বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ০১:৩৭ পূর্বাহ্ন

জুলফিকার আলী ভুট্টোর মৃত্যুদণ্ডকে কেন ‘বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’ বলা হয়?

  • Update Time : শনিবার, ৬ এপ্রিল, ২০২৪, ৩.০০ পিএম

-সারাক্ষণ ডেস্ক:

প্রায় ৪৫ বছর আগে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর ফাঁসির সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল নাকি ছিল না? ১৩ বছর আগে দায়ের করা এই প্রেসিডেন্সিয়াল রেফারেন্সের উপর সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক রায় ঘোষণা নিয়ে নানা আলোচনা চলছে।

রায়ে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর হত্যার বিচার অন্যায় হয়েছে।ওই সময়ে বিচার পর্যায়ে এবং আপিল আদালতে রায়ের অনুমোদন- উভয় ক্ষেত্রেই যথাযথ প্রক্রিয়ার অভাব ছিল বলে বিচারক জানান।সুপ্রিম কোর্টের নতুন এই রায়ের মাধ্যমে ঐতিহাসিক ভুল সংশোধন হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারি ২০১১ সালে এই রেফারেন্স দায়ের করেছিলেন এবং গত ১৩ বছরে এই প্রেসিডেন্সিয়াল রেফারেন্সের উপর মোট ১২টি শুনানি অনুষ্ঠিত হয়েছে।বর্তমান দেশটির প্রধান বিচারপতি কাজী ফয়েজ ঈসার নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের নয় সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চ প্রেসিডেন্সিয়াল রেফারেন্সের উপর সাতটি শুনানি শেষে ৪ঠা মার্চ প্রেসিডেন্সিয়াল রেফারেন্সের উপর পর্যবেক্ষণ দেয়।

এরপরই রায় ঘোষণা হয়। রায় শোনার পর প্রয়াত সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নাতি বিলাওয়াল ভুট্টো-জারদারির চোখ সিক্ত হয়ে ওঠে। তবে তাকে দেখে মনে হয়েছে তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন।

ইতিহাসের পাতায় চোখ বুলালে এমন কিছু বিতর্কিত বিচারিক হত্যাকান্ডের খোঁজ পাওয়া যায়। উদাহরণ স্বরুপ নবাব মীরজাফরের মৃত্যুর পর ইংরেজরা তার নাবালকপুত্র নাজিমউদ্দৌলাকে বাংলার নবাব পদে অধিষ্ঠিত করে। নন্দকুমার (১৭০৫-১৭৭৫) ছিলেন ওই সময় নবাবের দেওয়ান। নন্দকুমারের সঙ্গে হেস্টিংসের সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় এক জালিয়াতি মামলায় প্রধান বিচারপতি ইম্পের সহযোগিতায় তাকে (নন্দকুমার) ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো হয়। ভারতে ইংরেজ শাসনের অধীনে নন্দকুমারই প্রথম ব্যক্তি, যিনি ফাঁসির আসামি হিসাবে বলি হন। এমন কথা প্রচলিত আছে যে, এ মিথ্যা প্রহসনমূলক মামলায় হেস্টিংসকে সহযোগিতা করার জন্য নির্লজ্জভাবে পক্ষপাতিত্ব করেছেন স্বয়ং প্রধান বিচারপতি এলিজাহ ইম্পে। যার ফলে নন্দকুমারের ফাঁসির ওই ঘটনাকে সমসাময়িক ঐতিহাসিক ও চিন্তাবিদগণ ‘বিচারিক হত্যা’ (Judicial murder) বলে অভিহিত করেছেন। বিচারিক হত্যা মানে ‘আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া’।

এমন ঘটনার একটি জ্বলন্ত উদাহরণ পাকিস্তানের সেনাশাসক জেনারেল জিয়াউল হক কর্তৃক সে দেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝোলানো (৪ এপ্রিল ১৯৭৯)। নেতি-ইতি যাই হোক, এ মামলা ও বিচারে গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস, প্রধান বিচারপতি এলিজাহ ইম্পে এবং বার্ক-মেকলের ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে আছে।

জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ফাঁসি দেওয়ার সিদ্ধান্তকে কেন বিচার বিভাগীয় হত্যা বলা হয় সে বিষয়ে এই নিবন্ধ থেকে ধারণা পাওয়া যাবে।সম্প্রতি পাকিস্তানের স্থানীয় ইংরেজি দৈনিক ‘The Lark` এ বিশ্লেষক সারজিল ইনাম মেনন লিখেছেন, “ভুট্টোর ফাঁসির রায়ে স্বচ্ছতা ছিলনা”।

 

নবাব মোহাম্মদ আহমেদ খান কাসুরি

 

”আমি বলছি, শাহ নওয়াজ ভুট্টোর ছেলে জুলফিকার আলী ভুট্টো, সাকনা আল মুর্তজা, লারকানা।” (মি. ভুট্টো সিন্ধ প্রদেশের লারকানা শহরের আল মুর্তজা ভবনে থাকতেন)

”কী বলছেন স্যার? কী বলছেন স্যার?”

ভীষণ উদ্বেগ নিয়ে এ কথা বলতে গিয়ে লাহোরের আসড়া থানার পুলিশ কর্মকর্তা এসএইচও ইন্সপেক্টর আবদুল হাইয়ের হাত থেকে কলমটি পড়ে যায়। এই কথোপকথনের বর্ণনাকারী জানিয়েছেন, ১৯৭৪ সালের ১০ এবং ১১ই নভেম্বরের মধ্যবর্তী গভীর রাতে পাকিস্তানের তৎকালীন পার্লামেন্টের সদস্য এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের তথ্য সচিব আহমদ রাজা কাসুরি এই কথা বলেন এবং তার কথা পুনরাবৃত্তি করেন।

