মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ০৪:১৮ অপরাহ্ন

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ২৭ তম কিস্তি )

  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১২.০০ পিএম
রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যে আরেকটি নতুন যুগ সৃষ্টি হয়েছিলো। ভাষাকে মানুষের মুখের ভাষার কাছে নিয়ে আসা নয়, সাহিত্যে’র বিষয়ও হয়েছিলো অনেক বিস্তৃত। সাহিত্যে উঠে এসেছিলো পরিবর্তিত মন ও সমাজের নানান প্রাঙ্গন। সময়ের পথ ধরে সে যুগটি এখন নিকট অতীত। আর সে সাহিত্যও চিরায়ত সাহিত্য। দূর অতীত ও নিকট অতীতের সকল চিরায়ত সাহিত্য মানুষকে সব সময়ই পরিপূর্ণ মানুষ হতে সাহায্য করে। চিরায়ত সাহিত্যকে জানা ছাড়া বাস্তবে মানুষ তার নিজেকে সম্পূর্ণ জানতে পারে না।

সারাক্ষণের চিরায়ত সাহিত্য বিভাগে এবারে থাকছে মানিক বন্দোপধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য।

দিবারাত্রির কাব্যে’র ভূমিকায় মানিক বন্দোপধ্যায় নিজেই যা লিখেছিলেন …..

দিবারাত্রির কাব্য আমার একুশ বছর বয়সের রচনা। শুধু প্রেমকে ভিত্তি করে বই লেখার সাহস ওই বয়সেই থাকে। কয়েক বছর তাকে তোলা ছিল। অনেক পরিবর্তন করে গত বছর বঙ্গশ্রীতে প্রকাশ করি।

দিবারাত্রির কাব্য পড়তে বসে যদি কখনো মনে হয় বইখানা খাপছাড়া, অস্বাভাবিক,- তখন মনে রাখতে হবে এটি গল্পও নয় উপন্যাসও নয়, রূপক কাহিনী। রূপকের এ একটা নূতন রূপ। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের Projection-মানুষের এক এক টুকরো মানসিক অংশ।

দিবা রাত্রির কাব্য

মানিক বন্দোপাধ্যায়

 

‘চন্দনটা তুমিই ঘষে নাও, আনন্দ’-বলে হেরম্ব মন্দির ছেড়ে চলে এল।

বহুদিন আগে একবার এক বর্ষণ-ক্ষান্ত নিশীথ স্তব্ধতায় সজল বায়ুস্তর ভেদ করে হেরম্বের কলকাতার বাড়িতে বিনামেঘে বজ্রাঘাত হয়েছিল। স্ত্রীর ভয় তার মনে সংক্রমিত হওয়াতে বাকি রাতটা হেরম্ব আতঙ্কে ঘুমোতে পারেনি। আজ কিছুক্ষণের জন্য তার অবিকল সেই রকম ভয় করতে লাগল।

ঘরে গিয়ে হেরম্ব বিছানায় আশ্রয় নিল। দেখে গেল, অনাথ তার ঘরে ধ্যানস্থ হয়েছে। নজর তাকালেই বোঝা যায়, বাহ্যজ্ঞান নেই। দেখেনি, এত দ্রুত তাঁকে সমাধিস্থ হতে দেখে বারান্দা দিয়ে যাবার সময় তার নিস্পন্দ দেহের দিকে এক অনাথের সুদীর্ঘ সাধনা হেরম্ব তার বিস্ময়ের সীমা থাকে না। আনন্দের কাছে সে শুনেছে, গত বৎসরও অনাথের এ ক্ষমতা ছিল না। মাস চারেক আগে অনাথ একবার মাথার যন্ত্রণায় ক’দিন পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিল, তারপর থেকে আসনে বসলেই সে সমাধি পায়।

জীবনে মৃত্যুর স্বাদ ভোগ করবার শখ হেরম্বের কোনদিন ছিল না, এ বিষয়ে কৌতূহলও তার নেই। বিছানায় চিত হয়ে সে ঘুমেরই তপস্তা আরম্ভ করল। আনন্দ যখন ঘরে এল ঘুমের আশা সে ত্যাগ করেছে, কিন্তু চোখ মেলেনি।

আনন্দ জিজ্ঞাসা করল, ‘ঘুমিয়েছ?’

‘না।’

‘চন্দন ঘষে দিলে না যে?’

হেরম্ব উঠে বসল। বলল, ‘ওসব আমি পারি না। আমাদের সংসার হলে তুমি যে বলবে এটা কর ওটা কর তা চলবে না, আনন্দ। আলসেমিকে আমি প্রায় তোমার সমান ভালবাসি।’

‘ভালবাস নাকি আমাকে?’

