ডেভিড ব্রুকস
১৯৭৮ সালে, রাশিয়ার ভিণ্ণমতালম্বী আলেকজান্দার সলজেনিৎসিন হার্ভার্ডে একটি সমাপনী ভাষণ দিয়েছিলেন, সেখানে তিনিআমেরিকানদের আত্মবিশ্বাস ও ইচ্ছাশক্তির ক্ষয় সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন । তিনি বলেছিলেন, “পশ্চিমে আজ যে বৈশিষ্ট্যটি বাইরের কোন পর্যবেক্ষক লক্ষ্য করতে পারেন, তা হলো সাহসিকতার অভাব।” আজ, সেই শব্দগুলি বিভ্রান্তিকর শক্তি ধারণ করে। উদারনৈতিক গণতন্ত্রের শত্রুরা প্রচণ্ড আবেগঘন হয়ে উঠেছে – ভ্লাদিমির পুতিন, শি জিনপিং, ডোনাল্ড ট্রাম্প, ক্যাম্পাস চরমপন্থীরা। এদিকে, যারা উদার নীতিগুলো রক্ষা করার চেষ্টা করেন, তারা কখনো কখনো ২০১৬ সালের প্রাথমিক নির্বাচনে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা কিছু রিপাবলিকান নেতার মতো মনে হয় – ভদ্র এবং ভালো, কিন্তু বোকা এবং উল্লেখযোগ্য প্রতিরোধের ক্ষমতা রাখেন না।
এই পরিবেশের মধ্যে ফারিদ জাকারিয়ার গুরুত্বপূর্ণ নতুন বই “বিপ্লবের যুগ: ১৬০০ থেকে বর্তমান পর্যন্ত অগ্রগতি ও প্রতিক্রিয়া” প্রকাশিত হয়েছে। এই বইয়ের একটি শক্তিশালী বৈশিষ্ট্য হলো, জাকারিয়া উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক পুঁজিবাদকে কিছু বিমূর্ত ধারণা হিসাবে বিবেচনা করেননি। তিনি দেখিয়েছেন মানুষ বা বিশেষ করে এক একটি জাতি গোষ্টি বা সম্প্রদায় কীবাবে কীভাবে তাদের আরো সমৃদ্ধ, পূর্ণাঙ্গ এবং গতিশীল জীবন তৈরির পথে চলেছিলো। ১৬শ শতাব্দীতে ডাচ প্রজাতন্ত্র থেকে শুরু হয়। ডাচরা আধুনিক লাভ লক্ষ্যকারী সংস্থা আবিষ্কার করেছিলেন। ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, হোলি রোমান সাম্রাজ্য, স্পেন এবং পর্তুগালের নৌবহরের মোট বহন ক্ষমতার চেয়ে ডাচ বাণিজ্যিক জাহাজ বহরের বহন ক্ষমতা বেশি ছিল। ১৮শ শতাব্দীতে, আমস্টারডামের মাথাপিছু আয় প্যারিসের চারগুণ ছিল।
ডাচ সাফল্য শুধু অর্থনৈতিক ছিল না। সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও উন্নতি হয়েছিল (রেমব্রান্ট, ভার্মিয়ার)। নগরায়নের প্রসার ঘটেছিল – সমৃদ্ধশহর ও শহরগুলির নির্মাণ হয়েছিল। বিকেন্দ্রীভূত ক্ষমতার পরিপ্রেক্ষিতে একটি নাগরিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা গড়ে উঠেছিল। সমাজে একটি সমতাবাদী সংস্কৃতিও ছিল। ১৯শ শতাব্দী পর্যন্ত, হল্যান্ডে ঘোড়ার পিঠে বীরদের মূর্তি ছিল না। এছাড়াও নৈতিক সংযম ছিল। ডাচ ক্যালভিনিজম সমৃদ্ধির ফলে দূষণের ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক ছিল। এটি এক দিকে যেমন আত্ম-শৃঙ্খলা তেমনিসম্পদ প্রদর্শনের মতো লজ্জাকর কাজ থেকেও নিজেকে দূরে রাখার মত শিষ্টতাও।
পরবর্তী উদারনৈতিক অগ্রগতি ঘটেছিল ব্রিটেনে। ১৬৮০ দশকের শেষের দিকের গৌরবময় বিপ্লবে, একজন ডাচ, উইলিয়াম অফ অরেঞ্জ, ইংল্যান্ডের রাজা হন এবং ডাচদের আরো উদার রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলির কিছু আমদানি করতে সাহায্য করেন, যার ফলে আরো রাজনৈতিক ও ধর্মীয় মিতব্যয়িতার এক যুগের সূচনা হয়। আবার, একই ধরনের প্যাটার্ন দেখা যায়: প্রযুক্তিগত ও অর্থনৈতিক গতিশীলতা সাংস্কৃতিক সৃজনশীলতা, রাজনৈতিক সংস্কার, নগরায়ন, নৈতিক পুনরুত্থান এবং, স্বীকার করতে হবে, বিশাল সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রসারণের হাত ধরে ।
