সারাক্ষণ ডেস্ক
তখন ১৯০৮ সাল। ছোট্ট সালিম আলী মনের সুখে পাখি শিকার করতেন এয়ারগান দিয়ে। তার গুলিতে ঘায়েল হয়েছিল এক আজব ধরনের চড়ুই। সেটার মাংস হালাল কিনা তা জানার জন্য পকেটে নিয়ে সোজা চলে গেলেন চাচা আমিরুদ্দিনের কাছে।
আমিরুদ্দিন ছিলেন বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির আদি সদস্যদের একজন।
তারই সুপারিশপত্র দুরুদুরু বুকে নিয়ে বালক সালিম দেখা করলেন সোসাইটির সেক্রেটারি জনাব মিলার্ডের সাথে। মিলার্ডের অমায়িক ব্যবহারে সালিম বুঝলেন জগতের সব শ্বেতাঙ্গ এক ধরনের হয় না। যেমনটা তিনি শুনে এসেছেন।
প্রথম দর্শনেই পাখিটির ঠিকুজি জানা গেল ইয়েলো থ্রোটেড স্প্যারো (Yellowthroated Sparrow, বৈজ্ঞানিক নাম- Petronia xanthocollis)। শুধু তাই না তিনি তার বিশাল সংগ্রহশালা উম্মুক্ত করে কৌতূহলী বালককে দেখালেন নানা ধরনের চড়ুই পাখি স্টাফ করা মৃতদেহ।
খুলে গেল তার মনের দরজা। শুরু হল এক নতুন যুগের – শুধু শুধু এয়ার গান দিয়ে মনের সুখে গুলি করে বেড়ানো ব্যাদড়া বালক ঝুঁকে পড়লেন পাখি এবং প্রকৃতি নিয়ে বিশদ ভাবে জানতে। পরিণত হলেন ভারতীয় উপমহাদেশের সেরা পাখিবিশেষজ্ঞে। তারই কিচিরমিচিরে রচিত হয়েছে দ্য ফল অব আ স্প্যারো (The Fall of A Sparrow), প্রকৃতির স্নিগ্ধ পরশ বুলানো সুখপাঠ্য আত্মজীবনী।
৮৭ বছর বয়সে বইটি লেখা শুরু করেন, ততদিনে চিরতরুণ পাখিবুড়ো উপাধি পেয়ে যান সালিম আলী। প্রথমেই স্মৃতির ঝাঁপি খুলে শৈশবের কথা বলেছেন। সেই ধূসর সময়ে প্রকৃতিসংরক্ষণ জিনিসটাই ছিল মাঝে মাঝে শোনা বিরল একটি বিষয়। বাজারে কোয়েল, তিতির ইত্যাদি ধরনের পাখি বিক্রি হতো প্রচুর, শিকারের অভাব ছিল না কোথাও। পাখি নিয়ে উপমহাদেশে কাজ শুরু করেছিলেন যে ব্রিটিশ সাহেবেরা তাদের বালকজীবনে শখের বসে পাখি ডিম সংগ্রহ করা ছাড়া এমন কোন অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু উপমহাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্য, অঢেল সময় এবং একাকীত্বের সদ্ব্যবহারের জন্য অনেকেই এই বিষয়ের প্রতি আকৃষ্ট হন, এবং গুরুত্বপূর্ণ সব কাজ করেন।
বাসায় খাবার জন্য কিনে আনা সেই পাখির গাদা থেকে উনি কয়েকটা চুপচাপ সরিয়ে ফেলতেন এবং তারের জাল ও পুরাতন প্যাকিং বাক্স দিয়ে বাসা বানিয়ে সেখানে জবেহ করার হাত থেকে উদ্ধার করা পাখিগুলো পুষতেন। হয়তো এই ভাবেই শিশুমনে পাখি প্রেম জেগে উঠেছিল।
যখন তার হাত খরচের জন্য মাসিক বরাদ্দ ছিল দুই টাকা, সেটা থেকেও সালিম আলী নিয়মিত এলাকার পাখির বাজারে গিয়ে নতুন নতুন পাখি সংগ্রহের চেষ্টা করতেন। আবার মাত্র ৯/১০ বছর বয়সে তিনি পাখি সংক্রান্ত প্রথম নোটটি লিখেছিলেন খাতায়, সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হচ্ছে তার ৬০ বছর পরে এটি নতুন করে আবিষ্কার করে লেখাটির একটু খোল নলচে বদল করে নিউজ লেটার ফর বার্ড ওয়াচার্স-এ দিলে সসম্মানে ছাপা হয়।
