বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশই আছেন নিষ্ক্রিয় অবস্থায়। অর্থাৎ তারা পড়াশোনা, কর্মসংস্থান কিংবা কোনও ধরনের প্রশিক্ষণে নেই। বাংলাদেশের ছেলেদের চেয়ে এই নিষ্ক্রিয়তার হার আবার তিনগুণেরও বেশি মেয়েদের ক্ষেত্রে।
১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী মেয়েদের নিষ্ক্রিয়তার হার শতকার ৬০ দশমিক ৮৫ শতাংশ। বিপরীতে ছেলেদের এই হার ১৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ ছেলে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস, ২০২৩ জরিপে উঠে এসেছে এসব তথ্য। বিবিএস-এর এই জরিপে নিষ্ক্রিয় তরুণের হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে বয়স সীমা ধরা হয়েছে ১৫ থেকে ২৪ বছর।
বিবিএস-এর জরিপ বলছে, নিষ্ক্রিয়তা বিবেচনায় তরুণীদের হার ৬০ দশমিক ৮৫ শতাংশ। যদিও আগের বছরের চেয়ে তা কিছুটা কমেছে।
আগের বছর এ হার ছিল ৬১ দশমিক ৭১ শতাংশ। অন্য দিকে তরুণদের মধ্যে এ হার ১৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ, যা আগের বছর ছিল ১৮ দশমিক ৫৯ শতাংশ।
বিশ্লেষকরা মনে করেন মেয়েদের বাল্যবিবাহ, দক্ষতার অভাব, শিক্ষার মানের ঘাটতি, জলবায়ু পরিবর্তন, করোনা কিংবা মূল্যস্ফীতির কারণেই তরুণদের মধ্যে নিষ্ক্রিয়তা বাড়ছে।
অর্থনীতিবিদ বিনায়ক সেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “১৫ থেকে ২৪ বছর হলো প্রাইম এইজ। এই বয়সের ৪০ শতাংশ তরুণ তরুণী কিছু করছে না, এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়।”
তিনি প্রশ্ন রাখেন, এই বয়সে যদি তারা পড়াশুনা বা কর্মসংস্থানে না থাকে তাহলে তারা করছে কী?
শিক্ষাবিদদের কেউ কেউ বলছেন, বাল্য বিবাহের কারণে অনেক নারীদের আগে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। যে কারণে নারীদের মধ্যে এই হারটা অনেক বেশি।
শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এই সব তরুণ-তরুণীদের অনেকে প্রথাগতভাবে পরিসংখ্যানের ভাষায় কোনও কিছুর মধ্যে নেই। যে সমস্ত জায়গায় তাদের কর্মসংস্থান সে সব জায়গাতেও তাদের সুযোগ কমে গেছে।”
২০২৩ সালের জরিপ রিপোর্ট প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো
নিষ্ক্রিয় তরুণ তরুণীর সংখ্যা কত?
বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সী মানুষের সংখ্যা ৩ কোটি ১৫ লাখ। যার মধ্যে প্রায় ১ কোটি ২৮ লাখই কর্মসংস্থান, শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের বাইরে রয়েছে। যেটিকে অর্থনীতির ভাষায় বলা হয় এনইইটি।
অর্থাৎ এই সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১৯ শতাংশের বেশি। বিবিএস-এর এই জরিপ তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, যারা শিক্ষা কর্মসংস্থান কিংবা কোনও ধরণের প্রশিক্ষণের মধ্যে নেই তাদের বড় অংশের বসবাস গ্রামে। যাদের সংখ্যা ৪১ দশমিক ৩০ শতাংশ।
আর শহরে বসবাসের পরও নিষ্ক্রিয় অবস্থায় আছে ৩৫ দশমিক ২১ শতাংশ।
পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে প্রকাশিত সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে নিষ্ক্রিয় তরুণদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সিলেট বিভাগে। আর সবচেয়ে কম বরিশাল বিভাগে।
বিবিএস-এর হিসেবে সিলেটে ৪৩ দশমিক ৯৮ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৪৩ দশমিক ৭৭ শতাংশ, ময়মনসিংহে ৪০ দশমিক ৫০ শতাংশ, খুলনায় ৩৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ, ঢাকায় ৩৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ, রাজশাহীতে ৩৯ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ, রংপুরে ৩৯ দশমিক ৪ শতাংশ এবং বরিশালে ৩৮ দশমিক ৩২ শতাংশ তরুণ নিষ্ক্রিয়।
অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “গ্রামাঞ্চলে এখনো দেখা যাচ্ছে বড় অংশের নারীদের বাল্য বিবাহ হচ্ছে, সে কারণে বড় একটা অংশ আর জব মার্কেটে আসছে না। তারাও যুক্ত হচ্ছে এই ক্যাটাগরিতে।”
পড়াশোনা বা চাকরিতে নেই দেশের ৪০ ভাগ তরুণ
কী কী কারণে নিষ্ক্রিয়তা?
