(প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ)
নাম: রোকেয়া বেগম
পিতা: মোঃ জয়নাল আবেদিন
গ্রাম: গোবিন্দপুর, ডাক: মঈনপুর বাজার, ইউনিয়ন কাইয়ুমপুর
১৯৭১ সালে বয়স: ১৬/১৭
থানা: কসবা, জেলা: ব্রাহ্মণবাড়িয়া (১৯৭১ সালে কুমিল্লা জেলার অন্তর্গত মহকুমা)
১৯৭১ সালে পেশা: ছাত্রী
বর্তমান পেশা : গৃহিণী
প্র: আপনি কি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন?
উ: জ্বি, দেখেছি।
প্র: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তান আর্মির আক্রমণ সম্বন্ধে কিছু শুনেছিলেন কি?
উ: শুনছি ঢাকা নাকি পাকিস্তানের আর্মিরা আইসা দখল করছে, ওরা অত্যাচার করছে, বাড়িঘর পোড়াইছে, শহরে আগুন লাগাই দিছে।
প্র: এটা কিভাবে শুনেছেন আপনি?
উ: ইন্ডিয়ার রেডিওর মাধ্যমে।
প্র: আপনার এলাকায় পাকিস্তানিরা কোন্ সময় আক্রমণ করেছে- জুন-জুলাই, না এপ্রিলে ?
উ: জুন-জুলাইয়ে বেশি আক্রমণ করছে। কিন্তু এপ্রিলের প্রথমেই তারা আক্রমণ করে।
প্র: ‘৭১ সালের কত তারিখ?
উ: ১৪ এপ্রিল।
প্র: ১লা বৈশাখ?
উ: জ্বি, ঐ দিন বৃহস্পতিবার আছিলো।
প্র: এরপরে আপনার এলাকায় কখন আসে?
উ: জুন/জুলাইয়ে বেশি আক্রমণ করছে আমাদের এলাকায়।
প্র: তারা কোন্ পথে ঢুকলো, কিভাবে ঢুকলো ?
উ: তারা প্রথম কসবা থেইকা আমাদের এইখানে বেলতলি কইরা একটা জায়গা আছে, এই দিকদা যাইয়া আমাদের গ্রামে দাঁড়াইয়া পড়ছে এবং ক্যাম্প করছে। সাধু মিয়া সাবের বাড়িতে একটা ক্যাম্প করছে। আর মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্প করছে মঈনপুর মৌলবি বাড়িতে। এই দুইখানে দুইটা ক্যাম্প হইছে। মুক্তিযোদ্ধারা একটা আর পাঞ্জাবিরা একটা করছে।
প্র: মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা সম্বন্ধে কিছু বলতে পারবেন কি ?
উ: পারি।
প্র: বলেন তো দেখি?
উ: গ্রামের বা এলাকার ছেলেরা মিললা একটা মিটিং করছে। মিটিং কইরা তারা একটা কমিটি করছে। তারপর এলাকার পোলাপানরা মুক্তিযুদ্ধে গেছে।
প্র: কোথায় মিটিং করছে তারা?
উ: মঈনপুর হাই স্কুলের সামনে। মিটিংয়ে এলাকার সব পোলাপান গেছে। গিয়া সাইরা হেইয়ানে তারা সিদ্ধান্ত নিছে যে, আমরা যদি না যাই, আমাদের দেশ স্বাধীন অইতো না। পাঞ্জাবিরা আমাদের মা-বোনের ইজ্জত নষ্ট করবো। আমাদের শক্ত হাতে এবার লড়তে হইবো। এই দেশ থেইকা তাড়াইতে অইবো পাঞ্জাবিগো।
প্র: তখন এইগুলার নেতৃত্বে কে ছিলো?
উ: নেতৃত্বে আছিলো আমার বড় ভাই।
প্র: তার নাম কি?
উ: শফিকুল ইসলাম মিলন।
প্র: শফিকুল ইসলাম মিলন?
উ: জ্বি।
প্র: আর কারো নাম মনে আছে?
উ: এরপরে আমার এক চাচাতো ভাই সাধন আছিলো।
প্র: সাধন?
উ: জ্বি, আরও আছিলো। আমাদের গ্রামেই অনেক ছেলে আছিলো, তা দশ বারো জন তো বটেই।
প্র: কোন্ সাধন- মঈনপুর বাজারে ব্যবসা করে সেই সাধন ভাইয়ের কথা বলছেন?
