ভারতীয় পণ্য বর্জনেরএকটি প্রচারণা বাংলাদেশে গত কিছুদিন ধরে সামাজিক মাধ্যমের বাইরে গিয়ে এখন রাজনৈতিক চেহারা পেয়েছে। যদিও বাংলাদেশের বহুল ব্যবহৃত অনেক পণ্য ভারত থেকে আমদানি করা হয়।
ভারতীয় পণ্য বর্জনের এই ক্যাম্পেইনকে কীভাবে দেখছেন দেশটির ব্যবসায়ীরা?
গত কিছুদিন ধরে সুনির্দিষ্টভাবে ভারতীয় পণ্য বর্জনের পক্ষে বেশ কিছুদিন ধরে সামাজিক মাধ্যমের অনেক ব্যবহারকারী প্রচারণা চালিয়ে আসছিলেন।
এ নিয়ে বেশ কিছু গ্রুপও খোলা হয়েছে, যেসব গ্রুপে হাজার হাজার মানুষ সদস্য হয়েছেন।
এখানে অনেকেই দাবি করেছেন, তারা এখন ভারতীয় পণ্যের বদলে দেশের বা অন্য দেশের পণ্য ব্যবহার করতে শুরু করেছেন।
যেসব নিত্য ব্যবহার্য ভোগ্যপণ্য ভারত থেকে আমদানি করা হয় সেগুলোর বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশি বিভিন্ন কোম্পানির উৎপাদিত পণ্য ব্যবহারে আহ্বান জানাচ্ছেন তারা। সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছেন সেসব পণ্যের ছবি বা বিজ্ঞাপন।
তারা তালিকায় রেখেছেন সাবান, শ্যাম্পু, ফেসওয়াশ, টুথপেস্টের মত টয়লেট্রিজ এবং বোতলজাত পানি, জীবাণুনাশক, মশানাশকসহ আরো নানান পণ্য। গাড়ি বা মোটরসাইকেল টায়ার থেকে শিশুখাদ্যের কথাও লিখছেন অনেকে।
যদিও বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বলছেন,আমদানি বা খুচরা বিক্রির ক্ষেত্রে এই ক্যাম্পেইনের তেমন একটা প্রভাব তারা দেখছেন না।
যা বলছেন বিক্রেতারা
ঢাকায় একটি শপিং মলে একাধিক দোকানের সত্বাধিকারী মেহেদী হাসান। বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা প্রসাধনী ও অন্যান্য নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের ব্যবসা তার।
বিবিসি বাংলাকে বলেন, ”আগে থেকেই কিছু ক্রেতা ভারতীয় পণ্য এড়িয়ে চলতেন। প্রতি সপ্তাহে এমন কয়েকজন ক্রেতার দেখা মিলতো।”
এখনও সেই সংখ্যা অপরিবর্তিত আছেন বলে জানান মি. হাসান।
অন্যান্য দোকানিরাও একই ধারণা দিলেন।
তবে, প্রান্তিক পর্যায়ে খুচরা ব্যবসার ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন দেখা গেছে।
যেমন, ছোট ছোট দোকানগুলোতে ভারতীয় বা আন্তর্জাতিক অন্য ব্রান্ডের কোমল পানীয়’র বদলে বাংলাদেশি কোম্পানির পানীয় বেশি বিক্রি হচ্ছে বলে তারা জানাচ্ছেন।
সামাজিক মাধ্যমে প্রচারণা
ভারতীয় পণ্য আমদানিকারকরা বলছেন, এখন পর্যন্ত আমদানিতে কোনো তারতম্য নেই। তাছাড়া, এই প্রচারণায় যেসব পণ্য বর্জনের কথা বলা হচ্ছে, দুই দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে সেগুলোর অনুপাত খুবই সামান্য।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এসব পণ্য ভারত থেকে মোট আমদানির খুবই অল্প অংশ। দেশটি থেকে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি আমদানি করে শিল্পের কাঁচামাল।
দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্যের বড় অংশ হয় বেনাপোল-পেট্রাপোল সীমান্ত দিয়ে।
এই স্থলবন্দরের ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং – সিএন্ডএফ এজেন্টরা বলছেন, তিন মাস আগে যেখানে দিনে তিনশো থেকে সাড়ে তিনশো ট্রাক বাংলাদেশে প্রবেশ করতো। এখন কোনো কোনো দিন সেই সংখ্যা চারশো ছাড়িয়ে যায়।
এই পরিসংখ্যান উল্লেখ করে তাদের দাবি, ডলার সংকট, এলসি জটিলতার মতো বিষয়গুলো বহাল থাকলেও নতুন করে আমদানির ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন বা কম-বেশি হয়নি।