জেমস ওয়াট এর মত ব্রিটিশ আবিষ্কারক এবং টিঙ্কারাররা স্টীম ইঞ্জিন নির্মাণ করেছিলেন। ১৭৭০ থেকে ১৮৭০ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ মজুরির বাস্তব মূল্য ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল, এবং ১৯শ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ব্রিটিশ জীবনপ্রত্যাশা প্রায় ৩.৫ বছর বেড়েছিল। ১৮০০ সালে মহান সংস্কার আইন আরো মানুষকে ভোট দেওয়ার অধিকার দিয়েছিল এবং রাজনৈতিক দুর্নীতি কমিয়েছিল। উদাহরণস্বরূপ, ১৯শ শতাব্দীর প্রথম দিকে ইভ্যাঞ্জেলিক্যাল ক্ল্যাপহ্যাম সেক্টের উত্থান ছিল বিশাল সামাজিক আন্দোলনের অংশ, যার নেতৃত্বে ছিলেন এমন মানুষ যারা দাসত্ব বাণিজ্য নিষিদ্ধ করতে, শিশুশ্রম কমাতে, জেলব্যবস্থায় সংস্কার আনতে, প্রাণীদের প্রতি নৃশংসতা হ্রাস করতে, দরিদ্রদের জীবন সহজ করতে এবং ভিক্টোরিয়ান জীবনে শিষ্টাচারের বিধিমালা প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন।
পরবর্তীতে আমেরিকা উঠে আসে, এবং সেখানে প্রায় একই ধরনের প্যাটার্ন পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল। টেলিফোন এবং বৈদ্যুতিক আলোর বাল্বের মতো নতুন আবিষ্কার। মানুষের ঢল নেমেছিলো শহরে। ২০শ শতাব্দী জুড়ে, আমেরিকান সংস্কৃতি বিশ্ব জুড়ে আধিপত্য বিস্তার করেছিল। যুদ্ধোত্তর আমেরিকার উদার অর্ডারের কারণে, জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়। জাকারিয়া উল্লেখ করেছেন, “১৯৮০ সালের তুলনায়, ২০০০ সাল নাগাদ বৈশ্বিক জিডিপি প্রায় দ্বিগুণ হয়, এবং ২০১৫ সালে তিনগুণেরও বেশি হয়েছিল।”
কিন্তু এর সমস্ত সুবিধা সত্ত্বেও, উদারবাদ তুরস্ক, ভারত, ব্রাজিল এবং ২০২৪ সালে যদি ট্রাম্প জয়ী হন তাহলে আমেরিকা সহ বিভিন্ন দেশে অসুস্থ এবং পিছু হটছে। জাকারিয়ার বই আমাকে উদারবাদের গৌরব সম্পর্কে একটি আরো শক্তিশালী প্রশংসাবোধ এবং কী ভুল হয়েছে তা আরো ভালোভাবে বোঝার সুযোগ করে দিয়েছে। আমি সেই ব্যক্তিদের একজন যারা অস্ট্রিয়ান মনোবিজ্ঞানী ভিক্টর ফ্রাঙ্কলের মতবাদকে বিশ্বাস করি: “মানুষের জীবনর মূল অর্থ সন্ধানই প্রধান অনুপ্রেরণা।” বিশ্বে নিজেকে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে, মানুষের নিজেকে কোনও ভালো কাজে নিয়োজিত দেখা প্রয়োজন – গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা, অন্যদের ভালোভাবে ভালোবাসা, সুসংগত নৈতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে বাস করা, কিছু আদর্শের পক্ষে সংগ্রাম করা।
জাকারিয়া বর্ণিত মহান উদারনৈতিক সমাজগুলো ব্যক্তিগত পছন্দ এবং স্বাধীনতা সম্প্রসারিত ও উদযাপন করেছে। কিন্তু উদারবাদ যখন বেঁচে ছিল, তখন সেই ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বেছে নেওয়ার আগে প্রতিশ্রুতি ও নৈতিক দায়িত্বের ভিত্তিতে অবস্থান করত: আমাদের পরিবার, সম্প্রদায় ও জাতির প্রতি, আমাদের পূর্বপুরুষ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতি, ঈশ্বর বা কিছু অতিপ্রাকৃত সত্যগত কয়েক প্রজন্ম ধরে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতার উদযাপন তার সীমা অতিক্রম করে নাগরিক দায়িত্বের ভিত্তি ক্ষয় করতে শুরু করেছে। বিশেষত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে এবং ১৯৬০-এর দশকে, আমরা নৈতিকতার এক ভয়াবহ আত্মকেন্দ্রিকতা দেখছি – যা পরবর্তীতে নৈতিক স্বাধীনতার আদর্শ হিসাবে পরিচিত। মানুষ ধীরে ধীরে এই ধারণা পরিত্যাগ করতে শুরু করেছে যে মানুষ সংহত নৈতিক সম্প্রদায়ে বাস করে মূল্যবোধ শিখে। তারা এই বিশ্বাস গ্রহণ করেছে যে প্রত্যেককে তার নিজস্ব ব্যক্তিগত সঠিক এবং ভুলের ধারণা গড়ে তুলতে হবে।