ওই রাতে লাহোরের সাদমান কলোনিতে আহমদ রাজা কাসুরির গাড়ি লক্ষ্য করে অতর্কিত হামলা চালানো হয়েছিল। তখন ওই গাড়িতে ছিলেন তার বাবা নবাব মোহাম্মদ আহমেদ খান কাসুরি, মা এবং খালা। “কয়েক ঘণ্টা আগে যে হামলা হয়েছে এতে তিনি, তার মা ও খালা বেঁচে গেলেও তার বাবা গুরুতর আহত হয়েছেন।”

যখন তাকে জিজ্ঞেস করা হয় তিনি কাউকে সন্দেহ করছেন কিনা তখন তিনি জুলফিকার আলী ভুট্টোর নাম নেন। গত বছর টিসিএম নামে একটি ইউটিউব চ্যানেলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে আহমেদ রাজা কাসুরি বলেছিলেন যে, লাহোরের ইউনাইটেড খ্রিস্টান হাসপাতালের সার্জন যখন তাকে বলেছিলেন যে তার বাবা নবাব মুহাম্মদ আহমেদ খান আর নেই। তখন তিনি পুলিশকে একই কথা লিখিতভাবে জানাতে চেয়েছিলেন।

আহমদ রাজা কাসুরি নিজেকে এই হামলার লক্ষ্যবস্তু বলে ঘোষণা করেন এবং পুলিশের সামনে তার বিবৃতিতে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে দায়ী করেন।

জুলফিকার আলী ভুট্টো

 

জুলফিকার আলী ভুট্টো কে ছিলেন?

জুলফিকার আলী ভুট্টো, সিন্ধ রাজ্যের রাজনীতিবিদ স্যার শাহনওয়াজ ভুট্টোর ছেলে। তিনি ১৯২৮ সালের ৫ই জানুয়ারি, জন্মগ্রহণ করেন।তিনি মুম্বাইতে তার প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। এরপর বার্কলে এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পলিটিক্যাল সায়েন্সে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন। তারপর লিঙ্কনস ইন থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন।

১৯৫৩ সালে করাচীতে ফিরে আসার পর কিছু সময়ের জন্য আইন শিক্ষার পাশাপাশি ওকালতি শুরু করেন তিনি। ১৯৫৭ এবং ১৯৫৮ সালে, জুলফিকার আলী ভুট্টো সরকারি প্রতিনিধি দলের অংশ হয়ে জাতিসংঘে পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। একই বছর জেনারেল মুহাম্মদ আইয়ুব খান ২৭শে অক্টোবর সামরিক আইন জারি করেন এবং ৩০ বছর বয়সী এই তরুণ আইনজীবীকে তার বাণিজ্যমন্ত্রী করেন।

পরে ছয় সাতটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন মি. ভুট্টো। ১৯৬৩ সালের ২৪শে জানুয়ারি, , জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন। কিন্তু ১৯৬৬ সালের ১৭ই জুন আইয়ুব খান এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো আলাদা হয়ে যান।এরপর মি. ভুট্টো তার নতুন রাজনৈতিক দল, পাকিস্তান পিপলস পার্টি গঠন করেন।

১৯৬৭ সালের ৩০শে নভেম্বর দলটি প্রতিষ্ঠা পায়। এর মাত্র তিন বছর পর, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে, তিনি বর্তমান পাকিস্তান বা তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের মোট ১৩৮টি আসনের মধ্যে ৮১টিতে জয়লাভ করেন এবং পাঁচটি নির্বাচনী এলাকা থেকে নির্বাচিত হন।

আইয়ুব খান

সে সময় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ মোট ৩০০টির মধ্যে ১৬০টি আসনে জয় পেয়েছিল। সে হিসেবে আওয়ামীলীগের সরকার গঠনের কথা থাকলেও তা আর হয়নি। ফলে দীর্ঘ নয় মাসের একটি রক্তক্ষয়ী ‍যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে পূর্ব পাকিস্তান ‘বাংলাদেশ’ নামে একটি পৃথক দেশে পরিণত হয়।

১৯৭১ সালের ২০শে ডিসেম্বর, জেনারেল ইয়াহিয়া খান যিনি ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের উত্তরসূরি হয়েছিলেন, তিনি সংবিধানের অনুপস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসাবে জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে তার ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।

এই সামরিক আইন ১৯৭২ সালের ২০শে এপ্রিল অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান প্রবর্তনের মাধ্যমে শেষ হয় এবং জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৯৭২ সালের ২১শে এপ্রিল দ্বিতীয়বারের জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। ১৯৭৩ সালের ১৪ই অগাস্ট, যখন পাকিস্তানের প্রথম একীভূত সংবিধান কার্যকর হয়, তখন মি. ভুট্টো পাকিস্তানের প্রথম নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।

লাহোরের ওই পুলিশ কর্মকর্তার হাত থেকে কলম পড়ে যাওয়ার কারণ হল, মি. ভুট্টোর বিরুদ্ধে যখন হামলার অভিযোগ এসেছে তখন তিনি দেশটির প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।

যাইহোক, আহমেদ রাজা কাসুরির মতে, তিনি একটি ব্যক্তিগত বক্তব্যে তার পিতার হত্যায় ভুট্টোর নাম উল্লেখ করেছিলেন এবং এর ভিত্তিতে একটি এফআইআর নথিভুক্ত করা হয়। তৎকালীন পাঞ্জাব পুলিশ প্রধান রাও আবদুল রশিদের মতে, তিনি হত্যার এফআইআর-এ ভুট্টোর নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আহমেদ রাজা কাসুরির দাবি মেনে নিয়েছিলেন।

তার মতে, “যদি এটা কোন ষড়যন্ত্র হতো এবং ভুট্টো যদি এটি করতেন, তাহলে আমরা কি আহমেদ রাজা কাসুরিকে এফআইআর করতে বলতাম?”

 

আহমদ রাজা কাসুরি নিজেকে হামলার লক্ষ্যবস্তু ঘোষণা করে, পুলিশের সামনে তার বিবৃতিতে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে দায়ী করেন

আহমেদ রাজা কাসুরি কেন ভুট্টোকে অভিযুক্ত করলেন?

