সারাক্ষণ ডেস্ক
চীনা কর্মীদের নিরাপত্তা বাড়াতে ইসলামাবাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বেইজিং। বিশ্লেষকরা বলছেন, মারাত্মক হামলার পর পাকিস্তানে চীনা স্বার্থে অনেক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বেইজিংয়ের বহু বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ রয়েছে পাকিস্তানে। ইসলামাবাদের উপর নিরাপত্তা দাবি আরও বাড়ানোর জন্য চাপ দিয়েছে চীন।
গত মঙ্গলবার (২৬ মার্চ ) লাহোর থেকে প্রায় ২৭০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে বেশামে একটি আত্মঘাতী হামলায় পাঁচজন চীনা প্রকৌশলী এবং তাদের পাকিস্তানি চালক মারা যায়। ক্ষতিগ্রস্তরা চীন সমর্থিত ৪৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন উন্নয়নের কাজে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে যাচ্ছিল। সহিংসতার কারণে ৪.২ বিলিয়ন ডলারের প্রকল্পের নির্মাণ কাজ বন্ধ রয়েছে। বেশামের ঘটনাটি ছিল মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে চীনা স্বার্থের উপর তৃতীয় মারাত্মক হামলা। যদিও এখনো পর্যন্ত কোনো গোষ্ঠীই বেশাম হামলার দায় স্বীকার করেনি।
গত সপ্তাহে দক্ষিণ-পশ্চিম পাকিস্তানে গদর বন্দর কর্তৃপক্ষ কমপ্লেক্স এবং একটি নৌ বিমান ঘাঁটিতে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা আলাদাভাবে হামলা চালিয়েছিল। । গদর চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের (সিপিইসি) একটি ভিত্তি। যা বেইজিংয়ের বিশ্ব-বিস্তৃত অবকাঠামোগত বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) উপর অনেক বড় ধাক্কা।
“দ্য মেকিং অফ পাকিস্তানি হিউম্যান বম্বস”-এর লেখক খুরাম ইকবাল বলেছেন, সর্বশেষ হামলাটি ভাড়া করা জিহাদিদের কাজ হতে পারে। তিনি বলেন, ‘তারা এক (জঙ্গি) সংগঠন থেকে অন্য সংগঠনে চলে যায়। আদর্শিক কারণে খুব কমই জিহাদ করে। “বরং, তারা প্রায়ই আর্থিক প্রণোদনার জন্য ব্যবহারিকভাবে কাজ করে।”
বেইজিং বারবার ইসলামাবাদকে তার নাগরিক এবং বিনিয়োগের সুরক্ষার জন্য আরও বেশি কিছু করার আহ্বান জানিয়েছে। পাকিস্তানে চীনা দূতাবাস বেশাম হামলার তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তারা পুরোপুরিভাবে তদন্তের দাবি জানিয়েছে।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুনিং এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমরা পাকিস্তানকে চীনা নাগরিক, প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পগুলোর নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে বলছি। জবাবে পাকিস্তান এই হামলার তদন্তের জন্য একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেছে।
ইসলামাবাদের কায়েদ-ই-আজম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক মুহম্মদ শোয়েব বলেন, “২০২১ সালে একই অঞ্চলে হামলায় নয়জন চীনা প্রকৌশলী নিহত হন। এবং এখন এই হামলার মাধ্যমে এটি বোঝা যাচ্ছে যে, ভয়াবহ নিরাপত্তা ত্রুটি আছে। তিনি আরও বলেন, ‘হামলার তীব্রতা এবং ফ্রিকোয়েন্সি বৃদ্ধি ছাড়াও, চীনাদের সবচেয়ে বেশি চিন্তার বিষয় হচ্ছে- একাধিক স্তরের নিরাপত্তা সত্ত্বেও তাদের লোকদের হত্যা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই নিরাপত্তা ত্রুটিগুলো দুই দেশের মধ্যে নতুন অর্থনৈতিক ব্যস্ততা বন্ধ করার হুমকি দেয়। এই মাসে ইসলামাবাদে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পরে চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য বেইজিংয়ের পরিকল্পনাকে প্রভাবিত করতে পারে। পাকিস্তানের সরকারি সূত্র থেকে জানা যায়, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার করতে এপ্রিলে চীন সফর করবেন। তবে আত্মঘাতী হামলা সম্ভবত শরিফের অর্থনৈতিক এজেন্ডায় প্রভাব ফেলবে।
অধ্যাপক শোয়েব বলেন, ‘চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের কোনো বড় ধরনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক হয়তো আর থাকবে না। চীন পাকিস্তানের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নিয়েও উদ্বিগ্ন। আর এখন নিরাপত্তার যে পরিস্থিতি তার জন্য অর্থনৈতিক সম্পর্ক একদম শেষ করার দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হতে পারে।”
ওয়াশিংটন ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ধারাবহিক এই হামলার কারনে নতুন করে চীনা বিনিয়োগ না পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। গত দুই বছরে, ইসলামাবাদ চীনা নাগরিক এবং বিনিয়োগের সুরক্ষার জন্য নিজস্ব নিরাপত্তা কর্মী আনার জন্য বেইজিংয়ের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছে।
কুগেলম্যান বলেন, “চীন তার নিজস্ব নিরাপত্তা কর্মীদের আনার দাবি করতে খুব বেশি সময় নেবে না। এই হামলার পরে চীনা নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে, পাকিস্তান প্রতিবেশী আফগানিস্তানের উপর চাপ বাড়াবে । কারণ ইসলামাবাদ তার মাটিতে বেশিরভাগ জঙ্গি হামলার উৎস হিসেবে দেখছে আফগানিস্তানকে।”
ইসলামাবাদ ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সানোবার ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক কামার চিমা বলেন, “তালেবানরা (আফগানিস্তানে) ক্রমাগত (পাকিস্তানি তালেবান ও বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের) আশ্রয় দিচ্ছে। আফগানিস্তানে জঙ্গি সংগঠনগুলোর বিষয়ে দুই দেশের ভিন্ন নীতি রয়েছে। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সুসংহত থাকতে পাকিস্তানকে চীনাদের সঙ্গে একমত হতে হবে।”
নিক্কেই এশিয়া অবলম্বনে
Leave a Reply