সালিম আলীর মনের পর্দায় ভেসে ওঠে স্কুলজীবনের নানা রঙের দিনগুলি- তিনি মাঝারি মানের ছাত্রই ছিলেন, গৎবাঁধা লেখাপড়া তাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি কখনোই, তাই ১৯৩৪ সালে প্রকাশিত ভারতীয় লেখকদের বাছাইকৃত রচনা নিয়ে প্রকাশিত বইয়ে নিজের লেখা দেখে বেশ অবাক হয়েছিলেন, বিশেষ করে যেখানে ঠাই পেয়েছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সরোজিনী নাইডুর রচনাও! নানা অসুখে ভুগে লেখাপড়ায় কিছুটা ছেদ ঘটে তার, অবশেষে ১৯১৩ সালে বম্বে বিশ্ব –বিদ্যালয়ের অধীনে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন তিনি।
নানা রোমাঞ্চকর সত্য কাহিনী পড়ে তখন পর্যন্ত জীবনের লক্ষ্য ছিল বিখ্যাত একজন শিকারি হওয়া (বিগ গেম হান্টার) কিন্তু বাড়ীতে নানা ধরনের পাখি পোষা এবং প্রকৃতিতে পাখি দেখার নেশা থেকেই সিদ্ধান্ত নেন সম্ভব হলে জীববিজ্ঞানকেই পেশা হিসেবে নিবেন জীবনে। ১৯১৪ সালে তিনি বার্মা যান, মূলত এক আত্মীয়ের সাথে জীবিকা অর্জনের তাগিদে ব্যবসা করার জন্য।
সেই ৩ বছরের স্মৃতির কথা বলেছেন উচ্ছ্বসিত বর্ণনায়, বিশেষ করে নানা ধরনের রঙচঙে বার্মিজ পাখি দেখার অভিজ্ঞতা (যদিও তার দূরবীন ছিল না তখনও)। মজার ব্যাপার হচ্ছে সেই বিদেশবাসের দীর্ঘ ৬০ বছর পরেও সালিম আলী পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পাখিগুলো কোন স্থানের, কোন গাছের কোন ডালে কিভাবে বসেছিল তা মনে করতে পারেন! স্মৃতি বড় রহস্যময়।
বার্মার সেই চমৎকার বাড়ীতে স্ত্রী তাহমিনার সাথে নতুন জীবন শুরু হয় তার, সাথে যোগ দেয় বার্মিজ রূপালি ফেজ্যান্ট পাখির সংগ্রহ করা ডিম ফুটিয়ে বাহির হওয়া ছানা, বনবেড়াল, গাছছুঁচো, উড়ন্ত লিমার, পাকরা ধনেশ। তাহমিনা এবং সালিম একসাথে কিন্ডারগার্টেনে পড়তেন শিশুকালে, পরবর্তীতে তাহমিনা বাবার সাথে অনেক বছর বিলেতে কাটিয়ে ভারতবর্ষে ফেরেন। অনেকটা পারিবারিক ভাবেই তাদের বিয়ে হয় ১৯১৮র ডিসেম্বরে, সালিমের বয়স তখন মাত্র ২২!
স্ত্রী সম্পর্কে উজ্জল স্মৃতিচারণ করেছেন তিনি- তাহমিনা ভালবাসতেন বই, কবিতা ( উর্দু এবং ইংরেজি), প্রকৃতিতে হাঁটতে, ফুল, বাগানের পরিচর্যা, এবং স্বামীর কাজের সময় পাখি নিয়ে আসলেই উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন।
এর মাঝে সালিম বুঝতে পারেন যে প্রাণীবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করতে হলে সেই বিষয়ে তার প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি থাকা খুব জরুরী, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান রেভারেন্ড ব্ল্যাটার এবং শিক্ষক প্রফেসর মুল্লানের উৎসাহে ১৯১৭ সালে প্রাণীবিদ্যার উপরে বি এস সি পাশ করেন।
এরপরে তার যাযাবর জীবন এবং পাখিদের পরিযায়ী যাত্রা নিয়ে নানা স্থানের, নানা মানুষের বর্ণনা, পাখির পালকের মতই রং ঝলমলে তার জীবন- আসে বোম্বে জীবনের প্রতিবেশী কবি সরোজিনী নাইডুর কথা, নাইডু মহাত্মা গান্ধীকে মাঝে মাঝেই মিকি মাউস বলতেন মজা করে, (গান্ধীও দাঁতহীন মুখে বিশ্বের উজ্জলতম হাসি দিয়ে বন্ধুর সম্বোধনকে সাদরে বরণ করতেন)।
নাইডু ছাড়াও স্মৃতিচারণ আছে বিখ্যাত প্রাণী বিজ্ঞানী ডিলন রিপ্লে, হিউ হুইসলার, মেইনারহাগেনসহ অনেকের। এবং সালিম আলীর গুরু বার্লিন বিশ্ব-বিদ্যালয়ের প্রফেসর আরউইন স্ট্রেসমান, যার সার্বিক তত্ত্বাবধানেই সালিম আলী সত্যিকারের পক্ষীবিজ্ঞানী হয়ে ওঠা শুরু করেন। বার্লিনের জীবনকেই পরবর্তীতে ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্ট বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।
