জয় চৌধুরী
২০২৪ একুশে বইমেলায় সপ্তর্ষি প্রকাশনী থেকে বের হয়েছে গল্পের বই ” উত্তরের দেশে”। কবি ও কথাসাহিত্যিক ভজন সরকারের এটা পঞ্চম গ্রন্থ। ভজন সরকার যে একজন কবি সে প্রমান তাঁর কাব্যিক গদ্য লেখনিতে বোঝা যায়। এবারের বইটিতেও সে সাক্ষর মেলে। তাই তো ভজন সরকার ফারাক্কা নদীর বাঁধের ওপর দিয়ে যেতে যেতে জলবন্টনের বৈষ্যমে ব্যথিত হোন। মনে পড়ে তাঁর দেশ, তাঁর জন্মভুমি বাংলাদেশের কথা।
লেখক বিশ্বাস করেন একদিন তাঁর বাংলাদেশও উন্নত হবে মনে ও মননে। স্বাধীনতার এবং মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় আবার বাংলাদেশ জেগে উঠবে। কাজী নজরুল কিংবা রবীন্দ্রনাথ যে জাতির চেতনায় সে জাতিকে সীমান্তের কাঁটাতার দিয়ে কি বিভক্ত করা সম্ভব? তাই ভজন সরকারের “উত্তরের দেশে” গল্পগ্রন্থটি দেশত্যাগের গল্প হয়েও হয়ে উঠেছে এপার বাংলা – ওপার বাংলার সম্প্রীতি সূত্র। বইটি এক কথায় অসাধারণ এবং অনন্য সাধারণ। বইটি যে বাংলাসাহিত্যের এক অকথিত কিংবা স্বল্প-কথিত অধ্যায়কে উন্মোচন করেছে সে কথা নিশ্চিত করে বলা-ই যায়।
বইটির ১৫টি গল্পের চরিত্র ভিন্ন, কাহিনি-উপজীব্য ভিন্ন। কিন্তু প্লাটফর্ম এক এবং অভিন্ন। তা হলো ধর্ম এবং ধর্মবিশ্বাসী মানুষের বিভক্তি এবং সে বিভাজনের অনিবার্য অথচ চাতুর্যময় ফল দেশভাগ, দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগ; এ দেশভাগের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু জনগোষ্ঠীর দেশত্যাগ।
ভজন সরকারের লেখা এ গল্পগুলো দেশত্যাগের। গল্পগুলো শেকড় উপড়ানোর। গল্পগুলো অভিবাসনের; খুব সত্যি ক’রে বললে জোরপূর্বক অভিবাসনের। গল্পগুলোর ভেতর বয়ে চলে এক নিরন্তর কান্নার ফল্গুনদী। গল্পগুলো আমাদের উপমহাদেশ তো বটেই কখনও কখনও উপমহাদেশ ছাড়িয়েও বের করে আনে ধর্মীয় বিভাজন রেখার কঙ্কালসার অস্থিমজ্জা। গল্পগুলো তাই হয়ে ওঠে দেশত্যাগী সকল মানুষের মহাকাব্য, অভিবাসনের নির্মম অথচ বাস্তব চিত্রনাট্য।
“পরিযায়ী জীবন”-এর বড় শিকদারের জীবনে ভাগ্য বিড়ম্বনা ব্যথিত করে পাঠকের মন।”আটাশ বছর পরে” গল্পের বেনু শিক্ষক বাবার একমাত্র মেয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মেয়েকে রেখে ভারতে চলে যায় তাঁর পরিবার। আটাশ বছর পরে বেনু তাঁর বাড়িতে ফেরে। নিজের বাড়িটা তখন রাবেয়াদের।
“যুগল কাপালি” গল্পটি এক নিঃসন্তান দম্পত্তির টানাপোড়েনের গল্প। হঠাৎ এক সকালে দেখে দেবরটি পাশের গ্রামের এক মুসলমানের কাছে জমি-বাড়ি বিক্রি করে তাঁর স্ত্রী-সন্তান নিয়ে দেশত্যাগ করেছে।