কাজের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার অভাব, মেয়েদের বাল্য বিয়ে, শিক্ষার মানে ঘাটতি, যথেষ্ট কর্মসংস্থান তৈরি না হওয়া, প্রত্যাশিত কাজ না পাওয়া-সহ বেশ কিছু বিষয়কে মূল কারণ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ।
অর্থনীতিবিদ বিনায়ক সেনের মতে, মেয়েদের মধ্যে একটা বড় অংশের ১৫ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে – এটা একটা মূল কারণ। এ কারণেই পুরুষদের তুলনায় নারীদের নিষ্ক্রিয়তার হার অনেক বেশি।
বিষয়টিকে একটু ভিন্নভাবে বিশ্লেষণ করছেন অর্থনীতিবিদদের কেউ কেউ।
তারা বলছেন, নারীদের বড় একটা অংশ গৃহস্থালির কাজের সাথে জড়িত। কিন্তু বিভিন্ন কারণে নারীদের এই গৃহস্থালির কাজকে কর্মক্ষেত্রে যুক্ত করা যাচ্ছে না, যে কারণে এই পরিমাণ এত বেশি মনে হচ্ছে।
অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বিবিসি বাংলাকে বলছেন, “আমাদের দেশে নারী বান্ধব কর্ম পরিবেশ রয়েছে। তারপরও সামাজিক কারণে নারীর কাজকে গৃহস্থালির কাজ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া সম্ভব হয়নি। এ কারণে নারী স্বাচ্ছন্দ্যে কাজে অংশ গ্রহণ করতে পারছে না।”
এর বাইরে আরো কিছু কারণকেও গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন শিক্ষাবিদ ও বিশ্লেষকরা। তারা মনে করেন, দেশের উন্নয়নের পাশাপাশি এসব ক্ষেত্রে আরো বেশি ভালো করার সুযোগ থাকলেও নানা কারণে তা সম্ভব হয়নি।
শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “কোভিড, ক্লাইমেট চেঞ্জ ও কনফ্লিক্ট – এই তিনটা হলো মূল কারণ।”
“এসব কারণে পৃথিবীর মধ্যে একটা ওলট পালট হয়ে গেছে। বিভিন্ন ধরণের বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে গেছে বাংলাদেশ। যা বাংলাদেশকেও নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে।”
প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়েনি বাংলাদেশের সাক্ষরতার হার
প্রত্যাশা অনুযায়ী সাক্ষরতা বাড়ছে না
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো সাক্ষরতার হার নিয়েও তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে আগের বছরের তুলনায় সাক্ষরতার হার বেড়েছে মাত্র এক শতাংশ।
অর্থাৎ ২০২২ সালে যেখানে সাক্ষরতার হার ছিলো ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ ছিলো, বর্তমানে সেটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৫ দশমিক ৬ শতাংশ।
এই জরিপ রিপোর্ট বলছে, সাক্ষরতার হারের দিক থেকে নারীদের তুলনায় এগিয়ে পুরুষরা।
পুরুষদের ৭৮ দশমিক ছয় শতাংশের বিপরীতে ১৫ বছরের বেশি বয়স্ক নারীদের সাক্ষরতার হার ৭২ দশমিক ৮ শতাংশ।