আনন্দের কণ্ঠস্বর হেরম্বকে চমকে দিল।

সহজ ও সরল প্রশ্ন নয়। উচ্চারণের পর মরে যায় না এমন সব কথা আনন্দ আজকাল এমনি অবহেলার সঙ্গে বলে। হেরম্বের মনশ্চক্ষে যে ছানি পড়তে আরম্ভ করেছিল চোখের পলকে তা স্বচ্ছ হয়ে গেল। আনন্দের মুখ দেখে সে বুঝতে পারল শুধু বিষন্নতা নয়, সেই প্রথম রাত্রিতে চন্দ্রকলা-নাচ শেষ করার পর আনন্দের যে যন্ত্রণা হয়েছিল তেমনি একটি কষ্ট সে জোর করে চেপে রাখছে। হেরম্ব সভয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘একথা বলছ কেন আনন্দ?’

‘আমার ক’দিন থেকে এরকম মনে হচ্ছে যে।’

‘আগে বলনি কেন?’

‘মনে এলেই বুঝি সব কথা বলা যায়? আগে বলিনি, এখন তো বলছি।

তুমি বলেছিলে ভালবাসা বেশীদিন বাঁচে না। আমাদের ভালবাসা কি মরে যাচ্ছে?’

হেরম্ব জোর দিয়ে বলল, ‘তা যাচ্ছে না, আনন্দ। আমাদের ভালবাসা কি বেশীদিনের যে মরে যাবে? এখনো যে ভাল করে আরম্ভই হয়নি?

আনন্দ হতাশার সুরে বলল, আমি কিছুই বুঝতে পারি না। সব হেঁয়ালির মতো লাগে। তুমি, আমি, আমাদের ভালবাসা, সব মিথ্যে মনে হয়। আচ্ছা, আমাদের ভালবাসাকে অনেকদিন, খুব অনেকদিন বাঁচিয়ে রাখা যায় না?’

হেরম্ব একবার ভাবল মিথ্যে বলে আনন্দকে সান্ত্বনা দেয়। কিন্তু সত্য, মিথ্যা কোন সান্ত্বনাই আত্মোপলব্ধির রূপান্তর দিতে পারে না, হেরম্ব তা জানে। সে স্বীকার করে বলল, ‘তা যায় না আনন্দ, কিন্তু সেজন্য তুমি বিচলিত হচ্ছ কেন? বেশীদিন নাইবা বাঁচল, যতদিন বাঁচবে তাতেই আমাদের ভালোবাসা ধন্য হয়ে যাবে। ভালবাসা মরে গেলে আমাদের যে অবস্থা হবে এখন তুমি তা যত ভয়ানক মনে করছ, তখন সে রকম মনে হবে না। ভালবাসা মরে কখন? যখন ভালবাসার শক্তি থাকে না। যে ভালবাসতে পারে না, প্রেম না থাকলে তার কি এসে যায়?’ আনন্দ বিস্মিত হয়ে বলল, ‘একি বলছ? যা নেই তার অভাববোধ থাকবে না?’

‘থাকবে, কিন্তু সেটা খুব কষ্টকর হবে না। আমাদের মন তখন বদলে যাবে।’

‘যাবেই? কিছুতেই ঠেকানো যাবে না?’

সোজাসুজি, জবাব হেরম্ব দিল না। হঠাৎ উপদেষ্টার আসন নিয়ে বলল, ‘এসব কথা নিয়ে মন খারাপ ক’রো না, আনন্দ। বেশীদিন বাঁচলে কি প্রেমের দাম থাকত? তোমার ফুলগাছে ফুল ফুটে ঝরে যায়, তুমি সেজন্য শোক কর নাকি?’

‘স্কুল যে রোজ ফোটে।’

কিছুক্ষণের জন্য হেরম্ব বিপন্ন হয়ে রইল। তার মনে হল, আনন্দের কথায় একেবারে চরম সত্যটি রূপ নিয়েছে, এখন সে যাই বলুক সে শুধু তর্কের খাতিরে বলা হবে, তার কোন মানে থাকবে না। ক’দিন থেকে প্রয়োজনীয় নিদ্রার অভাবে হেরম্বের মস্তিষ্ক অবসন্ন হয়ে পড়েছিল, জোর করে ভাবতে গিয়ে তার চিন্তাগুলি যেন জড়িয়ে যেতে লাগল। অথচ সত্যতে চিরদিন বিনা প্রতিবাদে গ্রহণ করে এসে আনন্দের উপমা-নিহিত অন্তিম সত্যকে কোনরকমে মানতে পারছে না দেখে তার আশা হল, বংশহীন ফুলের মতো একবার মাত্র বিকাশ লাভ করে ঝরে যাওয়ার ব্যর্থতাই মানব-হৃদয়ের চরম পরিচয় নয়, বিকাশের পুনরাবৃত্তি হয়তো আছে, হৃদয়ের পুনর্জন্ম হয়তো অবিরাম ঘটে চলেছে। মানুষের মৃত্যু-কবলিত জীবন যেমন সার্থক, তেমনি সার্থকতা ক্ষণজীবী হৃদয়েরও হয়তো আছে।

 

 

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ২৬ তম কিস্তি )

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ২৬ তম কিস্তি )

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024