ঢাকাস্থ ভারতীয় হাইকমিশনের ওয়েবসাইটের তথ্য বলছে, ভারত ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৯৭ ধরনের পণ্য রপ্তানি করেছে।
এর একটা বড় অংশ দখল করে আছে তুলা, সুতাসহ পোশাক খাতের কাঁচামাল। জাতিসংঘের বাণিজ্য বিষয়ক ডেটাবেসের তথ্য অনুযায়ী, ওই অর্থবছরে বাংলাদেশ এই খাতে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার আমদানি করেছে প্রতিবেশি দেশ থেকে।
দ্বিতীয় অবস্থানে তেল ও অন্যান্য খনিজ জ্বালানি। এতে ভারতের আয়ের পরিমাণ প্রায় দুশো কোটি ডলার।
দেড় বিলিয়ন ডলারের বেশি রপ্তানি হওয়া খাদ্যশস্য আছে তৃতীয় অবস্থানে।
এছাড়া, দেশটি থেকে বাংলাদেশে যেসব খাদ্য-পণ্য আমদানি হয় তার মধ্যে রয়েছে পেঁয়াজ, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার, সূর্যমুখী ও সয়াবিন তেলসহ ভোজ্য-তেল, চিনি, মধু, কোমল পানীয়, চিপস, বিস্কুট, চকলেট ও ক্যান্ডি জাতীয় খাবার।
ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক কেন
বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্য বর্জনের মতো আহবান নতুন কিছু নয়। এর আগেও বিভিন্ন সময় এ ধরনের আহবান জানাতে দেখা গেছে। কারণ হিসেবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কথা বলে থাকেন এই বিরোধীরা।
তবে বাংলাদেশের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে এ ধরনের আন্দোলন নতুন মাত্রা পেয়েছে।
সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীদের একটি অংশ ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহ্বান জানিয়ে ক্যাম্পেইন শুরু করেন।
এরকম কোন কোন গ্রুপে লক্ষ্যাধিক সদস্য থাকতেও দেখা গেছে।
ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, ঢাকার অলি-গলিতে এক তরুণ হ্যান্ডমাইক হাতে ভারতের পণ্য বর্জনের প্রচারণা চালাচ্ছেন।
সেই যুবক গণঅধিকার পরিষদ নামে একটি রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত বলে জানা যায়।
সামাজিক মাধ্যমে এই ধরনের কন্টেন্টগুলোতে ‘ইন্ডিয়া আউট’ ও ‘বয়কটইন্ডিয়ানপ্রোডাক্টস’ হ্যাশট্যাগের ব্যবহার লক্ষ করা যায়।
গণঅধিকার পরিষদ ও এবি পার্টির মতো কয়েকটি দলের নেতা-কর্মীরা গত সাতই জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে নানাভাবে ভারত-বিরোধী বক্তব্য দিয়ে আসছেন।
সর্বশেষ বিরোধী দল বিএনপির একাধিক শীর্ষ নেতাকে এই ক্যাম্পেইনের সাথে সংহতি প্রকাশ করতে দেখা গেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ভারত নিয়ে ‘জনমনে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে বলেই’ এটি রাজনৈতিক আলোচনায় এসেছে।
“নির্বাচন আসলেই ভারত কোনও রাখঢাক না করেই সক্রিয় হয় বলেই মানুষ ভোট দিতে পারেনি বা বঞ্চিত হয়েছে। সে বঞ্চনা থেকেই ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। মানুষের ক্ষোভ কমানোর কাজ তো বিএনপির না”, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ রবিবার এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বলেছেন ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক দেওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘বাজারকে অস্থিতিশীল করে পণ্যের দাম বাড়ানো’।
ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ ঘোষণা করেছে
আমদানির ওপর প্রভাব কতটা?