১৯৬৬ সালে, যখন ভুট্টো আইয়ুব খানের মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন এবং লারকানায় ফেরার পথে ট্রেনে লাহোরে আসেন, তখন যারা তাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন তাদের মধ্যে কাসুরি ছিলেন একজন। কাসুরি বলেছেন যে, লাহোর রেলওয়ে স্টেশনে ভুট্টোর সেলুনে তাদের দেখা হয় এবং সেখান থেকে তাদের বন্ধুত্ব শুরু হয়েছিল। এরপর ভুট্টোকে কাসুর শহরে আমন্ত্রণ জানান মি. কাসুরি।

আহমদ রাজা কাসুরি বলেছেন “প্রথমে আমি তাকে বাবা বলহে শাহের মাজারে নিয়ে যাই যেখানে দস্তর বন্দী (পাগড়ি পরানোর অনুষ্ঠান) অনুষ্ঠিত হয়েছিল।” প্রাসাদে ফেরার পথে, আমি ভুট্টোকে জিজ্ঞেস করেছিলাম যে তিনি এই ঋষির সম্পর্কে কিছু জানেন কি না, যেখানে আমি তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম।

ভুট্টো জবাব দিলেন: খুবই সামান্য।

আমি বলেছিলাম এরা পাঞ্জাবের মহান বিপ্লবী। তিনশ বছর ধরে তিনি স্থিতাবস্থা ভেঙে দিয়েছেন, তার কথা খুবই শক্তিশালী। তিনি স্লোগান তুলেছিলেন ‘মাং ওয়ে বান্দিয়া, কো লু জুলি, গুলি, কুলি’।

ভুট্টো জিজ্ঞেস করলেন এর মানে কি? আমি বললাম: কাপড় পুড়ে গেছে, রুটি পুড়ে গেছে আর ঘর পুড়ে গেছে। ভুট্টো বলেছিলেন কেন না আমরা এটাকে আমাদের ইশতেহারের একটা অংশ করে নেই। এরপর পাকিস্তান পিপলস পার্টির স্লোগান হয় রোটি, কাপড়া অর মাকান। বাংলায় যার অর্থ রুটি, কাপড় আর ঘর।

 

+কসুর থেকে এই স্লোগান নেওয়া হয়েছে। হযরত বাবা বলহে শাহের কাছ থেকে। তারপর, পিপলস পার্টির নিয়মিত বৈঠকের তিন দিন আগে, ভুট্টো কাসুরে তার বাসভবনে, ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি কিছু একটা করতে যাচ্ছেন। এরপর ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে, আহমদ রাজা কাসুরি পাকিস্তান পিপলস পার্টির ব্যানারে কাসুর থেকে পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হন।

১৯৬৭ সালে পাকিস্তান পিপলস পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন জুলফিকার আলী ভুট্টো

কিন্তু নির্বাচনের পরপরই, পার্টির চেয়ারম্যানের সাথে তার মতপার্থক্য শুরু হয় যখন ভুট্টো ঘোষণা করেন যে তিনি ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ ঢাকায় ডাকা পার্লামেন্টের অধিবেশনে যোগ দেবেন না। তিনি পার্লামেন্টের অন্য কোনো সদস্যকেও তা করতে দেবেন না। কিছু পত্রিকার খবর অনুযায়ী, ভুট্টো বলেছিলেন, যারা এটা করবে তাদের পা ভেঙ্গে দেয়া হবে।

এরপরও বৈঠকে অংশ নিতে আহমেদ রাজা কাসুরি ঢাকায় পৌঁছান কিন্তু সেই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। ওই ঘটনার পর থেকেই ভুট্টোর সঙ্গে কাসুরির দূরত্ব বাড়তে থাকে। আকিল আব্বাস জাফরির গবেষণা অনুসারে, কাসুরি ফিরে এলে ভুট্টো কাসুরিকে দলীয় নীতির সাথে একমত না হওয়ায় পার্লামেন্টের আসন থেকে পদত্যাগ করতে বলেন, কিন্তু কাসুরি তা প্রত্যাখ্যান করেন।

তিনি দাবি করেন, পিপলস পার্টির কারণে নয় বরং নিজ জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে তিনি এ আসনে জয়ী হয়েছেন। মেরাজ খালিদ, হানিফ রামে ও ইয়াকুব খানের অভিযোগের আলোকে মি. ভুট্টো পরে আহমদ রাজা কাসুরিকে দলীয় সদস্যপদ থেকে বরখাস্ত করেন।

পরের দিন, লাহোরে এক সংবাদ সম্মেলনে ভাষণ দেওয়ার সময়, কাসুরি পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান পদ থেকে ভুট্টোকে বরখাস্ত করার ঘোষণা দেন। ১৯৭১ সালের ৬ই জুন পিপলস পার্টির কার্যনির্বাহী কমিটি আনুষ্ঠানিকভাবে কাসুরিকে দলের সদস্যপদ থেকে বহিষ্কার করে।

এভাবে ভুট্টো এবং কাসুরির মধ্যে সম্পর্কের খাদ আরও গভীর হয়।

যে গাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটেছিল

“ভুট্টো, আমি তোমাকে ছাড়ব না”

১৯৭২ সালে, যখন পার্লামেন্টের অধিবেশন শুরু হয়, আহমেদ রাজা কাসুরি পিপলস পার্টির জয়ী আসনটি ছেড়ে না দিয়ে তেহরিক-ই-ইসতিকালে যোগ দেওয়ার ঘোষণা দেন। যখন ১৯৭৩ সালের সংবিধান পার্লামেন্টে অনুমোদনের জন্য আসে, তখন কাসুরি সেই তিনজনের মধ্যে ছিলেন যারা এতে স্বাক্ষর করেননি।

বিধানসভায় ভুট্টো ও পিপলস পার্টির বিরুদ্ধে কাসুরির বক্তৃতা চলতে থাকে। এরপর ১৯৭৪ সালের ৪ঠা জুন পার্লামেন্টের এক বক্তৃতায় ভুট্টো বলেছিলেন যে “সংবিধান নিয়ে বিরোধীদের শোরগোল ও হৈচৈ অযৌক্তিক কারণ বিরোধী দলের সকল সদস্য সংবিধানে স্বাক্ষর করেছেন এবং এটি একটি সর্বসম্মত সংবিধান।”

এর প্রেক্ষিতে কাসুরি স্পিকারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, রতু ডেরোর বিশিষ্ট বক্তা মিথ্যা বক্তব্য দিয়েছেন। সারা বিশ্ব জানে আমি সংবিধানে স্বাক্ষর করিনি। এর পক্ষে ভোট দেইনি। তাহলে আপনি কিভাবে বলতে পারেন যে সংবিধানে সকলের স্বাক্ষর হয়েছে এবং এটি একটি সম্মত সংবিধান?’

