মিজান রেহমান।
বইমেলা বাঙালির সার্বজনীন উৎসব এর মত। সারা বছর ধরে এই সময়টার জন্য সবাই অপেক্ষা করে। বইমেলা নিয়ে তাই সবার আগ্রহ এখন তুঙ্গে।ফেব্রুয়ারী মাস আসলেই যেন সবার মাঝে এমন আগ্রহের দৃশ্য ও আনন্দ চোখে পড়ে।এই নিয়ে মানুষের মাঝে আছে অন্যরকম এক অনূভুতিও। বিশেষত এই অনূভুতিটা লেখক,প্রকাশক এবং পাঠকের মাঝে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে।বিশেষ করে তরুণ লেখকদের মাঝে সেই আগ্রহের মাত্রা আরো অনেক বেশি। বইয়ের কথা আসলেই ওরম খৈয়ামের সেই বিখ্যাত বাণীটা মনে পড়ে যায়,”রুটির মদ ফুরিয়ে যাবে,প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে,কিন্তু বইখানা অনন্ত-যৌবনা যদি তেমন বই হয়”। মানুষ কেন লিখে? এই প্রশ্নের উত্তর বহুমাত্রিক। তবে কিছু সহজ বিষয় হয়তো আমরা বলতে পারি।যেমন লেখালেখির মাধ্যামে চিন্তার যোগাযোগ হয়।সহজে মানুষের মননশীলতার পরিচয় জানা ও বুঝা যায়। প্রভাব ও সৃজনশীলতা বৃদ্ধি এমনকি আয় রোজগারের জন্যও অনেকেই লিখে থাকে। এই লেখালেখি নিয়ে মুহূর্তে ক ভাবছেন তরুন লেখকরা ? কেউ লেখেন থাকে নিজ দ্বায়িত্ব থেকে, কেউবা বলতে না পারা কথা লেখালেখির মধ্যে বলতে।
হাসান ইনাম, লেখক
হাসান ইনাম তেমনি একজন লেখক। যদিও তিনি নানা বিষয়ে লিখে থাকেন। “ঢাকায় ফাগুন”লিখে ইতিমধ্যে তিনি সবার নজরে এসেছেন।তার ভাবনায় তিনি তুলে ধরেন “পাঠক নয় বরং লেখকদেরও একটু নতুনভাবে ভাবা উচিত। আমরা এমন একটা স্থবির সময় অতিক্রম করছি যখন আমরা চাইলেও অনেক কথা মন খুলে বলতে পারি না, অনেক কিছু প্রকাশ করতে পারি না।এক্ষেত্রে আমরা সাহিত্যকে বেছে নিতে পারি মনের অভিব্যক্তির কথাগুলো প্রকাশ করার জন্য। গল্প, উপন্যাস, কবিতা যে যেভাবে পারি তাতে এই সময়ের কথাগুলো লিখে রাখি।” প্রতিবছর বহুসংখ্যক বই বইমেলায় প্রকাশিত হচ্ছে।এরমধ্যে বহু বইয়ের মান নিয়ে লেখক ও পাঠকের মনে প্রশ্ন উঠেছে।শুধুমাত্র মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্যে প্রকাশিত বই জাতির জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে।
সোহরাব আল আমিনী, লেখক
“অনিঃশেষ বিভ্রম”গ্রন্থের লেখক সোহরাব আল আমিনী এমনটাই তার ভাবনা প্রকাশ করে বলেন, “প্রযুক্তির এই যুগে মানুষ অতি সহজেই অনেক কিছু পেয়ে যায় বলে অনেকেই জ্ঞানচর্চার পরিশ্রম থেকে দূরে থাকার প্রবনতা রয়েছে। আদর্শ ও আলোকিত মানবগঠন, কল্যাণ, নৈতিকমূল্যবোধকে সামনে রেখে সাহিত্যের সর্বশাখায় আগ্রহ ও দক্ষতা অনুযায়ী বস্তুনিষ্ঠ লেখার মাধ্যমে জ্ঞানের এই জগৎকে সমৃদ্ধ করা উচিত। একইভাবে প্রকাশককেও স্রেফ বানিজ্যিক উদ্দেশ্যে যাচাই-বাছাই ছাড়া বই প্রকাশ না করে, জ্ঞান আরোহন উপযোগী মানসম্মত বই প্রকাশ ও প্রচারের ইতিবাচক দায়িত্ব পালন করা উচিত। এতে কল্যাণমূলক ও উপযোগী জ্ঞান মানুষের কাছে পৌঁছাতে সহযোগী হবে।
জুবায়ের ইবনে কামাল, লেখক ও সাংবাদিক
