বাংলাদেশের পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপ অনুযায়ী দেশে মানুষের গড় আয়ুর পাশাপাশি নারীর প্রজনন হার এবং জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার কমেছে, আর পাশাপাশি বেড়েছে বাল্য বিয়ে এবং শিশু মৃত্যুর হার। একই সাথে এই জরিপে উঠে এসেছে যে দেশে প্রাপ্তবয়স্ক হয়েও বিয়ে না করা পুরুষের সংখ্যা প্রায় ৩৬ শতাংশ।
গত দশ বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হার ক্রমান্বয়ে কমেছে।
জরিপে উঠে এসেছে যে দেশে বয়স্ক পুরুষের সংখ্যা সামান্য বেড়েছে। তবে কিছুটা হলেও কমেছে বিবাহিত দম্পতির মধ্যে তালাক বা বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পপুলেশন সায়েন্সেসের অধ্যাপক ডঃ মোঃ মঈনুল ইসলাম বলছেন সরকারি এই রিপোর্টে যা উঠে এসেছে তাতে মূলত দেশের স্বাস্থ্য খাতের করুণ চিত্রই প্রতিফলিত হয়েছে।
এর ফলে বাংলাদেশ যে ‘ট্রিপল জিরো কমিটমেন্ট’, অর্থাৎ ২০৩০ সালের মধ্যে পরিবার পরিকল্পনার অপূর্ণ চাহিদা (শতভাগ দম্পতিকে পরিবার পরিকল্পনার আওতায় আসা), মাতৃমৃত্যু ও বাল্য বিবাহ-সহ জেন্ডার ভিত্তিক সহিংসতা শূন্যতে নামিয়ে আনার যে অঙ্গীকার করেছিল তার অর্জন দুরূহ হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করেন মি. ইসলাম।
কেনিয়ার নাইরোবিতে ২০১৯ সালে জনসংখ্যা ও উন্নয়ন সম্মেলনের পঁচিশ বছর পূর্তিতে এই ট্রিপল জিরো অঙ্গীকার করেছিলো বাংলাদেশ।
প্রসঙ্গত, বিবিএস যে জরিপের ফল প্রকাশ করেছে সেই জরিপটি পরিচালিত হয়েছে ২০২৩ সালে।একই সঙ্গে তারা এই জরিপের সাথে তার আগের বছরের তথ্যও প্রকাশ করেছে।
জরিপটি দেশ জুড়ে তিন লাখ আট হাজারেরও বেশি পরিবার ও বিবাহিত নারীদের ওপর পরিচালনা করা হয়েছে।
জরিপে উঠে এসেছে যে দেশে বিয়ে না করা পুরুষের সংখ্যা প্রায় ৩৬ শতাংশ
বিবিএসের জরিপ রিপোর্টের বিবাহ,তালাক ও দাম্পত্য বিচ্ছিন্ন অংশে জনসংখ্যার বৈবাহিক অবস্থার (১০+ বছর বয়সী)
৩৫ দশমিক ৮ শতাংশ পুরুষ কখনো বিয়ে করেননি।
যদিও গত পাঁচ বছরের তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে এ সংখ্যা আগের তুলনায় কিছুটা কমেছে। ২০১৯ সালে এ সংখ্যা ছিলো ৩৮ দশমিক ৯ শতাংশ।
ডঃ মোঃ মঈনুল ইসলাম বলছেন এরা মূলত পড়ালেখা করছে কিংবা বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিয়ে করার মতো স্বাবলম্বী হয়ে ওঠেনি।
“এছাড়া কিছু মানুষ হয়তো স্বেচ্ছায় বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নেয় বিভিন্ন কারণে। তবে যারা বিয়ে করেনি তারা আসলে মূলত শিক্ষার্থী বা কর্মজীবনে ঢোকার অপেক্ষায় আছে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
এই জরিপেই উঠে এসেছে যে দেশের ৪১ দশমিক ৬ শতাংশ তরুণীর বিয়ে হয়েছে বিয়ের জন্য নূন্যতম নির্ধারিত বয়স আঠার হওয়ার আগেই এবং জরিপ পরিচালনার সময় দেশের মোট গর্ভবতী নারীর এক চতুর্থাংশই ছিলো ১৫-১৯ বছরের মধ্যে।
বাংলাদেশে বাল্য বিয়ের প্রবণতা বেড়েছে। ছবির উৎস,BBS
বিয়ে ও তালাক নিয়ে আরও কথা
জরিপের তথ্য অনুযায়ী ২১ দশমিক ৭ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক নারীর বিয়ে হয়নি। এ সংখ্যা ২০১৯ সালে ছিলো ২৫ দশমিক ১।
এছাড়া দেশে পুরুষদের বিয়ের গড় বয়স ২৫ বছর ৪ মাস আর নারীদের ১৮ দশমিক ৮ মাস।
অন্যদিকে প্রতি হাজারে তালাকের সংখ্যা ১ দশমিক ১ যা ২০২২ সালে ছিলো ১ দশমিক ৪।
দেশে স্থূল মৃত্যুহার, এক মাসের ও এক বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুহার বেড়েছে।
কমছে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার, বাড়ছে বাল্যবিবাহ
বিবাহিত দম্পতিদের মধ্যে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের পরিমাণ কমার তথ্য উঠে এসেছে এবারের এই জরিপে।
২০১৫ সালে দেশের দম্পতিদের মধ্যে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের টার্গেট ছিলো ৭২ শতাংশ।