তার এমন মন্তব্যে ভুট্টো ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন এবং কাসুরির প্রতি ইঙ্গিত করে চিৎকার করে বলেন, “আমি এই লোকটিকে খুব বেশি সহ্য করেছি। এই জলজ্যান্ত বিষ একজন খুনি। এখন আমরা তাকে কিছুতেই সহ্য করব না।”

পার্লামেন্টে ভুট্টোর ভাষণের প্রায় পাঁচ মাস পর ১৯৭৪ সালের ১১ই নভেম্বর কাসুরের পরিবারের ওপর ওই হামলার ঘটনা ঘটে। পরের দিন, ১২ই নভেম্বর পাকিস্তানের রাজনৈতিক দল তেহরিক ইস্তিকলালের প্রধান আসগর খান লাহোরে (রাজনীতিবিদ ও মানবাধিকার আইনজীবী) মিয়া মেহমুদ আলী কাসুরির বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলন করেন।

পাকিস্তানের ইংরেজি দৈনিক ডনে এ সংক্রান্ত খবর প্রকাশ হয়। ওই খবর অনুযায়ী সংবাদ সম্মেলনে আসগর খান বলেছিলেন, “হত্যাকারীরা আহমেদ রাজাকে হত্যা করেছে ,তারা কাসুরিকে হত্যার চেষ্টা করেছিল এবং এর আগেও তিনবার হামলা হয়েছে।

তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, “এ পর্যন্ত ২৪ জন রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছে যাদের হত্যাকারীদের খুঁজে পাওয়া যায়নি।”

জাতিসংঘে পাকিস্তানকে প্রতিনিধিত্ব করেন জুলফিকার আলী ভুট্টো

সরকারকে অভিযুক্ত করে মাহমুদ আলী কাসুরি বলেন, এ পর্যন্ত পার্লামেন্টের সদস্য ড. নাজির আহমেদ, খান আবদুল সামাদ আচাকজাই, মাওলানা শামসুদ্দিন, খাজা মুহাম্মদ রফিক এবং অন্যান্য অনেক রাজনৈতিক নেতা ঘাতকদের গুলিতে নিহত হয়েছেন। এ সময় ধারাবাহিক রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বন্ধের দাবি জানান তিনি।

১৯৭৪ সালের ২০শে নভেম্বর, বাবার হত্যার নয় দিন পর, মি. কাসুরি একটি লাল তরলের বোতল নিয়ে পার্লামেন্টের অধিবেশনে আসেন।বোতলটিতে তার বাবার রক্ত ছিল বলে দাবি করেন তিনি। তিনি একটি রক্তমাখা শার্ট নিয়ে এসে ঘোষণা দেন যারা সরকারি পার্লামেন্ট সদস্যদের খুন করেছে তাদের পরিচয় ফাঁস করা হবে।

টিসিএমকে দেওয়া তার সাক্ষাতকারে কাসুরি বলেছেন যে তিনি বিধানসভায় বলেছিলেন ‘ভুট্টো, আমি তোমাকে ছাড়ব না, আমি তোমাকে দোষী প্রমাণ করে ছাড়বো।’ এর আগে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হানিফ রামে লাহোর হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির পরামর্শে নবাব মুহাম্মদ আহমেদ খান হত্যার তদন্তের জন্য বিচারপতি শফিউর রহমানকে নিয়োগ দেন।

এই ট্রাইব্যুনাল ১৯৭৫ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি, সরকারের কাছে তার প্রতিবেদন জমা দেয়, কিন্তু সরকার প্রতিবেদনটি প্রকাশের অনুমতি দেয়নি। হত্যাকারীদের কোনো সন্ধান না পাওয়ায় ১৯৭৫ সালের অক্টোবরে মামলাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়।

আহমদ রাজা কাসুরি

আহমদ রাজা কাসুরির পিপলস পার্টিতে প্রত্যাবর্তন

পাকিস্তানের রাজনীতি বিশ্লেষক আকিল আব্বাস জাফারি লিখেছেন যে “আহমদ রাজা কাসুরি ট্রাইব্যুনালে তার হলফনামায় স্বীকার করেছেন যে প্রধানমন্ত্রীর সাথে তার শত্রুতার কারণে এই হামলা সংঘটিত হয়নি।”

ট্রাইব্যুনালের রিপোর্ট শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কাসুরি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা শুরু করেন। তিনি জানতেন যে কাসুর শহর পিপলস পার্টির শক্ত ঘাঁটি এবং পিপলস পার্টির সাহায্য ছাড়া তিনি নির্বাচনে সফল হতে পারবেন না। ভুট্টো তার সাথে দেখা করতে অস্বীকার করেন।

প্রধানমন্ত্রীকে রক্তাক্ত চিঠি লেখেন কাসুরি। প্রধানমন্ত্রী শেষ পর্যন্ত কাসুরিকে দলের কাতারে ফিরিয়ে নিতে রাজি হন। ১৯৭৬ সালের ৬ই এপ্রিল তিনি বেগম নুসরাত ভুট্টোর সাথে দেখা করে অনুরোধ করেন তিনি যেন অনুগ্রহ করে তার দলে ফিরে আসা উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন।

