শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৬:৫৪ পূর্বাহ্ন

কক্সবাজারের রোহিঙ্গারা: ৪৫ বছর পর

  • Update Time : বুধবার, ২৭ মার্চ, ২০২৪, ১১.০০ এএম

টনি ওয়াটার্স এবং আর.জে. অং

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা নিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী উদ্বেগ প্রকাশ করার এক মাস পরফেব্রুয়ারি ৭ তারিখে মায়ানমারের ইউএনএইচসিআর প্রতিনিধিরা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা করতে সেনা সরকারের শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এদিকেবাংলাদেশের কর্মকর্তারা সেনাবাহিনী এবং জাতিগত আরাকান সেনার মধ্যে পক্ষ নেওয়ার মতো কোনো কাজ করতে অনিচ্ছুক। বাংলাদেশ হয়তো এখন বুঝতে পেরেছে নাফ নদীর অপর পারে রাখাইনে নতুন শাসক এসেছে।

কিন্তু আরাকান আর্মির জয়লাভ ইউএনএইচসিআর এবং মায়ানমার ও বাংলাদেশ সরকারের দ্বারা প্রচারিত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে কী অর্থ বহন করেআমাদের উত্তর হলো৪৫ বছরের নির্যাতনের পর রোহিঙ্গাদের জন্য এটা খুব একটা অর্থবহ নয়। রোহিঙ্গারাও জানে যে তারা পালিয়ে আসার পর থেকেই আসলে রাখাইনে নিরাপত্তার অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে।

কক্সবাজারে বসবাসরত এক মিলিয়ন নিরাপত্তাহীন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবস্থা এখনো পৃথিবীতে সবচেয়ে জটিল শরণার্থী সমস্যাগুলির মধ্যে একটি। তাদের স্বদেশ মায়ানমার পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে তারা বাংলাদেশ থেকে আসা বিদেশীতাদের আশ্রয়দাতা বাংলাদেশ বলছে তারা মায়ানমারের নাগরিকযেখানে তাদের জন্ম। বিদ্রোহী আরাকান আর্মি বলছে শর্ত সাপেক্ষে তারা নতুন রাখাইনের অংশ হতে পারবেকিন্তু সমান অধিকারের সাথে নয়। এর উপরেসেনাবাহিনীর জান্তা শাখা আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য মায়ানমারে অবশিষ্ট কিছু রোহিঙ্গাকে নিয়োগ করতে শুরু করেছে।

ইতিমধ্যেজাতিসংঘ থেকে মানবিক সাহায্যকারীরা অনেকে হতাশ হয়ে পড়েছে তাইশত শত রোহিঙ্গা সমুদ্রে ডুবে মরছেআরাকান আর্মি বাহিনী বাংলাদেশের সীমান্ত পোস্ট দখল করে নিয়েছে এবং সিটুয়ে শহরও অবরোধের মধ্যে পড়তে পারে – এসব সত্ত্বেও মায়ানমারবাংলাদেশ ও ইউএনএইচসিআর তৃতীয় দেশে পুনর্বাসন প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাচ্ছে। তারা শুধু বলছে, “রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিরাপদে ও মর্যাদার সাথে বসবাসের জন্য এবং একটি টেকসই প্রত্যাবর্তনের প্রস্তুতির জন্য নিয়মিতপর্যাপ্ত ও প্রত্যাশিত আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন।”

এটা হয়তো আশার কথা হতে পারতযদি না ১৯৭৮  সালে রোহিঙ্গা শরণার্থী আন্দোলনে প্রথম ইউএনএইচসিআর জড়িত হওয়ার সময় থেকে আগেও এই স্বেচ্ছামূলক প্রত্যাবাসন নীতি ব্যর্থ হয়ে যেত। টাটমাডো বারবার রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করেছে বার্মিজেশন নীতি জোরদার করার উদ্দেশ্যেযা ১৯৬২ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর গ্রহণ করা হয়েছিল।

টাটমাডোর নির্যাতনবিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে আদিম বর্বরতা বলে গণ্য?