এবার বিবিএসের জরিপে এ সংখ্যা হলো ৬২ দশমিক ১ শতাংশ। গত বারের চেয়ে বেশ খানিকটা কমেছে।
মঈনুল ইসলাম বলছেন তৃণমূল পর্যায়ে এ সেবা পৌঁছানো ও সেবা নেওয়া, উভয় ক্ষেত্রেই ব্যাপক দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে।
“লোকবলের সংকট, পদ্ধতিগুলো সহজে না পাওয়াসহ নানা কারণে এ বিষয়ে আগের চেয়ে পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।”
এছাড়া বিবিএসের তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায় দেশে আঠার বছর বয়সের আগে ২০২০ সালে বিয়ের সংখ্যা ছিল ৩১ দশমিক ৩ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে এসে দাঁড়িয়েছে ৪১ দশমিক ৬ শতাংশ।
এছাড়া পনের বছরের আগে বিয়ের সংখ্যা ২০২৩ সালে ছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ, যা চার বছর আগে অর্থাৎ ২০২০ সালে ছিল ৪ দশমিক ৯ শতাংশ।
মূলত করোনা মহামারির সময়ে স্কুল বন্ধ থাকা, সামাজিক নিরাপত্তার ঘাটতি এবং মেয়েদের জন্য চাকুরির অনিশ্চয়তার কারণে অনেক অভিভাবক অল্পবয়সী মেয়েদের বিয়ে দিতে উৎসাহিত হয়েছেন বলে মনে করেন অনেকে।
“এছাড়া বাল্য বিয়ে নিরোধে যে সব কমিটি আছে জেলা পর্যায়ে সেগুলো ঠিক মতো কাজ করছে না। সচেতনতা কর্মসূচিগুলোও আর আগের মতো নেই। আমি নিজেও কয়েকটি জেলায় গিয়ে এমন চিত্র দেখেছি,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মি. ইসলাম।
গড় আয়ু, শিশু মৃত্যু, নারী প্রজনন
জরিপের তথ্য অনুযায়ী দেশে স্থূল মৃত্যুহার, এক মাসের ও এক বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুহার বেড়েছে। একই সঙ্গে কিছুটা কমেছে গড় আয়ুও।
২০১৯ সালে জন্মের সময় প্রত্যাশিত আয়ুষ্কাল ছিলো ৭২ বছর ৬ মাস। এবারের জরিপে সেটি ৭২ বছর তিন মাস।
মঈনুল ইসলাম বলছেন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও পরিবেশ – সব মিলিয়েই এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে।
“নবজাতকের কোয়ালিটি সার্ভিস হচ্ছে না। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ও ইনফেকশনের মতো সমস্যায় অনেক প্রাণ হারাচ্ছে। আবার ৪০ শতাংশ ডেলিভারি বাড়িতে হচ্ছে। সব মিলিয়েই শিশু মৃত্যু হার বেড়েছে”, জানাচ্ছেন তিনি।
অন্য দিকে এবারের রিপোর্ট অনুযায়ী নারীর প্রজনন হার সামান্য কমেছে তবে সন্তান জন্মদানের ক্ষেত্রে সি-সেকশন বা সিজারের প্রবণতা আরও বেড়েছে।
এর পাশাপাশি দেশে বয়স্ক মানুষ অর্থাৎ ৬৫ বছরের বেশি বয়সীদের সংখ্যা বেড়েছে।
“সরকারকে এখন থেকেই চিন্তা করতে হবে এসব বয়স্ক নাগরিকদের জন্য সরকারি সহায়তা কীভাবে দেওয়া হবে। তাদের বেনিফিট দেওয়ার পাশাপাশি কীভাবে কাজে লাগানো যাবে তাও এখনি ভাবা উচিত”, বলছিলেন মি. ইসলাম।
গুরুত্বপূর্ণ সূচকে অবনতি কেন
স্বাস্থ্যখাত সংশ্লিষ্টরা অনেকে মনে করেন জনসংখ্যা নীতি সময়োপযোগী না করা, ২০১১ সালের পর স্বাস্থ্য নীতিতে পরিবর্তন আনতে না পারা এবং পরিবার পরিকল্পনা খসড়া কৌশলপত্রকে চূড়ান্ত করে বাস্তবায়নের দিকে না যেতে পারার কারণে স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট সূচকগুলোতে অবনতি ঘটেছে।
মঈনুল ইসলাম অবশ্য বলছেন এবারের জরিপে অধিকতর তথ্য পাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে যার ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রের চিত্র আরও পরিষ্কার হয়েছে।
“এখন এসব তথ্য উপাত্ত আরও বিশ্লেষণ করে দরকারি পদক্ষেপ নিতে হবে জরুরি ভাবে। বয়স্ক মানুষ ও বাল্য বিয়ে বেড়েছে এবং নির্ভরশীলতার হারও বেড়েছে।”
“এগুলো সঠিক বার্তা দিচ্ছে না। এর প্রভাব পড়বে সব দিকেই। তাই দ্রুত স্বাস্থ্যসেবার মান বাড়িয়ে পরিস্থিতির আরও অবনতি ঠেকাতে হবে”, বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
-বিবিসি বাংলা
Leave a Reply