পরের দিন, লাহোরের মডেল টাউনে তার বাসভবনে কর্মীদের এক সভায় ভাষণ দেওয়ার সময় তিনি পিপলস পার্টিতে পুনরায় যোগদানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। ওই সংবর্ধনা আয়োজনে তিনি প্রধানমন্ত্রীর ভূয়সী প্রশংসা করেন। তার মা (বেগম নবাব মুহাম্মদ আহমদ খান কাসুরি) প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি প্রধানমন্ত্রীর জন্য তার সমস্ত ছেলেকে বলি দেবেন কারণ প্রধানমন্ত্রী ভুট্টো ছাড়া পাকিস্তান থাকবে না।

কাসুরি ১৯৭৭ সালের জানুয়ারিতে পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রীর কৃষি সংস্কারেরও প্রশংসা করেছিলেন। তবে, পাকিস্তান পিপলস পার্টি ১৯৭৭ সালের মার্চের নির্বাচনে আহমেদ রাজা কাসুরিকে মনোনয়ন দেয়নি। দলের পার্লামেন্টারি বোর্ড তাকে ‘বিভ্রান্ত ব্যক্তি’ বলে অভিহিত করে।

জেনারেল জিয়া-উল-হকের সাথে জুলফিকার আলী ভুট্টো

ভুট্টো কোন মামলায় সাজা পেয়েছিলেন?

১৯৭৭ সালের ৫ই জুলাই জেনারেল জিয়া-উল-হক, জুলফিকার আলী ভুট্টোর সরকারকে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল করেন। আহমদ রাজা কাসুরির মতে, প্রায় এক সপ্তাহ পর, তিনি লাহোরের সেশন জজ আদালতে নবাব মুহাম্মদ আহমদ কাসুরিকে হত্যার ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করেন।

“কিছুদিন পরে, আমি হাইকোর্টে আবেদন করি যে অভিযুক্তরা বেশ ক্ষমতাধর, তাই আদালতের উচিত তার মামলাটি মূল ফৌজদারি অপরাধের ধারায় হস্তান্তর করা।” এফআইআর দেখার পর অ্যাডভোকেট জেনারেলকে তলব করে হাইকোর্ট। তার জায়গায় সহকারী অ্যাডভোকেট জেনারেল রশিদ আজিজ খানকে নিয়োগ করা হয়।

তিনি তার মক্কেল, পাঞ্জাব সরকারের কাছ থেকে নির্দেশনা নেওয়ার জন্য ১৫ দিন সময় চান। ১৫ দিন পর তিনি আদালতে বলেন, আমরা মামলা নিয়ে আসছি। এ কারণে আমরা এতে রাষ্ট্রপক্ষকে অন্তর্ভুক্ত করেছি। জুলফিকার আলী ভুট্টোকে পাকিস্তান দণ্ডবিধির অধীনে ‘হত্যার ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগে ১৯৭৭ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর প্রথমবারের মতো গ্রেফতার করা হয়, কিন্তু ১০ দিন পর তিনি জামিনে ছাড়া পান।

লাহোর হাইকোর্টের বিচারপতি কেএম সামদানি ১৩ই সেপ্টেম্বর ভুট্টোর জামিনের আবেদন মঞ্জুর করেন এবং তার বিরুদ্ধে আনা তথ্য প্রমাণকে ‘পরস্পরবিরোধী এবং অসম্পূর্ণ’ বলে অভিহিত করেন। ১৭ই সেপ্টেম্বর, নবাব মুহাম্মদ আহমদ কাসুরিকে হত্যার জন্য তাকে আবার গ্রেফতার করা হয়, কিন্তু এবার তিনি গ্রেফতার জন সামরিক আইনের অধীনে এবং ভুট্টোর বিচার শুরু হয় এক মাস পরে।

লাহোর হাইকোর্টের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মৌলভি মুশতাক হোসেন পাঁচ সদস্যের একটি বেঞ্চ গঠন করেন।

 

কারা ভুট্টোকে সাজা দিয়েছিলেন এবং কীভাবে তারা বিতর্কিত হয়েছিলেন?

সাংবাদিক সৈয়দ সফদার গার্দিজি গবেষণা করেছেন যে, লাহোর হাইকোর্টের তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি মৌলভি মুশতাক হুসেন তার সভাপতিত্বে বিচারপতি জাকিউদ্দিন পাল, বিচারপতি এমএসএইচ কোরেশি, বিচারপতি আফতাব হুসেন এবং বিচারপতি গুল বাজ খানের সমন্বয়ে পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ গঠন করেছিলেন।

বিচারপতি সামদানি যিনি ভুট্টোকে জামিন দিয়েছিলেন, তাকে বেঞ্চের বাইরে রাখা হয়। আইন বিশেষজ্ঞ হামিদ খান অ্যাডভোকেট তার ‘কনস্টিটিউশনাল অ্যান্ড পলিটিক্যাল হিস্ট্রি অব পাকিস্তান’ বইতে লিখেছেন যে ‘মৌলভী মুশতাক খুব ভেবেচিন্তে বেঞ্চ বেছে নিয়েছিলেন।

জাকিউদ্দিন পাল, মি. ভুট্টোর ঘোর বিরোধী ছিলেন। মৌলভী মুশতাকের অনুমোদন পেয়েছিলেন বিচারপতি আফতাব হুসেন এবং তার কাজ ছিল মি. মুশতাককে অনুসরণ করা। অন্য দুই বিচারক অসম্মতিপূর্ণ রায় না লেখার জন্য বিখ্যাত ছিলেন। ভুট্টোর প্রতি মৌলভী মুশতাকের ব্যক্তিগত শত্রুতা ও বিদ্বেষ গোপন ছিল না।

নিজ মেয়াদে মৌলভী মুশতাকের লাহোর হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি হওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা ছিল। এ কারণে তিনি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হতেও রাজি হননি। ভুট্টোর সরকার তার আট বছরের জুনিয়র বিচারপতি আসলাম রিয়াজকে, লাহোর হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি করেন।

এ ঘটনায় মৌলভী মুশতাক পদত্যাগ করেননি, কিন্তু ভুট্টোর প্রতি তার অন্তরে ক্ষোভের আগুন জ্বলছিল। এই ব্যক্তিগত ক্ষোভের সুযোগ নিতে জেনারেল জিয়া-উল-হক তাকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি করেন।