উ: না, উনি চাকরি করে বিদেশে।
প্র: আর কারো কথা মনে আছে?
উ: মঈনপুরের শামু চেয়ারম্যানের ছোট ভাই শফিক আছিলো, হুমায়ুন আছিলো।
এরপরে গয়েস আছিলো।
প্র: শ্রীপুরের গয়েস ভাই?
উ: জ্বি, জ্বি।
প্র: তারপরে?
উ: এরপরে ঐ জহির ডাক্তারের কামলা (কাজের লোক) এহেনে যে আছে, সে
ছিলো।
প্র: জহির ডাক্তার কি তখন স্টুডেন্ট লীডার ছিলেন?
উ: জ্বি, জ্বি।
প্র: তারা কি বক্তব্য রাখলো সেখানে?
উ: তারা এই দেশের অন্য পোলাপানের বুঝাইছে।
প্র: এইডা কি ঢাকাতে আক্রমণ হওয়ার পরে?
উ: না।
প্র: এরও আগে?
উ: এরপরে। আমাদের এলাকায় যখন ওরা আইসা পড়লো মানে কসবাতে পাঞ্জাবিরা আসনের পরে।
প্র: মার্চ মাসে এখানে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়াইছে এমন ঘটনা আছে? উ: জ্বি, উড়াইছে স্বাধীন বাংলার পতাকা।
প্র: এ সম্পর্কে আর কি জানেন?
প্রথম তারা স্বাধীন হওয়ার পরে। তারা নাইম্মা আইছে ইন্ডিয়া থেইকা। হাইস্কুলের সামনে
প্র: কিভাবে প্রস্তুতি নিছে মুক্তিযোদ্ধারা?
উ: আমাদের এখানে একটা নদীর ঘাট আছে। এইডা বলে জিকরা। এহেনে তারার মানে পাঞ্জাবিদের অনুটাক করছে মুক্তিবাহিনীরা। পাঞ্জাবিরা স্পীড বেহেনে তারার আসছে, ঘটনা ঘটছে খুব ইচ্ছে। এই ঘটনার পরেই এরা আমাদের বাড়িঘরা ছাড়াইহানে
আমরার ইন্ডিয়া যাইতে অইছে। প্র: আর কোনো ঘটনা আছে?
উ: আছে।
প্র: আর কি আছে?
উ: আমাদের কামালপুর বলে একটা গ্রাম আছে, ঐ গ্রামের মসজিদের মধ্যে চারজন মেজর নাকি অন্য আর্মি অফিসার মারা গেছে। মুক্তিযোদ্ধারা সকাল বেলা আয়ো তাদের মারছে।
প্র: কামালপুর মসজিদে?
উ: মসজিদের ভিতরে।
প্র: চারজনই অফিসার?
উ: মেইন অফিসার।
প্র: অফিসারদের কোনো নামটাম আপনি শুনছেন?
উ: না।
প্র: কারা আক্রমণ করছে এই মসজিদে?
উ: মুক্তিযোদ্ধারা।
প্র: কার নেতৃত্বে তা জানেন?
উ: নেতৃত্ব জানি যে, হুমায়ুন আছে না মজমপুরের, উনি ছিলো। আর কালামুড়ার পুলডা যে ভাংছে এইডা করছে আমার ভাইয়ের ম্যাপে, আমার ভাই আগের দিন আসছিলো। শফিকুল ইসলাম মিলন যে বললাম, উনি আইসা মাইপা দুই এক ছেলে লইয়া গেছে। গিয়া হেইডা ম্যাপ কইরা আইন্না হেয়ারে এইডা দিছে। দিছে পরে হেরা পরের দিন পুলডা ভাঙছে।
প্র: আপনার ভাইয়ে যে ম্যাপ করছে, আপনার ভাই কি ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন ?
উ: জ্বি। এখনো ইঞ্জিনিয়ার তো, ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার।
প্র: ভালো ম্যাপ ট্যাপ করতে পারেন?
উ: হ্যাঁ, সে মুক্তিযোদ্ধাও ছিলো।
প্র: আপনি এই মুক্তিযোদ্ধাদেরকে কিভাবে সহযোগিতা করলেন?
প্র: আপার ভাই যে ছেলেরারে নিয়া আমাদের বাড়িতে আসা যাওয়া করছে, আমি ওয়ার্ডে: আমদা ওয়াইছি, কোনো সময় ভাত খাওয়াইছি। চা বানাইয়া খাওয়াছি। রাবের বেলা এরা আইসা ডাক দিলে আমি উঠছি। জায়গা করে দিছি থাকনের জন্য।
প্র: তাদের অস্ত্রশস্ত্র দেখলে আপনার ভয় লাগতো না?