ভারত থেকে প্রতি বছর বাংলাদেশের আমদানির পরিমাণ প্রায় ১৪ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশে যেসব দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করা হয়, সেই তালিকায় চীনের পরেই রয়েছে ভারত।
ইন্ডিয়া বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ বিবিসি বাংলাকে বলেন, ভৌগলিক অবস্থানের কারণেই ভারত থেকে বাংলাদেশে পণ্য বেশি আমদানি করা হয়। কারণ যেসব পণ্য ভারত থেকে আমদানি করা হয়, সেগুলো অন্য দেশ থেকে আনতে গেলে খরচ ২০ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়ে যাবে।
“১৪ বিলিয়ন ডলারের ইমপোর্টের ব্যয় তখন হয়তো গিয়ে দাঁড়াবে ২০ বিলিয়ন ডলার। এই ৬ বিলিয়ন ডলার দেশের ক্ষতি হবে,” উদাহরণ টেনে বলেন মি. আহমাদ।
তিনি জানান, ভারত থেকে পুরোপুরি প্রস্তুতকৃত পণ্যের তুলনায় কাঁচামাল বেশি আমদানি বেশি হয়।
পণ্য আমদানিকারকরা বলছেন, অন্য দেশের তুলনায় কম সময়ে ভারত থেকে পণ্য আমদানি করা সহজ হয়। সড়ক পথেআনা যায় বলে পরিবহন খরচও কম হয়। এই কারণে পেঁয়াজ, মরিচ বা চালের মতো পণ্য, শিল্পের কাঁচামাল অন্য দেশে পাওয়া গেলেও আমদানিকারকদের প্রথম পছন্দ ভারত।
বেনাপোল স্থল বন্দরের ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং এজেন্ট সজন এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থাপক মো. শফিউর রহমান বলেন, “ভারতের কাঁচামালের জন্য আজকে এলসি খুললে কালকের ট্রাকে পণ্যটা ঢুকে যায়।”
পচনশীল পণ্যের ক্ষেত্রে সময় গুরুত্বপূর্ণ। পণ্য আগে বাজারে ছাড়া গেলে ব্যবসাও ভালো হয়।
কিন্তু, অন্য কোনো দেশ থেকে আমদানি করতে গেলে দীর্ঘসূত্রতায় পড়তে হয় বলে জানাচ্ছেন মি. রহমান।
“একটু দূরের কোনো দেশ থেকে আনতে গেলে একটা এলসি খুলে ১৫ দিন বসে থাকতে হয়। ব্যবসায় ঝুঁকি বাড়ে তখন।”
ফলে বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্য বর্জনের এই ক্যাম্পেইনের প্রভাব দেখতে দেখতে পাচ্ছেন না এই আমদানিকারক।
চীনের পর ভারত থেকেই বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করা হয়ে থাকে
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীছবির উৎস,GETTY IMAGES
বেনাপোল স্থলবন্দরের আমদানিকারক আবুল হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, আগে থেকে ডলার সংকটের কারণে কিছু জটিলতায় পড়তে হচ্ছিল। এলসি খুলতে বেগ পেতে হতো।
সেই ‘সংকট’ এখনো কাটেনি বলে জানাচ্ছেন তিনি। তাছাড়া, পেঁয়াজ রপ্তানিতে ভারত নিষেধাজ্ঞা দেয়ায় আপাতত এই পণ্যটির আমদানিও বন্ধ আছে।
তবে, কোনো নির্দিষ্ট পণ্যের আমদানি হ্রাস পায়নি বলে দাবি মি. হোসেনের।
তবে বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদদের একজন বলছেন, কোন ‘ইস্যু’ থাকলে পণ্য বর্জন করে নয়, বরং আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা উচিত।
সিপিডি’র সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অনেক ‘চ্যালেঞ্জিং ইস্যু’ আছে। অনেকেরই হয়তো বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে পারে । সেটা অবশ্যই অ্যাড্রেস করাও প্রয়োজন।”
কিন্তু সেটা কি পণ্য বর্জন করে হবে নাকি বক্তব্য তুলে ধরে দ্বিপাক্ষিক আলাপ আলোচনার মাধ্যমে কার্যকর হবে সেটা ভাববার বিষয়, যোগ করেন মি. রহমান।
তার মতে, অর্থনীতিকে দুর্বল করে কিছু করলে সেটা শেষের বিচার ক্ষতিকর হবে। আবার কিছু বিষয়ও আছে যেটা ভারতের সাথে সমাধান করতে হবে দ্বিপাক্ষিক আলাপ আলোচনার মাধ্যমে।
-বিবিসি নিউজ বাংলা
Leave a Reply