আর আছে ভ্রমণের গল্প, শুনেছিলাম অশীতিপর অবস্থাতেও চিরতরুণ মনের অধিকারী মানুষটি হিমালয়ের নানা দুর্গম স্থানে বিলুপ্ত গোলাপি মাথা হাঁসের খোঁজে অভিযান চালাতেন। তার উল্লেখ না পেলেও মোটরসাইকেল করে তার ভারত থেকে সুইডেন গমন, হিমালয়ের নানা কোণে কোণে অগুনতি অভিযান, আফগানিস্তানে পাখির খোঁজে, ফ্ল্যামিঙ্গোর সন্ধানে রান এলাকায়, ভরতপুর, ভাওয়ালপুর, লাদাখ ইত্যাদি স্থানের বর্ণনায় প্রকৃতি সম্ভোগে অক্লান্ত মানুষটির ভ্রমণপিপাসু সত্ত্বার পরিচয় বেরিয়ে আসে।
১৯৩৭ আফগানিস্তানের পাখির নমুনা সংগ্রহ ও পর্যবেক্ষণের জন্য ভ্রমণের সময় সালিম আলী লিখছেন-
“আফগানরা যেরকম কট্টর গোড়া মুসলমান আর সেটা এমনই এক অরাজক দুর্বৃত্তের দেশ যে, সেখান থেকে জানমাল নিয়ে ফেরা সম্ভবই নয় ইত্যাদি ইত্যাদি- এমনটাই বলেছিল সবাই। প্রকৃত ঘটনা হল, আমাদের গোটা সফরে একজনও জিজ্ঞেস করেনি আমাদের কার কী ধর্ম। আমরা দেখলাম আফগান দেশের মানুষজনেরা অসম্ভব দিলদরাজ আর অতিথিবৎসল। আমরা পাখি সংগ্রহের কাজে গিয়ে দেখেছি, আমাদের দেখে প্রায়ই মাঠের কাজ ফেলে গ্রামের মানুষেরা ছুটে এসে বলেছে ‘তোমরা আমাদের খাতিরের মেহমান। আমাদের বাড়িতে এসে একটু চা খেয়ে যাও।’ যেখানেই আমরা তাঁবু ফেলেছি, রাস্তার ধারে ট্রাকের ওপর খোলা পড়ে থেকেছে আমাদের যার যা মালপত্র, খাবার-দাবার,এমনকি গুলিগোলা পর্যন্ত। কখনো একটা কোন জিনিসও খোয়া যায়নি। কখনও কোনো লোক আমাদের কোনোভাবে একটুও জ্বালাতন করেনি। একমাত্র মাছি ছাড়া।”
সালিম আলীই ভারতবর্ষের প্রথমদিকের একজন নেতৃত্বস্থানীয় প্রকৃতিসংরক্ষণবীদ, যথেচ্ছ শিকারের বিরোধিতা করেছেন সবসময়ই, সারগুজার মহারাজার কথা উল্লেখ করে বলেছেন যখন রাজাকে প্রশ্ন করেছিলেন জীবনে কতগুলো বাঘ মেরেছেন? উত্তরে বেশ দুঃখ নিয়ে মহারাজা বলেছিল মাত্র ১১৪০টি! আরও বাঘ কেন হত্যা করতে পারেননি সেটা নিয়ে তাকে যথেষ্ট দুঃখিত দেখাচ্ছিল। বলেছেন সেই মহারাজারই এক জ্ঞাতি ভাইয়ের কথা যার গুলিতে উপমহাদেশের শেষ বুনো চিতাটি ইতিহাস হয়ে মুছে যায় প্রকৃতি থেকে।
কারাবদ্ধ থাকা অবস্থায় তরুণী ইন্দিরা গান্ধীকে সালিম আলীর পাখির বই কতটা অভিভূত ও উৎসুক করে তুলেছিল পাখিদের জগত নিয়ে এবং পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় ইন্দিরা গান্ধীর নিসর্গ রক্ষায় প্রবল সমর্থন ও কার্যক্রমের পিছনে সালিম আলীর ভূমিকা নিয়ে সামান্য আলোচনা আছে।
সালিম আলী চেষ্টা করেছেন স্বাধীন ভারতের যত বেশি সম্ভব প্রকৃতি সংরক্ষণ করতে। সেই সাথে নানা সময়ে প্রাপ্ত পুরস্কারের অর্থ থেকে চেষ্টা করছেন বুনো পশুপাখির জন্য অভয়ারণ্য তৈরি করে রক্ষা করার।