উ: না। ওরা আমাদের দেশ স্বাধীন করতে গেছে। আমিওতো তাদের একজন। আমার তখন ভালো লাগতো।
প্র: পাকিস্তানি বাহিনী আপনার এলাকায় কি ধরনের অত্যাচার করে?
উ: তখন আমার দাদায় আছিলো, আমরারে দৌড়াইয়া দূরে ভাগাইয়া দিতো যে পাঞ্জাবিরা আইতাছে। মেয়েরারে নাকি ধইরা নিয়া যাইতো হেরা। আমরা দৌড়াইয়া দূরে সইরা যাইতাম। হেরা বাড়িঘর পোড়াইছে, হাঁস মুরগি দৌড়াইয়া ধইরা নিছেগা। মানুষ
মারছে, মেয়েদের উপর অত্যাচার করছে।
প্র: এইডা কি আপনি শুনছেন না দেখছেন?
উ: শুনছি। আবার দেখছিও। দুয়েকজন মেয়েরারে ধইরা নিছে, আমি দেখছিও।
প্র: কামালপুর-গোবিন্দপুরের মেয়েদেরকে ধইরা নিছে?
উ: হ্যাঁ, আবার আশেপাশের মেয়েরারেও ধইরা নিছে।
প্র: যাদের বাড়িঘর পোড়াইছে তাদের কিছু কথা বলতে পারেন?
উ: হ্যাঁ, আমাদের গ্রামেইতো পোড়াইছে বাড়ি।
প্র: কার কার বাড়ি পোড়াইছে?
উ: কুতু মুন্সির বাড়ি পুড়ছে। মফিজনগরে বাড়ি পুড়ছে, কামালপুরে পুড়ছে, মঈনপুর পুড়ছে, পাইন্নার রোডের সিরাজুল হকের বাড়ি পুড়ছে। আরো বাড়ি পুড়ছে।
প্র: নারী নির্যাতনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে আর কারা ছিলো?
উ: আমাদের বাঙালিরাই তো সাহায্য করছে এরারে।
প্র: এরা কারা?
উ: চিনি না। এরা রেজাকার ছিলো শুনছি।
প্র: রাজাকারে কোন্ ধরনের লোকেরা ছিলো?
উ: নিম্ন ধরনের লোক। পয়সা পাইছে যারা, স্বার্থপর, তারাই তো মিশতে যায় ওরার সাথে। দেশের প্রতি দরদ যারার আছিলো না, তারাই যাইয়া মিশছে। দেশের প্রতি দরদ যারার আছিলো তারা হাতিয়ার নিয়া নাইমাই গেছে।
প্র: আপনি ইন্ডিয়াতে কবে গেলেন?
উ: সেপ্টেম্বরে।
প্র: সেপ্টেম্বরে ইন্ডিয়াতে গেছেন, না?
উ: জ্বি। তখন প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে, খুব যুদ্ধ চলছে। নৌকা দিয়া আমরা গুলির লাইগা যাইতাম পারছি না।
প্র: কিভাবে আপনারা গেলেন সেই কষ্টের কথাগুলো বলবেন?
উ: বাড়িত থাইকা আমরা দৌড়াইয়া গিয়া নৌকায় উঠছি। নৌকায় যাইয়াও আমরা নৌকায় থাকতাম পারি না। আমাদের পূর্ব দিক দিয়া ইন্ডিয়া যাওয়ার রাস্তা আর কি। এই দিক দিয়া নামছি আমরা। নাইম্মাও আমরা আউগাইতে পারতাছি না। বাচ্চা-কাচ্চা, ভাই-বোন নিয়া কষ্ট কইরা, কান্নাকাটি কইরা হাউ-মাউ চিল্লা-চিল্লি কইরা নৌকায় উঠছি। আমাদের বাড়ি থেইকা প্রায় দোনদেড়েক জমি অইবো বাইঅইয়া যাইতে হয়। যেই যাগাডান নাকি পানি নাই সে জাগায় যাইতে প্রায় আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা টাইম নিছে আমরার। আমরা যখন নৌকার মধ্যে উঠছি তখন নজু ভাই ছিলো, আমাদের
ফুফাতো ভাই, নৌকার মধ্যে ওর পায়ে গুলি লাগছে। প্র: ওর বাড়ি কোন্ জায়গায়?
