বুধবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ০১:৫২ পূর্বাহ্ন

ভারতের নিরাপত্তার জন্য ভারত মহাসাগরের পশ্চিমাঞ্চল গুরুত্বপূর্ণ

  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ৪ এপ্রিল, ২০২৪, ৮.৩০ এএম

তাপস দাস

সম্প্রতি সোমালিয়ার জলদস্যুরা বিশ্বগণমাধ্যমের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করে রেখেছে । প্রথমত, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মোজাম্বিক থেকে দুবাইয়ের দিকে যাত্রাগামী বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহকে সোমালিয়ার জলদস্যুদের দ্বারা জিম্মি করাকে কেন্দ্র করে । দ্বিতীয়ত, অতিসম্প্রতি সোমালিয়ার পূর্ব উপকূলে পাকিস্তানি নাবিকসহ তাদের মাছ ধরার একটি ইরানিয়ান জাহাজকে সোমালিয়ান জলদস্যু দ্বারা অপহরণকে কেন্দ্র করে। যদিও এই ধরণের ঘটনা ভারতমহাসাগরীয় অঞ্চলে নতুন নয় । বিগত নভেম্বর থেকে প্রায় ২০টি জাহাজ সোমালিয়ার জলদস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। তবে এই লেখার উদেশ্য জলদস্যুদের অপহরণের বর্ণনা করা নয় । এই লেখার মধ্যে দিয়ে যে প্রশ্নের উত্তরটি খোঁজার চেষ্টা করা হবে সেটি হল, কেন জলদস্যুরা এই ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে তাদের কার্যকলাপের অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিয়েছে অথবা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারত মহাসাগরের গুরুত্ব কোথায় ?

ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল হল বিশ্ব বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল। বিশ্বের কিছু বৃহত্তম এবং ব্যস্ততম সামুদ্রিক বন্দর এই মহাসাগরীয় অঞ্চলে অবস্থিত। তাছাড়া বিশ্বে যে ২০টি দেশের বৃহত্তম বাণিজ্যিক নৌবহর আছে তাদের মধ্যে ভারত ,সিঙ্গাপুর এবং মালয়েশিয়া এই মহাসাগরীয় অঞ্চলে অবস্থিত। আয়তনের দিক থেকে এটি পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম মহাসাগর। এই মহাসাগর পৃথিবীর সর্বমোট জলভাগের ২০ শতাংশ জলভাগ দ্বারা গঠিত এবং বঙ্গোপসাগর থেকে অ্যান্টার্কটিক পর্যন্ত 9,600 কিলোমিটার এবং দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত 7,800 কিলোমিটার পর্যন্ত এর বিস্তিতি । শুধু তাইনয়, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে প্রায় ৩৬টি দেশে বিশ্ব জনগণের ৩৫ শতাংশ মানুষ বসবাস করে এবং ভারত মহাসাগরের উপকূলীয় অঞ্চল পৃথিবীর সর্বমোট উপকূলীয় অঞ্চলের ৪০ শতাংশ ।

বছরে প্রায় ১ লক্ষ মালবাহী জাহাজ এই অঞ্চলের উপর দিয়ে যাতায়াত করে। বিশ্বের ৩০ শতাংশ কন্টেইনারাইজড কার্গো এবং ৪২ শতাংশ অপরিশোধিত তেল এই অঞ্চল থেকে উত্তোলন এবং এই তেলজাত পণ্য পরিবহনকারী জাহাজ এই অঞ্চলের মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করে । এই অঞ্চলে বিশ্বের ৫০% -এর বেশি তেল এবং গ্যাস মজুত আছে। তাছাড়া তেল পরিশোধন করার জন্য উপকূলীয় অঞ্চল (গাল্ফ রিজিওন ), গুজরাটের জামনগর এবং সিঙ্গাপুরে বিশেষ ব্যবস্থা আছে যা বিশ্বের ২০ % চাহিদা পূরণ করে।

