শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৯:৪৬ পূর্বাহ্ন

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ২২ তম কিস্তি )

  • Update Time : শনিবার, ৩০ মার্চ, ২০২৪, ১২.০০ পিএম
রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যে আরেকটি নতুন যুগ সৃষ্টি হয়েছিলো। ভাষাকে মানুষের মুখের ভাষার কাছে নিয়ে আসা নয়, সাহিত্যে’র বিষয়ও হয়েছিলো অনেক বিস্তৃত। সাহিত্যে উঠে এসেছিলো পরিবর্তিত মন ও সমাজের নানান প্রাঙ্গন। সময়ের পথ ধরে সে যুগটি এখন নিকট অতীত। আর সে সাহিত্যও চিরায়ত সাহিত্য। দূর অতীত ও নিকট অতীতের সকল চিরায়ত সাহিত্য মানুষকে সব সময়ই পরিপূর্ণ মানুষ হতে সাহায্য করে। চিরায়ত সাহিত্যকে জানা ছাড়া বাস্তবে মানুষ তার নিজেকে সম্পূর্ণ জানতে পারে না।

সারাক্ষণের চিরায়ত সাহিত্য বিভাগে এবারে থাকছে মানিক বন্দোপধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য।

দিবারাত্রির কাব্যে’র ভূমিকায় মানিক বন্দোপধ্যায় নিজেই যা লিখেছিলেন …..

দিবারাত্রির কাব্য আমার একুশ বছর বয়সের রচনা। শুধু প্রেমকে ভিত্তি করে বই লেখার সাহস ওই বয়সেই থাকে। কয়েক বছর তাকে তোলা ছিল। অনেক পরিবর্তন করে গত বছর বঙ্গশ্রীতে প্রকাশ করি।

দিবারাত্রির কাব্য পড়তে বসে যদি কখনো মনে হয় বইখানা খাপছাড়া, অস্বাভাবিক,- তখন মনে রাখতে হবে এটি গল্পও নয় উপন্যাসও নয়, রূপক কাহিনী। রূপকের এ একটা নূতন রূপ। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের Projection-মানুষের এক এক টুকরো মানসিক অংশ।


দিবা রাত্রির কাব্য

মানিক বন্দোপাধ্যায়


নিঃশব্দে সময় অতিবাহিত হয়ে যায়। তারা চুপ করে বসে থাকে। আনন্দকে চমকে দেবার ভয়ে হেরম্ব নড়তে সাহস পায় না; জোরে নিশ্বাস ফেলতে গিয়ে চেপে যায়। আকাশে চাঁদ গতিহীন। আনন্দের নাচের প্রতীক্ষায় হেরম্বের মনেও সমস্ত জগৎ স্তব্ধ হয়ে গেছে।

তারপর এক সময় আনন্দ উঠে গেল। ঘাসে-ঢাকা জমিতে গিয়ে চাঁদের দিকে মুখ করে সে হাঁটু পেতে বসল। প্রণামের ভঙ্গীতে মাথা মাটিতে নামিয়ে দু’হাত সম্মুখে প্রসারিত করে স্থির হয়ে রইল।

আনন্দ কতক্ষণ নৃত্য করল হেরম্বের সে খেয়াল ছিল না।

চাঁদের আলো তার চোখে নিভে নিভে ম্লান হয়ে এসেছিল নাচের গোড়াতেই। এটা তার কল্পনা অথবা আকাশের চাঁদকে মেঘে আড়াল করেছিল, হেরম্ব বলতে পারবে না। কিন্তু শ্লথ, মন্থর গতিছন্দ থেকে আনন্দের নৃত্য চঞ্চল হতে চঞ্চলতর হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে জ্যোৎস্নাও যে উজ্জ্বল হতে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠেছিল একথা হেরম্ব নিঃসংশয়ে বলতে পারে। হয়তো চোখে তার ধাঁধা লেগেছিল। হয়তো চন্দ্রকলা-নৃত্যের শোনা ব্যাখ্যাটি তার মনে প্রভাব বিস্তার করেছিল।

পূর্ণিমা থেকে আনন্দ কিন্তু অমাবস্যায় ফিরে যেতে পারেনি। নৃত্য যখন তার চরম আবেগে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে, তার সর্বাঙ্গের আলোড়িত সঞ্চালন এক ঝলক আলোর মতো প্রখর দ্রুততায় হেরম্বের বিস্ময়চকিত দৃষ্টির সামনে চমক সৃষ্টি করেছে, ঠিক সেই সময় অকস্মাৎ সে থেমে গেল।

ঘাসের উপর বসে তাকে হাঁপাতে দেখে হেরম্ব তাড়াতাড়ি উঠে তার কাছে গেল।

‘কি হল, আনন্দ?’