ভুট্টো তাদের বিদ্বেষ সম্পর্কে অবগত ছিলেন তাই তিনি বিচার আদালত বয়কট করেন। মামলাটি স্থানান্তরের আবেদন জানানো হলেও মৌলভী মোশতাক তার চেম্বারে শুনানি শেষে আবেদন খারিজ করে দেন। একই মামলায় ফেডারেল সিকিউরিটি ফোর্সের অন্য চারজন কর্মীও বিচারাধীন ছিলেন। প্রাথমিকভাবে, আদালতের কার্যক্রম জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ছিল, কিন্তু ১৯৭৮ সালের ২৫শে জানুয়ারির পরে, এটি গোপন ঘোষণা করা হয়। ১৯৭৮ সালের ১৮ই মার্চ হাইকোর্ট অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র ও হত্যার দায়ে সকল আসামিকে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করে।

জুলফিকার আলী ভুট্টোকে পুলিশ প্রহরায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে

বিতর্কিত সিদ্ধান্ত

এই সিদ্ধান্ত ছিল বিচারিক ইতিহাসে অনেকগুলো আইনি দ্বন্দ্বের সমষ্টি। সাজা ঘোষণার পর, ‘ন্যাশনাল কমিটি করাচি’ কোনো লেখকের নাম ছাড়াই ‘ভুট্টোস রেজিম অ্যান্ড ফ্যাক্টস অব দ্য কেইস’ (‘ভুট্টোর শাসন ও মামলার তথ্য’) শিরোনামে ৮২ পৃষ্ঠার একটি বই প্রকাশ করে।

বইটির ভূমিকায় লেখা হয়েছে যে এর প্রথম অংশে ‘ভুট্টোর শাসনামলের কিছু আভাস দেওয়া হয়েছে যাতে তার চোখে আইন, প্রতিষ্ঠান এবং জনগণের নাগরিক ও মৌলিক অধিকারের গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়’ এবং দ্বিতীয় অংশে ‘সাধারণ ফৌজদারি আইন এবং প্রবিধানের উল্লেখ করা হয়েছে যার অধীনে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল।’

বইটির ভাষা এবং বিন্যাস দেখে একটি বিষয়ে স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে বইটি সরকারকে প্রশংসা করা, তাদের পক্ষে সাফাই গাওয়ার উদ্দেশ্যে ছাপা হয়েছিল। দেশ-বিদেশের অনেক দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ভুট্টোকে করুণা বা ক্ষমা করার আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭৮ সালের ২৬শে মার্চ সরকারি সংবাদ সংস্থা এপিপির বরাতে দৈনিক ‘দ্য সান’ পত্রিকায় ‘উইডোজ আপিল’ (বিধবার আবেদন) প্রকাশিত হয়।

রাওয়ালপিন্ডি ডেটলাইন থেকে পাওয়া খবরটি নিম্নরূপ: “নবাব মুহাম্মদ আহমদ খানের স্ত্রী আজ ‘ইনসাফ হি রহম হ্যায়’ (ন্যায়বিচারই করুণা) শিরোনামে একটি আপিল জারি করেছেন। ন্যায়বিচারকে এড়িয়ে যাওয়া করুণা নয়।” তাঁর শেষ বাক্যটি ছিল: ‘আল্লাহর দোহাই দিয়ে এই মন্দের অবসান ঘটান যাতে আইন মেনে চলা নাগরিকরা শান্তিতে বসবাস করতে পারে।’ ১৯৭৯ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট তিন থেকে চারটি খণ্ড খণ্ড রায়ে হাইকোর্টের সাজা বহাল রাখে।

জেনারেল জিয়া-উল-হক

তিন জন বিচারপতি- বিচারপতি করম এলাহি চৌহান, বিচারপতি মুহাম্মদ আকরাম এবং বিচারপতি নাসিম হাসান শাহ এই সিদ্ধান্তের সাথে একমত হয়েছেন যখন বিচারপতি সফদর শাহ, বিচারপতি দরব প্যাটেল এবং বিচারপতি মুহাম্মদ হালিম ভিন্নমতের নোট লিখেছেন। চারপতি আনোয়ার হক ভোটের অধিকার ব্যবহার করে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পথ প্রশস্ত করেন।

বিচারক বেঞ্চ প্রাথমিকভাবে নয়জন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত ছিল, কিন্তু কৌশলগত কারণে, কাঙ্ক্ষিত রায়ের পথ প্রশস্ত করার জন্য বেঞ্চ থেকে দুই বিচারপতিকে অপসারণ করা হয়। হামিদ খানের মতে, বিচার না হওয়া পর্যন্ত বিচারপতি কায়সার খানকে অ্যাডহক বিচারপতি হিসেবে বেঞ্চে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত ছিল। আমাদের সংবিধান এর অনুমতি দেয়। এমনটা না করার কারণ ছিল শুনানির সময় ট্রায়াল কোর্টের বিষয়ে তার শত্রুভাবাপন্ন দৃষ্টিভঙ্গি।

লেখক হামিদ খান লিখেছেন যে ‘অসুস্থতা থেকে সেরে ওঠা সত্ত্বেও, দ্বিতীয় বিচারপতি, ওয়াহেদুদ্দিনকে বেঞ্চে যোগ দেয়ার অনুরোধ সত্ত্বেও তাকে অনুমোদন দেওয়া হয়নি। প্রধান বিচারপতি তার উদ্দেশ্য জানতেন যে তিনি ভুট্টোর মুক্তির পক্ষে ভোট দেবেন। সাংবাদিক ইফতেখার আহমেদ জিও নিউজের অনুষ্ঠান ‘জাওয়াবাদ’-এর জন্য সাবেক বিচারপতি নাসিম হাসান শাহের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন।

তিনি আমাকে বলেছিলেন যে বিচারপতি নাসিম হাসান শাহের মতে, ভুট্টো সাহেবের আইনি দল যথাযথ পরিশ্রম করেনি এবং সে কারণেই তারা মামলাটি হেরেছে। তবে মোটা দাগে, তিনিও স্বীকার করেছেন যে বিচারকরা চাপের মধ্যে ছিলেন।