উ: কামালপুর। গুলি লাগছে ওর পায়ে। তার পরে আমি মুখে কামুড় দিয়া গুলিডা সরাইছি ওর পায়ের থেইক্যা।
প্র: তারপর?
উ: এরপরে রক্ত যাওয়া শুরু করছে। দুইডা গামছা, তোয়ালে আমরা ওর পায়ে বাইন্ধা এর পরেরদা আমরা গেছি ভারতে। ভারতের লোকেরা আইয়া নৌকাও বাইছে, মুক্তিযোদ্ধারা করছে কি একটা ঔষুধ আমাদের নৌকার মধ্যে ইডাদা ফালাইছে।
প্র: মুক্তিযোদ্ধারা ?
উ: হ্যাঁ, বৈঠা মাইরা হেরা যাইতেছিলোগা। ওরা দেইখা একটা বড় মলমের ডিবি এতবড় নৌকার মধ্যে ইডাদা ফালাইছে। ফালাইছে পরে এই দিছি আমরা।
প্র: মুক্তিযুদ্ধের সময় এই এলাকাতে অর্থাৎ কাইয়ুমপুর ইউনিয়নে আনুমানিক কতজন নারী ধর্ষিত হয়েছে জানেন কিছু?
উ: আনুমানিক……সব সময়ই শুনছি এই দিকদা এই রকম অইছে, ঐ দিকদা এইরকম অইছে। কিন্তুক আনুমানিক সংখ্যাটা আমি সঠিক বলতে পারবো না।
প্র: কেউ কেউ এমন ধরনের কথাও বলছে যে, তাদের মানে পাঞ্জাবিদের বাংকারে পর্যন্ত নারী পাওয়া গেছে, এইডা কি সত্য?
উ: সত্য। ওদের বাংকারে নারী পাওয়া গেছে।
প্র: তাদের অধিকাংশই নাকি হিন্দু?
উ: হিন্দুও ছিলো, মুসলমানও ছিলো। হিন্দু বেশি ছিলো না।
প্র: মুসলমান বেশি?
উ: মুসলমান নারীরা বেশি …।
প্র: তারা শিক্ষিত সবাই?
উ: শিক্ষিত।
প্র: আপনার ভারতে থাকার অভিজ্ঞতার কথা কিছু বলবেন?
উ: ভারতে গিয়া কার্ড করছে অনেকেই। কার্ড কইরা রেশন আনছে। আমরা ঐ রেশন আনছি না।
প্র: কেন আনেন নাই?
উ: আনছি না….. আমরার যে বাড়িঘর থেইকা মালসামানা উডাইছে বা ধান-চাউল
টাকা-পয়সা আমরা নিছি, সেপ্টেম্বর থেইকা ডিসেম্বর পর্যন্ত এইগুলিই আমরার চলছে। আমরা ঐ দেশের রেশন টেশন কখনো আনছি না। আমরা ক্যাম্পেও গেছি না।
প্র: ক্যাম্পে মানুষের দুঃখদুর্দশা ছিলো না?
উ: হ্যাঁ, অনেক। আমরা ঐ দেশে যাইয়া আশ্রয় পাইছি, কিন্তু কষ্ট হইছে আমাদের। আমাদের বাচ্চা কাচ্চা অসুখে বিসুখে মারা গেছে। বহু লোক মারা গেছে। ওষুধের অভাবে, পানির অভাবে। ঐগুলি দেইখা আমরা ক্যাম্পে গেছি না। কষ্ট কইরা আমরা অন্য জায়গায় রইছি।
প্র: আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে?
উ: না, আত্মীয়-স্বজন না।
প্র: ক্যাম্পেই?
প্র: ক্যাম্পেও না। এমনিই এক হিন্দু বাড়িতে আমরা আশ্রয় নিছি।
প্র: তারা কেমন সহযোগিতা করছে আপনাদেরকে?
উ: ভালো।
প্র: তখন কি হিন্দু-মুসলমান বিভেদ ছিলো?
উ: না, না, বিভেদ ছিলো না। বিভেদ থাকলে কি তারা আমগরে আশ্রয় দিতো?
তারা আমরারে বাঁচাইছে। তারার উপকার আমরা ভুলতাম না। তারা আমরারে যদি ইয়াও কইরা দেয় তাও আমরার এই উপকারডা স্বীকার করতে হইবো। অসময়ে তারা আমরারে আশ্রয় দিয়া বাঁচাইয়া রাখছে। বিপদের সময় করছে তারা। বিপদের বন্ধু যারা তারার উপকার ভুলবো না কি?