১৯৫৫ সালের দিকেই, কলাম লেখক ওয়াল্টার লিপম্যান লিখেছিলেন যে এটি সমস্যার সৃষ্টি করবে। “যা ভালো, যা সঠিক, যা সত্য, তা শুধুই ব্যক্তি বেছে নেয়ার বা উদ্ভাবন করার বিষয় হলে শালীনতার ঐতিহ্যের বাইরে চলে যাবার সম্ভাবনা থাকে। যখন কোনো সাধারণ নৈতিক মূল্যবোধ এবং প্রথা থাকে না, তখন সামাজিক আস্থা হ্রাস পায়। মানুষ নিজেকে বিচ্ছিন্ন এবং অবরুদ্ধ বোধ করে, এবং হানা আরেন্ডটের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, একাকী সমাজ স্বৈরশাসনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। মানুষ আগ্রহের সাথে মহান নেতা এবং রক্ষকের অনুসরণ করে, যিনি জীবনকে অর্থপূর্ণ করে তোলার সংগ্রামে নেতৃত্ব দেবেন বলে তারা মনে করেন।
বর্তমান বৈশ্বিক গণতন্ত্রবিরোধী আন্দোলনের সময়ে, উদারনৈতিক ঐতিহ্য হুমকির মুখে পড়েছে। অনেকে অর্থনৈতিকভাবে জাতীয়তাবাদী এবং সাংস্কৃতিকভাবে প্রথাবাদী হয়ে উঠেছে। বিশ্বজুড়ে, স্বৈরাচারী নৈতিকবাদীরা পুরোনো পথ, পুরোনো ধর্ম, জাতীয় মহত্ত্ব পুনরুদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। ভিক্টর ওরবান ঘোষণা করেছিলেন, “কিছু জিনিস আছে যা ‘আমার’ অহংকারের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ – তা হলো -পরিবার, জাতি,ও ঈশ্বর”। এই ধরনের মানুষ সাংস্কৃতিক, নৈতিক এবং নাগরিক স্থিতিশীলতাকে পুনরুদ্ধার করার প্রতিশ্রুতি দেন, কিন্তু সেখানে পৌঁছাতে তারা নিষ্ঠুর ও বর্ণবাদী একনায়কতন্ত্রের পদ্ধতি ব্যবহার করেন।
রাষ্ট্রপতি বাইডেন ব্যাপক চাকরি ও অর্থনৈতিক সুবিধার মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন মানুষদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেছিলেন। মনে হচ্ছে রাজনৈতিকভাবে এটি কাজ করেনি কারণ মানুষ প্রকৃতপক্ষে যে অনুপস্থিতি অনুভব করছে তা হলো অর্থ, অন্তর্ভুক্তি এবং স্বীকৃতির অনুপস্থিতি। এই নির্বাচনী বছরে, যুক্তরাষ্ট্র এবং বিশ্বজুড়ে প্রশ্ন উঠেছে উদারবাদ আবার বেঁচে উঠতে পারবে কিনা? জাকারিয়ার বই পাঠকদের এই গৌরবময় এবং চলমান উদারনৈতিক যাত্রার অংশ হওয়ার জন্য মানুষকে অবশ্যই নাড়া দেবে, তার সম্মানকে জাগরুক করবে। তিনি বুঝতে পেরেছেন যে আমরা উদারপন্থীরা শুধু অর্থনৈতিক সুবিধা প্রদান করতে পারি না; আমাদের জীবনধারার আধ্যাত্মিক এবং নাগরিক যুক্তিও তুলে ধরতে হবে। তিনি লিখেছেন: “এই যাত্রাকে নৈতিক অর্থ দেওয়া, এতে গর্ব ও উদ্দেশ্যের অনুভূতি ঢেলে দেওয়া – একসময় ধর্ম যেভাবে করত – হৃদয়ের সেই শূন্যতা পূরণ করা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে রয়েছে।” মহান উদারনৈতিক চিন্তায় আরেকটি অধ্যায় যুক্ত করার প্রচেষ্টার গৌরব রয়েছে যা হলো প্রযুক্তিগতভাবে উদ্ভাবনী, বাণিজ্যিকভাবে সাহসী, সকলের জন্য সম্প্রসারিত সুযোগ সম্বলিত একটি সমাজ গঠন। বাস্তবে এমন একটি সমাজ গড়া যেখানে সংস্কৃতির উদযাপন করা হয়, পরিবারের উন্নতি হয়, এমন একটি সমাজ যেখানে ব্যক্তিদের বিপুল বৈচিত্র্য একটি সাধারণ উদ্দেশ্যে অনুভব করতে পারে এবং অবকাশ পেতে পারে।
Leave a Reply