জুলফিকার আলী ভুট্টোর মেয়ে বেনজির ভুট্টো।

একই সময়ে, ইফতেখার আহমেদ বলেছেন যে “এই বিচারে ভুট্টোর বিরুদ্ধে বিচারপতি মুশতাক হুসেন এবং বিচারপতি আনোয়ার-উল-হকের বিদ্বেষ আমাদের বুঝতে হবে।” মৌলভী মুশতাক হুসেন বিশ্বাস করতেন যে বিচারপতি রিয়াজ হোসেনের পরিবর্তে তার প্রধান বিচারপতি হওয়া উচিত ছিল এবং ভুট্টো তাকে গালি দিয়েছেন।

একইভাবে ভুট্টো ষষ্ঠ সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতি মুহাম্মদ ইয়াকুব আলী খানের মেয়াদ বৃদ্ধি করেছিলেন, যার কারণে বিচারপতি আনোয়ার সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হতে পারেননি। তিনি খুবই কষ্ট পেয়েছিলেন। ভুট্টোর সরকার শেষ হলে জিয়া-উল-হক জোরপূর্বক বিচারপতি ইয়াকুবকে অবসরে নিয়ে বিচারপতি আনোয়ার-উল-হকের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি করেন।

সুপ্রিম কোর্টে ভুট্টোর আপিলের শুনানিকারী বেঞ্চের নেতৃত্বে ছিলেন এই প্রধান বিচারপতি আনোয়ার। জুলফিকার আলী ভুট্টোর আইনজীবী ইয়াহিয়া বখতিয়ারের পুনর্বিবেচনার আবেদন করলেও তা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল, তবে এর মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের ক্ষমা করার ক্ষমতা প্রয়োগের পথ পরিষ্কার হয়।

ক্ষমার অনুরোধের বিষয়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রসচিব রুইদাদ খান তার ‘পাকিস্তান অন দ্য ব্রিঙ্ক অফ রেভল্যুশন’ বইতে লিখেছেন, ‘১৯৭৯ সালের পহেলা এপ্রিল আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ইরশাদ খান ও জেনারেল কে এম আরিফ, ভুট্টোর মামলার সারসংক্ষেপ নেন। এরপর জিয়া-উল-হকের কাছে যান।”

রওয়াইদাদ খানের মতে, ইরশাদ খান তাকে বলেছিলেন যে ‘যখন তিনি সারসংক্ষেপ নিয়ে প্রেসিডেন্টের কাছে গিয়েছিলেন, প্রেসিডেন্ট ক্ষমার আবেদনটি পড়েও দেখেননি এবং না পড়েই তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।’

                                    -মৌলভি মুশতাকের সাথে মি. ভুট্টো।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ১৯৭৯ সালের ৪ঠা এপ্রিল রাত ২টায় ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষক সোহেল ওয়ারাইচের মতে, ‘ভুট্টো যদি তার জনপ্রিয়তার জোরে ফিরে আসেন তাহলে তিনি জিয়া-উল-হকের বিরুদ্ধে সংবিধানের ছয় নম্বর অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রদ্রোহিতার ধারায় বিচার করতেন, এমন প্রেক্ষাপটে বলা হয়েছিল, কবর একটি আর চাকর দুইজন।

“সুতরাং এই শাস্তির সিদ্ধান্ত এমনভাবে নেওয়া হয়েছিল যেখানে জিয়া-উল-হক নিশ্চিত করেছিলেন যে ভুট্টোকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। যাতে তিনি নিজেও বেঁচে যান এবং তার ক্ষমতাও রক্ষা পায়।”  ইফতিখার আহমেদ পিপলস পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। এক বাক্যে তার মতে সে সময় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া থমকে গিয়েছিল। এই রাজনৈতিক দলটি সবচেয়ে খারাপ সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিল।

এর কর্মীদের জেলে যেতে হয়েছে, নির্যাতন শিবিরে বেত্রাঘাত খেতে হয়েছে। অনেক কর্মীকে দেশ ছাড়তে হয়েছিল এবং এটি ছিল পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে একটি বড় জঘন্য ষড়যন্ত্রের সূচনা। সোহেল ওয়ারাইচ বলেছেন, এই শাস্তির ঘটনা পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক পরিচয়কে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বিচার বিভাগ, প্রতিষ্ঠানের পক্ষপাতিত্ব করেছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।

১৯৮৮ সালের মধ্যে, পিপলস পার্টিকে দমন করা হয়। নেতা-কর্মীদের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়।রাজনৈতিক বিশ্লেষক মজিদ নিজামীর মতে, এরপর দেশের রাজনীতি পুরোপুরি পাল্টে যায়। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিদ্বেষ তীব্র হয়ে ওঠে। ভুট্টো এবং ভুট্টো বিরোধী দুটি শিবিরে পরিণত হয় এবং রাজ্যের প্রাদেশিক সরকারকে পাঁচগুণ এবং ফেডারেল সরকার পিপলস পার্টিকে তিনবার ক্ষতিপূরণ দিতে হয়।

পার্লামেন্টে বক্তব্য দিচ্ছেন ভুট্টো।

ভুট্টো মামলায় প্রেসিডেন্সিয়াল রেফারেন্স

সুপ্রিম কোর্টের মূল সিদ্ধান্ত পরবর্তী কোনো মামলায় নজির হিসেবে উল্লেখ করা হয়নি। ২০১১ সালে, সাজা কার্যকরের প্রায় ৩২ বছর পরে, তৎকালীন প্রেসিডেন্ট এবং পিপলস পার্টির কো-চেয়ারম্যান আসিফ আলী জারদারি, সংবিধানের ১৮৬ অনুচ্ছেদের অধীনে একটি রেফারেন্সে, ভুট্টোর বিচার এবং মৃত্যুদণ্ড পর্যালোচনার বিষয়ে আদালতে একটি মতামত দেন।

ওই বিচারকাজ চলাকালে বিচারপতিদের ওপর চাপের বিষয়টি উল্লেখ করেন বিচারপতি নাসিম হাসান শাহ। তার এমন বক্তব্যের ভিত্তিতে এই প্রেসিডেন্সিয়াল রেফারেন্স পাঠানো হয়। প্রেসিডেন্সিয়াল রেফারেন্স পাঁচটি প্রশ্নের ভিত্তিতে ছিল। প্রথম প্রশ্ন ছিল ভুট্টো হত্যার বিচার সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক মানবাধিকার অনুযায়ী হয়েছে কিনা?