এছাড়াও এই অঞ্চলে পাঁচটি সংকীর্ণ প্রণালী বা চোক পয়েন্ট এবং একটি চ্যানেল আছে যা বিশ্ব বাণিজ্যের পাশাপাশি কৌশলগত কারণে গুরুত্বপূর্ণ। এদের মধ্যে অন্যতম হরমুজ প্রণালী এটি তেল উত্তোলনকারী কেন্দ্র উপসাগরীয় অঞ্চলকে ভারত মহাসাগরের সঙ্গে যুক্ত করেছে। উপসাগরীয় অঞ্চলের প্রায় ৮৮ % তেল এই এই প্রণালীর মধ্যে দিয়ে পরিবাহিত হয় যা বৈশ্বিক তেলের ৩৫%। এই প্রণালীর মধ্যে দিয়ে প্রত্যেকদিন প্রায় তেল বাহিত ট্যাঙ্কার, মাছ ধরার নৌকা সহ ৩০০০ হাজার জাহাজ যাতায়াত করে।

মালাক্কা প্রণালী যা ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর এবং মায়েশিয়ার মাঝে অবস্থিত। এই প্রণালী ভারত মহাসাগরকে দক্ষিণ চীন সাগর এবং প্রশান্ত মহাসাগরকে যুক্ত করেছে। বছরে এই প্রণালীর মধ্যে দিয়ে প্রায় ৫০ হাজার জাহাজ যাতায়াত করে। এই প্রণালীর মধ্যে দিয়ে প্রত্যেক দিন ১৫ মিলিয়ন তেল পরিবাহিত হয় যা বিশ্বের বাজারজাত তেলের ১৫ শতাংশ। এশিয়ার অন্যতম তেল আমদানিকারী রাষ্ট্র চীন , দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানের ৮০ শতাংশ তেল এই জলপথ ধরে আসে।

বাব এল মানদেব প্রণালী এডেন উপসাগরের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরকে লোহিত সাগরের সঙ্গে যুক্ত করে। ইউরোপে তেল বাজারজাত হওয়ার ক্ষেত্রে এটি অন্যতম পথ। এছাড়া আছে সুন্দা এবং লম্বক প্রণালী। যদিও এগুলি আকারে ছোট। খুব বড় জাহাজ এগুলিতে যাওয়ার জন্য খুব একটা উপযুক্ত নয়। সুন্দা ইন্দোনেশিয়ার সুমাত্রা এবং জাভা দ্বীপের মধ্যে অবস্থিত এবং এটি জাভা সাগরকে ভারত মহাসাগরের সঙ্গে যুক্ত করে। অন্যদিকে লম্বক প্রণালী মালাক্কা প্রণালীর বিকল্প হিসেবে ভবিষ্যতে ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি বালি এবং লম্বক দ্বীপের মধ্যে অবস্থিত। তাছাড়া মোজাম্বিক চ্যানেল হলো ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অবস্থিত একমাত্র চ্যানেল। এটি মাদাগাস্কার থেকে দক্ষিণ -পূর্ব আফ্রিকা উপকূল পর্যন্ত বিস্তিত। বিশ্বের ৩০% বাজারজাত তেল সহ দক্ষিণ আফ্রিকার সমস্ত বাণিজ্যের জন্য এই চ্যানেলের উপর নির্ভর করতে হয়।

আলোচনা থেকে স্পষ্ট ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল যেহেতু বৈশিক বাণিজ্যের অন্যতম ব্যস্ত পথ এর কোনো বিকল্প পথ নেই এবং তেল সহ গুরুত্বপূর্ণ মালবাহী জাহাজ এই পথ ধরে পারাপার হয় সেক্ষত্রে জলদস্যুদের নিশানা থাকে যদি কোনো জাহাজ তারা নিজেদের জিম্মি করতে পারে, তাহলে পণ কিংবা অপহরণকৃত দ্রব্য বিক্রি করে বিশাল অঙ্কের অর্থের উপার্জন করতে পারবে। তবে এই জলদস্যুদের অপহরণ থেকে রক্ষার জন্য বৃহৎ শক্তিগুলিও তাদের নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলে। এক্ষেত্রে ভারত অন্যতম। ভারত মহাসাগরে ভারত ১০ থেকে ১২ টি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছে যা যে কোনো দেশের তুলনায় বৃহত্তম। কারণ ভারতের মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের ৯৫ শতাংশ ঘটে এই পথ ধরে। তাছাড়া ৮০ শতাংশ আমদানিকৃত তেল, ৬০ শতাংশ আমদানিকৃত এলপিজি গ্যাস এবং সর্বোপরি ২৫% কয়লা ভারত এই পথে আমদানি করে। সুতরাং বাণিজ্যিক নিরাপত্তা এই যুদ্ধজাহাজ গুলি মোতায়ন করার অন্যতম কারণ তবে শুধুমাত্র কারণ নয়।

