষ্ট্রপতি নিক্সনের স্বাগত বক্তব্যের উদ্বোধনী বক্তৃতায় কিছুটা সংবেদন অনুভব করতে পেরেছিলেন । রাষ্ট্রপতি মিঃ নিক্সন তিনি সাম্প্রতিক বন্যার প্রতি সহানুভুতি ক্ষীনভাবে উল্লেখ করেছিলেন যা ভারতের কিছু অংশ ধংস করেছে ।

কিন্তু তার সফরের মূল উদ্দেশ্য নিয়ে ছিলেন নীরব।

মিসেস গান্ধী অবশ্য তার বক্তব্যে উল্লেখ করেন খরা,বন্যা,ঘুর্ণিঝড় ,জাতীয় বিপর্যয়ের সাথে যুক্ত হয়েছে মানবসৃষ্ট বিশাল ট্রাজেডি। উপচেপড়া শরনার্থী শিবিরে যন্ত্রনাদায়ক মুখের স্বীকার বা সেই ভয়ংকর ঘটনার প্রতিফলন -যা পূর্ব বাংলা থেকে লাখ লাখ লোককে দেশত্যাগে বাধ্য করেছে। আমি এখানে এসেছি বিশ্বের এ অংশের মানুষকে আমাদের অংশের পরিস্থিতি গভীরভাবে জানানোর জন্যে, তাদরে হৃদয়ের গভীর আবেগের সমর্থনের জন্যে ।

হোয়াইট হাউসে রাষ্ট্রপতি মিঃ নিক্সন ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির বৈঠক হয় ।

প্রেসিডেন্ট নিক্সন পূর্ব পাকিস্তানের মানবিক ট্রাজেডির মাত্রা স্বীকার করতে অস্বীকার করেন। মানব সমস্যাকে রাজনৈতিক হিসেবে রূপান্তরিত করার প্রয়াসে তিনি সময় নিতে এবং শান্তির প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের কথা বলেছিলেন। যা বাস্তবে প্রকৃত সমাধানকে আরো জটিল করার একটি পদক্ষেপ। পক্ষান্তরে ইন্দিরার বাহ্যিক আচরণ বরফের মত ছিল। তার মধ্যে ছিল প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস । যে আত্মবিশ্বাসরে মূলে ছিলো তিনি একটা বিশাল জনসংখ্যার একটি গনতান্ত্রিক দেশের প্রধান- দরিদ্র দেশ বটে ,তবুও হাজার বছরের সভ্যতার সৌভাগ্যের অধিকারী।

কিসিঞ্জার , বাইরের ঘরে প্রিন্স হাসকরের সাথে অপেক্ষা করছিলেন।তিনি পরামর্শ দিয়েছিলেন যে,দুই রাষ্ট্রপ্রধানকে দীর্ঘসময় একা রেখে যাওয়া বিপদজ্জনক। তাই তারা ভিতরে গেলেন এবং বৈঠকে বসলেন।

 

ইন্দিরা গান্ধী ও হেনরি কিসিঞ্জার

 

রাষ্ট্রপ্রতি মিঃনিক্সন পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে নিরবিচ্ছিন্নভাবে কথা বলতে লাগলেন। ইন্দিরা গান্ধী কোনরকম মন্তব্যে ছাড়া শুনতে লাগলেন । বাস্তবে এমন একটি দুর্ভেদ্য স্থান তৈরি করেন যা আলোচনাকে অনেকা স্তব্দ করে দেয়।

পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে কিসিঞ্জার কথোপকথনে যোগ দেন এবং বিভিন্ন বিকল্পের পরামর্শ দেন । যেমন জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকদের পোস্টিং , প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মধ্যে একটি আসন্ন সমস্যা নিরসনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বারা চাপ ।

 

মিটিং শেষে ইন্দিরা বললেন যে ,অনেক পরামর্শের কথা বলা হয়েছে। তিনি এগুলি চিন্তা করবেন এবং এর উওর পরের দিন দিবেন ।

সফরের দ্বিতীয় দিনে মিঃ নিক্সন তার বিরক্তি স্পষ্ট করেন। কি ছিল তপস্বী ভারতীয়দের প্রতি নিক্সনের অপছন্দের কারন ।

 

মুজিবনগর সরকার

যা মিসেস গান্ধীর বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা প্ররায়নতায় উন্নীত হয়েছিল। মিঃ হাশের মতে, রাষ্ট্রপতি নিক্সন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধিকে ৪৫ মিনি ওেয়টিং রুমে অপেক্ষা করিয়েছিলেন,তিনি মিটিং এ হাজির হওয়ার আগে । যদি এই রিপোর্ট সত্য হয়ে থাকে, রাষ্ট্রপতি নিক্সন এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরার সাক্ষাৎকালে মিসেস ইন্দিরার ক্রোধ যে কেউ বুঝতে পারবেন।

এবার কথার পালা ছিল ইন্দিরার। তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে ভারত পাকিস্তান বিরোধ সম্পর্কিত কোন প্রশ্ন উপেক্ষা করার বা উদ্বাস্তু সমস্যার কোন সমাধানের পরামর্শ এড়িয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

পরিবর্তে তিনি ভিয়েতনামের কথা বলেছিলেন, মিঃ নিক্সনের ভূমিকার প্রশংসা করেছেন এবং সাধারণ বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন করেন ।

প্রেসিডেন্ট নিক্সন আগেরদিন যে ক্ষমার অযোগ্য ব্যবহার করেছিলেন, ইন্দিরার এই আচরণ ও বক্তব্য ছিলো বাস্তবে তার একটি নান্দনিক কূটনৈতিক প্রতিবাদ।

 

(পিপুল জয়াকারের লেখা ইন্দিরার জীবনী থেকে)

 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024