দ্বিতীয় প্রশ্নটি ছিল ভুট্টোকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তটি বিচারিক নজির হিসাবে ১৮৯ ধারার অধীনে সুপ্রিম কোর্ট এবং সমস্ত হাইকোর্টে প্রযোজ্য হবে কিনা। তা না হলে এই সিদ্ধান্তের পরিণতি কী হবে? তৃতীয় প্রশ্নটি ছিল ভুট্টোকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া সঠিক সিদ্ধান্ত কিনা। ভুট্টোর মৃত্যুদণ্ডের সিদ্ধান্ত কি পক্ষপাতমূলক ছিল কি না?

চতুর্থ প্রশ্ন ছিল ভুট্টোকে দেওয়া মৃত্যুদণ্ড কুরআনের নির্দেশের আলোকে সঠিক কিনা?

পঞ্চম প্রশ্ন ছিল জুলফিকার আলী ভুট্টোর বিরুদ্ধে প্রদত্ত প্রমাণ এবং সাক্ষীদের বক্তব্য তাকে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য যথেষ্ট কিনা। এই প্রেসিডেন্সিয়াল রেফারেন্স নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে এখন পর্যন্ত ১২টি শুনানি হয়েছে। প্রথম শুনানি হয় ২০১২ সালের ২রা জানুয়ারি এবং শেষটি ২০২৪ সালের ৪ঠা মার্চ।

জুলফিকার আলী ভুট্টো

প্রথম পাঁচটি শুনানি প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ইফতেখার চৌধুরীর নেতৃত্বে সুপ্রিম কোর্টের ১১ সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চ দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল, এবং শেষ শুনানিগুলো নয় সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চ দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। অ্যাডভোকেট বাবর আওয়ান প্রথমে ফেডারেল সরকারের প্রতিনিধিত্ব করলেও পরে আদালতের সমালোচনার কারণে তাকে বরখাস্ত করা হয়।

পিপলস পার্টির আইনজীবী আইতজাজ আহসানও দলীয় নেতা ইকবাল হায়দারের নামাজে জানাজায় থাকায় চূড়ান্ত শুনানিতে অংশ নিতে পারেননি। সুপ্রিম কোর্ট সহায়তার জন্য বেশ কয়েকজন আইন বিশেষজ্ঞকেও মনোনীত করেছিল, যাদের মধ্যে কেউ কেউ মারা গেছেন।

পিপলস পার্টি সব সময় এই সাজাকে বিচারিক হত্যা বলে অভিহিত করলেও এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। মজিদ নিজামীর মতে, ‘পিপলস পার্টির সরকার ব্যবস্থা নেয়নি কারণ এর সাথে অনেক যদি ও কিন্তু যুক্ত ছিল এবং মূল প্রশ্ন ছিল যে হত্যাকাণ্ডটি যদি ভুট্টোর নির্দেশে না ঘটে তবে কার নির্দেশে এটি ঘটেছে? তার কি শাস্তি হওয়া উচিত? তাই এই মামলাটি পুনরায় চালু করা উচিত হলেও এটি পুনরায় খোলার ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা ছিল।

এই মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকে মারা গেছেন, অনেক সংস্থার লোকজন বিতর্কিত হয়ে পড়েছেন, এমন অনেক প্রশ্ন ছিল। তাই এক অর্থে এটা ছিল রেফারেন্স পয়েন্ট স্কোরিং। ভুট্টোর বিরুদ্ধে প্রধান বাদী আহমেদ রাজা কাসুরি মামলাটি পুনরায় খোলার বিরোধিতা করেন। একইসঙ্গে মজিদ নিজামী বলেন, ভুট্টোর আমলে নিহত অন্য রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্যও দলগুলোর পক্ষ থেকে আসতে থাকে।

 

জুলফিকার আলী ভুট্টো

সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে ১৯৭৯ সালের ৪ঠা এপ্রিল রাত ২টায় ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এই রেফারেন্স জমা দেয়ার সময় বলা হয়েছিল, রাজনৈতিক কারণে নিহত নেতাদের মামলারও আবার শুনানি করতে হবে। তাই হয়তো সেই সময়ের বিচার বিভাগের মাথায় এসেছিল এই সব বিষয় গর্ত খুঁড়ে বের করা উচিত।

পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি কাজী ফয়েজ ঈসার নেতৃত্বে বিচারপতি সরদার তারিক মাসুদ, বিচারপতি মনসুর আলি শাহ, বিচারপতি ইয়াহিয়া আফ্রিদি, বিচারপতি আমিনুদ্দিন খান, বিচারপতি জামাল খান মন্ডুখেল, বিচারপতি মোহাম্মদ আলী মাজহার, বিচারপতি হাসান আজহার রিজভি ও বিচারপতি মুসরাত হিলালির সমন্বয়ে গঠিত নয় সদস্যের বেঞ্চ বেঞ্চ এই আদেশ দেন।

মজিদ নিজামীর মতে, “যদি এই রেফারেন্সের ভিত্তিতে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তবে এর মর্যাদা হবে প্রতীকী।”

ইফতেখার আহমদ বলেছেন, “এটি হবে ইতিহাসের বাস্তবতার সঠিক রূপ দেয়া,” অন্যদিকে সোহেল ওয়ারাইচ বিশ্বাস করেন যে “সিদ্ধান্তটির প্রতীকী এবং ঐতিহাসিক মর্যাদা থাকবে এবং বিচার বিভাগের ওপর থেকে কালো দাগ ধুয়ে মুছে যাবে।”

 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024