“শত্রু-সম্পত্তি” গল্পের ভবেশ প্রামানিকের মুক্তিযোদ্ধা ভাই নরেশ প্রামানিক একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। নরেশ প্রমানিক স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতার অত্যাচারের প্রতিবাদ করার পর থেকে তাঁর আর খোঁজ মেলে না। একদিন নরেশ প্রমানিকের সম্পত্তি শত্রু সম্পত্তি হিসেবে ঘোষিত হয়।
“এখনও যোগেন মন্ডল” কিংবা “সেন নেত্রালয়” গল্পগুলো পড়তে পড়তে মনে হয় এ যেন বাংলাদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর চালচিত্র এক চিত্রকর তাঁর নিপুন হাতে এঁকে যাচ্ছেন। স্মৃতিবিভ্রম দাদু কিংবা গৌর সেন সবাই যেন অনেক আগের দেশভাগ এবং সমসাময়িক উগ্র ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার বাড়বাড়ন্তেরই নিখুঁত কাহিনি চিত্র।
“কাঁটাতারের এপার-ওপার” গল্পটি সীমান্তের দুই পাশের এক মর্মন্তুদ কাহিনি, যা লেখক নিজে সাংবাদিক না হয়েও এমনভাবে বর্ণনা করেছেন যে, মনে হয় এ যেন এক দক্ষ সাংবাদিকের অভিজ্ঞতার বর্ণনা।
“৭১-এর খোঁজে” গল্পটি ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নে’য়া ভারতীয় সেনাবাহিনির নিহত এক ক্যাপ্টেনের পুত্র সন্তানের গল্প।
“সুধীর যোশী”-র গল্পটি একটু ভিন্ন প্রেক্ষাপটের। ভারত থেকে প্রবাসী হয়ে আসা এক মানুষের জীবন সংগ্রামের গল্প, যে গল্প লেখককে অনুপ্রাণিত করেছিল। গল্পটি পাঠ করতে করতে পাঠক এশিয়া মহাদেশ ছাড়িয়ে চলে যান কানাডার এক আদিবাসী অধ্যুসিত এলাকায়। বিশ্বায়ণের এ গল্পে অভিবাসনের নানা দিক পাঠককে মুগ্ধ করে। এমন আরও দু’টি গল্প “গল্পের তুমি ও আশরাফ আল এলাহি“ এবং “হঠাৎ আলোর ঝলকানি”। এ গল্প দু’টোর প্রেক্ষাপটও উত্তর আমেরিকা, যা পাঠকের ভালো লাগবেই।
পরের গল্পগুলো পাঠককে রবীন্দ্রনাথ থেকে পাবলো নেরুদা, শক্তি চট্রোপাধ্যায় থেকে সমরেশ মজুমদার ছুঁইয়ে আনে। দার্জিলিং -এর সৌন্দর্য, কখনও ডোয়ার্সের চা-বাগানের সবুজ, আদিবাসীদের মাদল কিংবা ঢাকার নিউ পল্টনের অঝর বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে পাঠকের মনও সিক্ত হয় ভালোবাসায়; সে ভালোবাসা প্রকৃতির প্রতি, মানুষের প্রতি এবং মানুষের বাসস্থান এ পৃথিবীর প্রতি। এক কথায় দেশত্যাগের গল্প ” উত্তরের দেশে” গল্পগ্রন্থটি পাঠকনন্দিত হবে সে প্রত্যাশা করি।
বই পরিচিতিঃ
বইঃ দেশত্যাগের গল্প “ উত্তরের দেশে”
লেখকঃ কবি ও কথাসাহিত্যিক ভজন সরকার
প্রচ্ছদঃ আল নোমান
প্রকাশকঃ শিবু ওঝা
প্রকাশনায়ঃ সপ্তর্ষি
প্রাপ্তিস্থানঃ একুশে বইমেলা, ২০২৪, স্টল নম্বর ৬৮
জয় চৌধুরীঃ লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী।
Leave a Reply