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে রোহিঙ্গারা রাখাইনে বসবাস করেছে। ১৮২৪ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আগমনের আগে থেকেই তারা সেখানে ছিল। ১৮২৪ থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকরা আরও অনেক রোহিঙ্গাকে কৃষিকাজ করার জন্য নিয়ে এসেছিল। তাদের অনেকেই ছিল মুসলিম কিন্তু ধর্মীয় বিভিন্ন অনুশীলনে অংশগ্রহণ করত যা পার্শ্ববর্তী ব্রিটিশ বাংলায়ও দেখা যেত।

১৯৬২ সালেনে উইন শাসনের চরম জাতীয়তাবাদী বৌদ্ধ বাহিনী ক্ষমতা দখল করে এবং ঘোষণা দিল রোহিঙ্গারা নাগরিকত্ব পাবে না যদি না প্রমাণ করতে পারে যে তাদের পূর্বপুরুষরা ১৮২৪ সালের ব্রিটিশ বিজয়ের আগে থেকেই রাখাইনে ছিল। জেনারেল নে উইনের সেনাবাহিনী জোর দিল যে রোহিঙ্গারা বিদেশী এবং ১৯৭৮ সালে ২ লক্ষ রোহিঙ্গাকে গণ বিতাড়ন শুরু করে। ইউএনএইচসিআর-এর সহায়তায় দ্রুত প্রত্যাবাসন হয়। একজন অভিজ্ঞ জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক মন্তব্য করেন যে ক্যাম্পগুলোতে খাদ্য ও প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার অভাবে তারা “মৃত্যুর ফাঁদ” হয়ে উঠছেযার ফলে অধিকাংশকে মায়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়।

একইরকম ঘটনা ১৯৯০ সালেও ঘটে যখন সেনাবাহিনী ২.৫ লক্ষ রোহিঙ্গাকে বিতাড়িত করে। এটি করা হয় ১৯৮৮ সালের গণতন্ত্র বিরোধী আন্দোলনের দিকে জাতীয়তাবাদী বার্মিজদের মনোযোগ ভিন্নমুখী করার জন্য ইসলামভীতি ব্যবহার করে। ১৯৭৮ সালের মতোইইউএনএইচসিআর-এর সহায়তায় একটি দ্রুত প্রত্যাবাসন ব্যবস্থা করা হয়।

২০১২ সালে ইতিহাস আবারও পুনরাবৃত্তি হয় যখন রাখাইন আবার রোহিঙ্গামুক্ত করা হয়। এবার মায়ানমারে প্রত্যাবাসন তেমন জোরালো ছিল না কিন্তু কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির আরও বড় হয়ে ওঠে। অবশেষে ২০১৭ সালেবার্মিজ সেনাবাহিনী কর্তৃক সবচেয়ে বড় বিতাড়ন অভিযান চালানো হয় এবং গ্রাম পুড়িয়েগণহত্যা ঘটিয়ে রাখাইনকে রোহিঙ্গামুক্ত করার পর আরও প্রায় ৮ লক্ষ রোহিঙ্গা পালিয়ে যায়। তারপরওএখন ৭ বছর পরেওআন্তর্জাতিক সাড়া দ্বিধাগ্রস্ত। প্রতি বছর ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শিশুর জন্ম হচ্ছে শরণার্থী শিবিরে আর লক্ষ লক্ষ শিশু বড় হচ্ছে এমন পরিবেশে যেখানে চরমপন্থা একটি প্রত্যাশিত পার্শ্বফল।

ঐতিহাসিক আখ্যানের ধর্মান্ধতায় আটকে

শেষ পর্যন্ত রোহিঙ্গারা প্রতিদ্বন্দ্বী ও জটিল ঐতিহাসিক আখ্যানের মাঝে আটকে পড়ে।

মায়ানমারের জাতীয়তাবাদী বার্মিজেশন আখ্যান এখনও জোর দিয়ে বলে যে মায়ানমারের জনগোষ্ঠীকে সরকারের নির্ধারিত জাতিগোষ্ঠী হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়যাদেরকে শাসক বৌদ্ধ বার্মার সংখ্যাগরিষ্ঠের উপদল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই সংজ্ঞা অনুসারেরোহিঙ্গারা হলো ব্রিটিশ বাংলা থেকে আগত বিদেশী এবং অনুপ্রবেশকারী। 

টনি ওয়াটার্স লিউফানা বিশ্ববিদ্যালয়জার্মানি এবং পূর্বে পাইয়াপ বিশ্ববিদ্যালয় চিয়াং মাইয়ের ভিজিটিং অধ্যাপক। আর.জে. অং (ছদ্মনাম) ইয়াঙ্গুন ও থাইল্যান্ডে কর্মরত সাবেক শান্তি ও উন্নয়ন কর্মী এবং ইয়াঙ্গুনের বাসিন্দা।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024