‘ভয় করছে।’ আনন্দ বলল। রুদ্ধস্বরে, কান্নার মতো করে।

সে থরথর করে কাঁপছে। তার মুখ আরক্ত, সর্বাঙ্গ ঘামে ভেজা। তার দু’চোখে উত্তেজিত অসংযত চাহনি। চুলগুলি তার মুখে এসে পড়ে ঘামে জড়িয়ে গিয়েছিল। চুল পিছনে সরিয়ে হেরম্ব তার কানের পাশে আটকে দিল। তাকে দম নেবার সময় দিয়ে বলল, ‘ভয় করছে? কেন ভয় করছে, আনন্দ?’

আনন্দ বলল, ‘কি জানি। মনে হল, এইবার আমি মরে যাব। আজ কেন যে এরকম করে উঠল! হঠাৎ সমস্ত শরীর আমার কেমন করে উঠল! মরে যেতে আমার কখনও ভয় হয়নি। অন্য দিন নাচের পর ঘুম আসে। আজ

শরীর জ্বালা করছে।’

‘গরম লাগছে?’

না। ঝাঁজের মতো জ্বালা করছে-হাড়ের মধ্যে। আমি এখন কি করি! কেন এই রকম হল?’

‘একটু বিশ্রাম করলেই সেরে যাবে। শোবে আনন্দ? শুয়ে পড়লে হয়তো-‘

আনন্দ হেরম্বের কোলে মাথা রেখে ঘাসের উপর শুয়ে পড়ল। তার নিশ্বাস ক্রমে ক্রমে সরল হয়ে আসছে, কিন্তু মুখের অস্বাভাবিক উত্তেজনার ভাব একটুও কমেনি। হেরম্বের চোখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকতে থাকতেই তার দু’চোখ জলে ভরে গেল।

‘এরকম হল কেন আজ? তোমার জন্যে?’

‘হতে পারে। আমি তো সহজ লোক নই। পৃথিবীতে আমার জন্যে অনেক কিছুই হয়েছে।’

অন্ধ যেভাবে আশ্রয় খোঁজে, আনন্দ তেমনি ব্যাকুল ভঙ্গীতে তার দুটি হাত বাড়িয়ে দিল। হেরম্বের হাতের নাগাল পেতেই শক্ত করে চেপে ধরে

সে যেন একটু স্বস্তি পেল। ‘ঠিক করে কিছুই বুঝতে পারছি না। আরও যেন কত কি দুঃখ একসঙ্গে ভোগ করছি। আচ্ছা তুমি তো কবি, তুমি কিছু বুঝতে পারছ না?’

‘আমি কবি নই, আনন্দ। আমি সাধারণ মানুষ।’

আনন্দ তার এই সবিনয় অস্বীকারের প্রতিবাদ করল।

‘তুমি আমার কবি। কবি না হলে কেউ এমন ঠাণ্ডা হয়? সন্ধ্যার সময় তোমাকে দেখেই আমি চিনেছিলাম। তুমি না থাকলে আমি এখন এখানে গড়াগড়ি দিয়ে কেঁদে নাচের জ্বালায় জ্বলে জ্বলে মরে যেতাম।’

‘জ্বালা কমেনি আনন্দ?’

‘কমেছে।’

‘নাচ শেষ করবে?’

‘না। নাচ শেষ করে ঘুমোবে কে? তার চেয়ে এ কষ্টও ভাল। ঘুম তো মরে যাওয়ার সমান, শুধু সময় নষ্ট।’

আনন্দ হঠাৎ উৎকর্ণ হয়ে বলল, ‘ক’টা বাজল? অনেক দূরে থানায় ঘণ্টা

বাজছে। ক’টা বাজল শুনলে?’

হেরম্ব বলল, ‘ও ঘণ্টা ভুল, আনন্দ। এখন ঠিক মাঝরাত্রি।’

আনন্দ বলল, ‘তাই হবে, চাঁদটা আকাশের ঠিক মাঝখানে এসেছে।’ ওইখানে, আকাশের চাঁদের কাছে পৌঁছে, আনন্দ একেবারে নির্বাক হয়ে

গেল। হেরম্বের দেহের আশ্রয়ে নিজের দেহকে আরও নিবিড়ভাবে সমর্পণ করে সে আকাশের নিষ্প্রভ তারা আবিষ্কারের চেষ্টা করতে লাগল।

হেরম্ব এখন তাও জানে। তাই তার গালের উত্তেজনা, তার চিবুকের…………।

 

 

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ২১ তম কিস্তি )

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ২১ তম কিস্তি )

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024