জলদস্যুদের হাত থেকে মালবাহী জাহাজ রক্ষা করার পাশাপাশি ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিরাপত্তা বলয় গঠন করার কিছু রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কৌশলগত কারণও আছে। কারণগুলির মধ্যে অন্যতম ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখা বিশেষ করে চীন যেভাবে এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তার করছে সেটি ভারতের প্রতিরক্ষা দপ্তরের কাছে প্রধান প্রণিধানযোগ্য বিষয়। উদাহরণ স্বরূপ সম্প্রতি জানুয়ারী মাসে মালদ্বীপে চীনের যে ‘রিসার্চ জাহাজ’ প্রবেশ করেছে, ভারত এটিকে বেশ সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছে । তাছাড়া, চীনের ‘স্ট্রিং অফ পার্লস’ নামক যে কৌঁসুলি নীতি আছে, সেই নীতির পাল্টা স্বরূপ ২০১৫ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ‘সাগর ‘ বলে একটি নীতি ঘোষণা করেছে। এই নীতির মূল উদ্যেশ ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে অবস্থিত দেশগুলিতে ধীরে ধীরে যে চীনা অনুপ্রবেশ শুরু হয়েছে সেটির প্রতিরোধের পাশাপাশি রাষ্ট্রগুলিকে বিকল্প পথের সন্ধান দিয়ে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখা। তাছাড়া এই অঞ্চলে নিরাপত্তা জনিত কারণে ভারত কিছু সামরিক জোট তৈরী করেছে, এগুলির মধ্যে ‘কোয়াড’ বিশেষ ভাবে আলোচিত।

এছাড়া ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারতের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি হলো ইন্দো -প্যাসিফিক নীতি। ২০০৭ সালে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের এই শব্দটি ব্যবহার করেন। ইন্দো -প্যাসিফিক নীতি বিগত বছরগুলিতে যথেষ্ট দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ইন্দো-প্যাসিফিকের ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব অনুধাবন করে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের জন্য ভারতের দৃষ্টিভঙ্গির রূপরেখা তুলে ধরে, ২০১৮ সালের জুন মাসে সিঙ্গাপুরে শাংরি লা ডায়ালগে বলেছিলেন , ইন্দো-প্যাসিফিককে একটি মুক্ত, উন্মুক্ত এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক অঞ্চল ভিত্তিক হিসাবে কল্পনা করেছিলেন। তাছাড়া ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, “ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারত একটি অভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ভাগ করে নিয়েছে”, যা একটি “মুক্ত এবং উন্মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক” এর বাস্তবায়নের দিকে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার সম্ভাবনা সম্পর্কে একটি উদাহরণ সৃষ্টি করতে পারে । তবুও, বর্তমানে, ইন্দো -প্যাসিফিক নিয়ে ভারত সরকারের মার্কিন সরকারের প্রতি কিছু দন্দ্ব রয়েছে, কারণ মহাসাগরীয় নিরাপত্তার বিষয়টি মার্কিন সরকার পুরোপুরি নিজেদের জাতীয় স্বার্থ দিয়ে দেখছে ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো -প্যাসিফিক নীতিতে ভারত মহাসাগরের পশ্চিমাঞ্চল তেমন কোনো গুরুত্ব পায়না যেখানে ভারতের ক্ষেত্রে সেটিই প্রধান নিরাপত্তাজনিত বিষয়।

তাপস দাস, গবেষক, রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগ, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়
এবং সহকারী অধ্যাপক, কান্দি রাজ কলেজ, মুর্শিদাবাদ

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024