বিশিষ্ট তরুণ লেখক ও সাংবাদিক জুবায়ের ইবনে কামাল মনে করেন লেখক-পাঠাক এবং প্রকাশকদের পড়াশুনো জরুরি । “সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে লেখক ও পাঠক উভয়কেই তা করতে হবে নিজ নিজ অবস্থান থেকে। তেমনি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত প্রকাশক ও বিপননকারীদেরও আলাদা কাজ করার জায়গা আছে। প্রাথমিকভাবে লেখক-পাঠক এমনকি প্রকাশকেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হওয়া উচিত- নিয়মিত বই পড়া। লেখকরা যে খুব একটা বই পড়েন না, তা লেখার অগভীরতা দেখলেই বোঝা যায়। তাছাড়া পাঠকদেরও বই পড়তে পড়তে বিশ্ব সাহিত্য পাঠের একটি ম্যাচিউরিটি তৈরি করতে হয়। তা না হলে হয়তোবা, তারাও লেখকদের বই মূল্যায়ণ করতে পারেন না। তেমনি প্রকাশক নিজে যদি বই না পড়েন, তবে তিনি বুঝবেনই বা কীভাবে ভালো পান্ডুলিপি কোনগুলো। এই জায়গায় ঘাটতি আছে বলেই তারা দ্বিধা নিয়ে অপেশাদার লেখকদের বই বের করেন, যা সাময়িক লাভ হলেও দীর্ঘ সময়ের জন্য খুব একটা কার্যকরী কিছু হয় না।” তরুণ লেখকদের বই প্রকাশের ব্যাপারে ঝুঁজে পড়ার কারণ কী জানতে চাইলে তিনি আরো বলেন “আমার কাছে মনে হয় না, ইদানীং তরুণরা বেশি লেখায় ঝুঁকে পড়ছেন। কারণ আগেও আসলে তরুণরা লিখতেন এমনকি শিক্ষার্থীরাও লিখতেন। বাস্তবে, আগে তরুণ বা শিক্ষার্থী অবস্থায় বই প্রকাশ করার যে চ্যালেঞ্জ ছিল, সেগুলো এখন কমে গেছে। তাই সহজেই একজন শিক্ষার্থী বই বের করতে পারে।
তাহসিনা এনাম তৃষা, সাব এডিটর, ঢাকা ট্রিবিউন
এই মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রায় ৭০% মানুষের বয়স ৩০ বছরের কম। তার মানে বাংলাদেশের বর্তমান জনসংখ্যার অধিকাংশই তরুণ বা শিক্ষার্থী। স্বাভাবিকভাবেই এই বিরাট সংখ্যার প্রভাব বইয়ের জগতেও পড়েছে।” আগেকার তুলনায় বর্তমান নারীরা যে সাহিত্য অঙ্গনে অনেক এগিয়ে- সেই বিষয়টা ফুটে উঠেছে ‘ঢাকা ট্রিবিউন’র সাব এডিটর তাহসিনা এনাম তৃষা কথায়।তিনি বলেন, “বর্তমান সময়ে সাহিত্য পাঠ এবং সাহিত্য চর্চা – দুই ক্ষেত্রেই নারীদের অংশগ্রহণ আগের থেকে অনেক বেড়েছে। আজ থেকে পঞ্চাশ ষাট বছর পেছনে ফিরলে দেখা যায়, খুব অভিজাত পরিবার অথবা খুব শিক্ষিত ছাড়া নারীদের সাহিত্যে অঙ্গনে আসতেন না। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে স্বাভাবিকভাবেই অন্যান্য ক্ষেত্রের মত সাহিত্যেও নারীর পদচারণা বেড়েছে। শুধু বই পড়া এবং লেখার ক্ষেত্রেই নয়, প্রকাশানাতেও নারীরা অবদান রাখছে। প্রায়শই একটা কথা ওঠে যে বাংলা সাহিত্যে একদম শুরুর সময় থেকে যতজন শক্তিশালী সাহিত্যিক রয়েছেন, নারী সাহিত্যিক তার তুলনায় একেবারেই কম। বেগম রোকেয়া, আশাপূর্ণা দেবী, মহাশ্বেতা দেবী- শুধুমাত্র ওনাদের নামই উচ্চারিত হতো। আসলে মেয়েদের অবস্থান কখনোই আগে এমন ছিল না যে তারা ঘর সংসার বা অন্যান্য কাজ ফেলে সাহিত্যাঙ্গনে প্রবেশ করবে। আর তাছাড়া নারীশিক্ষার হারও ছিল কম। সমাজের ঘাত প্রতিঘাতে সংসার ধর্ম টিকিয়ে রেখে আবার সাহিত্য চর্চা করা বেশিক্ষেত্রে নারীদের জন্য বিলাসিতাই ছিলো সে দিনগুলোতে। নারীদের সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটার কারণে ধীরে ধীরে বাংলা সাহিত্যে নারীরা অবদান রাখার সুযোগ পাচ্ছে। উপন্যাস, গল্প, কবিতা এই ধরনের জায়গাগুলোতে নারী লেখকদের দেখা গেলেও নন ফিকশন অথবা গবেষণাধর্মী বইয়ের ক্ষেত্রে একটু কম। আশা করি আগামীতে এই ধরনের বইগুলোর লেখন পরিচিতি পাতায় নারীদের পদচারণা আরো বাড়বে।”
বাংলাদেশের তরুণ লেখকদের নিয়ে দুর্দান্ত একটি প্রবন্ধ।