সাক্ষরতার হার গ্রাম এলাকার চেয়ে শহরে বেশি। পরিসংখ্যান ব্যুরোর এই জরিপ তথ্য বলছে, গ্রামে ৭২ দশমিক ৯ শতাংশ সাক্ষরতার বিপরীতে শহরে এই হার ৮৩ দশমিক ৯ শতাংশ।
সাক্ষরতার হার বিবেচনায় শহরের মতোই পিছিয়ে রয়েছে গ্রামের নারীরাও। গ্রামীণ নারীদের ৭০ দশমিক ১ শতাংশ সাক্ষরতার হারের বিপরীতে শহরের নারীদের সাক্ষরতার হার ৮১ দশমিক ২ শতাংশ।
ঐ জরিপ রিপোর্ট বলছে, ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা আগের দুই বছরের তুলনায় কমলেও ২০১৯ ও ২০ সালের হিসেবে অনেক বেড়েছে। ২০২০ সালে যেখানে ৫ থেকে ২৪ বছর বয়সীদেরে মধ্যে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১ দশমিক ৭১ শতাংশ। ২০২৩ সালে এসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ।
শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এই সাক্ষরতার হার আরো বৃদ্ধি পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু জীবনব্যাপী সাক্ষরতার ব্যাপারে গুরুত্ব না দেওয়ার কারণেই সাক্ষরতার হার সেভাবে বাড়ছে না।”
কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয় উচ্চশিক্ষা নেয়া নারী শিক্ষার্থীদের
বিআইডিএসের গবেষণা
দেশের উচ্চশিক্ষা ও বেকার ব্যবস্থা নিয়ে একই দিন একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলো থেকে পাস করার তিন বছর পরও ২৮ দশমিক ২৪ শতাংশ শিক্ষার্থী বেকার থাকছেন।
এতে আরো বলা হয়েছে, এসব কলেজ থেকে পাস করা ৪২ দশমিক ২৯ শতাংশ শিক্ষার্থী নির্দিষ্ট বেতনে চাকরি করছেন।
এ ছাড়া ১৬ দশমিক ২০ শতাংশ আত্মকর্মসংস্থানে আছেন এবং ১৩ দশমিক ২২ শতাংশের বেশি খণ্ডকালীন কাজ করছেন।
যে ২৮ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থী বেকার তাদের মধ্যে বেশির ভাগই বিএ (পাস) ডিগ্রিধারী।
এ ছাড়া রাষ্ট্রবিজ্ঞান, লাইব্রেরি ব্যবস্থাপনা, বাংলা, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীদের মধ্যেও বেকারের হার তুলনামূলক বেশি বলে জানানো হয় ঐ রিপোর্টে। যাদের মধ্যে একটা বড় অংশ রয়েছে নারী।
বিআইডিএসের এই গবেষণায় দেখা গেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যারা বিভিন্ন চাকরিতে আছে তাদের বেশির ভাগই শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট কর্মে নিয়োজিত আছেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ তৈরি পোশাক খাতের নিচু পদেও চাকরিতে আছেন।
বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐসব শিক্ষার্থী যে দক্ষতা অর্জন করছে তা চাকুরিতে যাওয়ার জন্য জন্য যথেষ্ট নয়। এ কারণেই তাদের বড় একটা অংশ উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পরও বেকার থাকছে।”
তাদের যোগ্যতা বাড়াতে ইন্টারনেট ও কম্পিউটারের প্রশিক্ষণ, বাংলা ও ইংরেজিতে দক্ষতা বাড়ানোরও পরামর্শ এই অর্থনীতিবিদের।
-বিবিসি নিউজ বাংলা
Leave a Reply