প্র: ইন্ডিয়ান সৈন্য আপনারা দেখছেন তো?
উ: দেখছি।
প্র: তাদের সম্পর্কে কিছু বলতে পারবেন?
উ: না। তারার সাথে আমরার কোনো কথা হইছে না।
প্র: শত্রু মুক্ত হওয়ার পরে দেশে এসে এলাকার কি অবস্থা দেখলেন?
উ: বাড়িঘর চিনারই জো নাই! গাছ গাছরা বাড়ির মধ্যে উইঠা গেছে। চুলার মধ্যে
বিরাট বিরাট ঘাসের চাকা উইঠা গেছে।
প্র: আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা?
উ: এডির তো কোনো অস্তিত্বই নাই।
প্র: এটা কি আপনার গ্রামের কথা বলছেন?
উ: গ্রামের কথা বলছি।
প্র: এরপরে কি দেখলেন গ্রামে?
উ: গ্রামে আইসা বাড়িঘর চিনা যায় না। কোনো কিছুর স্মৃতি নাই। গাছ-গাছড়া কাইটা বাংকার কইরা কইরা বাংকারের মধ্যে লাইছে সব পাঞ্জাবিরা।
প্র: প্রিয়জন যাদেরকে হারাইছেন তাদের কথা তো অবশ্যই স্মরণ আছে?
উ: নিশ্চয়ই আছে। মুক্তিযুদ্ধে যহন যায় তহন আমার আম্মারে ভাই কইছে যে, আম্মা আমি তো মুক্তিযুদ্ধে যাই, আমি যদি মইরাও যাইগা আপনের ছেলে মনে করবেন শহীদ। আপনে আমার লাইগা দুঃখ করবেন না। আমার ভাইবোন নিয়া সংসারের চিন্তা করবেন না। মালছামানের মায়া করবেন না। যদি অসুবিধা হয় এরারে নিয়া আপনে ভারতে উইঠা যাইবেন গা। এই কথা বইল্লা আমার ভাই গেছে গা। মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার পরে আমার ভাইয়ের আর কোনো দেখা সাক্ষাৎ নাই। কোনো খোঁজখবর নাই। ডিসেম্বরের শেষভাগে আমার ভাইয়েরা আসছে বাড়িতে।
প্র: বাড়িতে?
আমরারে নিয়া এক্কেরে চইলা গেছে ইন্ডিয়া। কথামতোই বাড়িঘর ফালাইয়া দিয়া।
প্র: আপনাদের পরিবারে কেউ শহীদ হয়নি?
উ: জ্বি না। আশেপাশে হইছে, গ্রামে অনেক লোক শহীদ হইছে।
প্র: মনে আছে কারো কথা?
উ: জ্বি আছে।
প্র: নাম বলতে পারবেন?
উ: আমাদের একজন, তুতু মুন্সির বউয়ের কথা কই। এই মহিলাকে একটা বাচ্চা সমেত পাঞ্জাবিরা ঘরের মধ্যে ঢুইক্যা বেনেটদা ঘাওয়াইয়া মারছে।
প্র: তুতু মুন্সির স্ত্রী ?
উ: স্ত্রী। হের একটা বাচ্চা আছিলো।
প্র: তারা আর কাকে কাকে মারছে?
উ: এরপরে আরও মারলো। নায়েব আলীরে মারলো। এমনি অনেক মরছে। এডির
নাম আমার স্মরণ নাই।
প্র: নায়েব আলী?
উ: জ্বি।
প্র: পিতার নাম কি?
উ: কইতে পারতাম না আমি।
প্র: আর কে কে মারা গেছে?
উ: আমার চাচা। উনি মারা গেছে আমার নিজের লোকের মধ্যে আর কি। এরপর আমার দুইজন কাকা মারা গেছে। নানা মারা গেছে।
প্র: তারা কি আসলে শেল পইড়া মারা গেছে, না তাদের গুলি করে মারছে ?
উ: পাঞ্জাবিরা ডাইরেক্ট গুলি দিয়া মারছে এরারে ঘরে।
প্র: গোবিন্দপুর কোন্ পাড়ায় আপনাদের বাড়ি ?
উ: পূর্ব পাড়া।
সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীর নাম: জহিরুল ইসলাম স্বপন
সাক্ষাৎকার গ্রহণের তারিখ: অক্টোবর ০৭, ১৯৯৬
Leave a Reply