১৯৮৭ সালের ২০ জুন ৯১ বছর বয়সে না ফেরার দেশে উড়ে যান সালিম আলী। তার নামে নামকরণ করা হয়েছে রক বুশ কোয়েল (Rock Bush Quail, বৈ.নাম- Perdicula argoondah salimalii), ফিন’স ওয়েভার (Finn’s Weaver, বৈ.নাম- Ploceus megarhynchus salimalii) এই ২ পাখির। এবং বিশ্বের বিরলতম বাদুড়দের একটির, নাম ল্যাটিডেনস সালিমালি (Latidens salimalii)। সেই সাথে তার স্ত্রী তাহমিনার নামে নাম রাখা হয়েছে একটি কাঠঠোকরার ব্ল্যাল-রাম্পড ফ্লেইমব্যাক উডপেকার নাম (Black-rumped Flameback Woodpecker, বৈ.নাম- Dinopium benghalense tehminae)।
জম্মু কাশ্মীরে ওনার নামে ন্যাশনাল পার্কের নামকরণও করা হয়েছে, আছে উনার নামে হ্রদসহ অনেক কিছুই। মৃত্যুর বছর দুই আগে ১৯৮৫ সালে তার চিত্তাকর্ষক আত্মজীবনীটি প্রকাশিত হয়। আর অপূর্ব বাংলা অনুবাদটি ২০০২ সালে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট থেকে প্রকাশিত হয়।
বইয়ের শেষ অধ্যায়ে নিজের হিমালয়প্রেম বর্ণনা করেছেন প্রিয় পাখিবুড়ো এভাবেই-
From my boyhood days, and long before I had ever set eyes upon them, I had a romantic craving for the Himalaya and often day-dreamed that in later life, if I ever got the option of choosing a place to settle in, it would most certainly be somewhere among the foothills of the Himalaya where I would have at my doorstep, as it were, all the things that mattered most to me- beautiful forests, magnificent scenery, good birding, trekking in the mountains and plenty of opportunities for game shooting and naturalizing. What could be more idyllic?
নিচের বাংলাদেশ সফরের অংশটি বিশিষ্ট প্রাণী বিজ্ঞানী ডঃ রেজা খান লিখিত’ পাখি বিশারদ সালিম আলী” বই অবলম্বনে লেখাটি তৈরি করা হয়েছে।
পাখি বিশারদ সালিম আলীর বাংলাদেশ সফর প্রসঙ্গে প্রাণিবিজ্ঞানী ডক্টর রেজা খান লিখেছেন, দিনক্ষণ ঠিক হলো ডক্টর সালিম আলী বাংলাদেশে আসবেন। ঘটনাটি ১৯৮০ সালের ডিসেম্বরের। এটাও ঠিক হলো যে ঢাকায় থাকাকালীন রমনা পার্ক, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও মিরপুর বোটানিক্যাল গার্ডেনে পাখি দেখবেন ।
তাকে রাখার ব্যবস্থা হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির একটা মেহমান কক্ষে। আর তার সফর সঙ্গী হোসেন ভাই থাকবেন আমাদের শহীদুল্লাহ হলের যে বাসা সেখানে। খাবারের বন্দোবস্ত হলো আমার বাসাতেই। কারণ তার খাবারের মেনু আমার জানা ছিল। ডক্টর সালিম আলী ঢাকা আসবেন শুনে শুনে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, আমার সাবেক স্যার ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিদ্যার সাবেকঅধ্যাপক এ কে এম আমিনুল হক আমাকে বিশেষভাবে অনুরোধ করলেন, যাতে তাঁকে এক দিনের জন্য হলেও মোমেনশাহীতে নিয়ে যাই।
এদিকে বন বিভাগ রাজি হলো শ্রীমঙ্গলের হাইলা হাওর ও লাউয়াছড়ায় পাখি দেখতে যাওয়ার ব্যাপারে। স্থানীয় আতিথেয়তার দায়িত্বও তাদের। আমার মাথায় বাজ ভেঙে পড়ার মতো হলো। কারণ, স্যারকে বিমানে ঢাকা থেকে সিলেট নেওয়ার টাকা জোগান দেবে কে!
ছাত্রদলপন্থী বন্য প্রাণীর ছাত্ররা এগিয়ে এল, যার মধ্যে ঢাকাইয়া ছেলে মোহাম্মদ আলাউদ্দিন ছিল প্রধান। তারা তৎকালীন বিমানমন্ত্রী ওবায়েদুর রহমানের কাছ থেকে তিনটা ফ্রি টিকিট নিয়ে এল।বিপদ দেখা দিল যেদিন আমরা সিলেট যাব, সেই নির্দিষ্ট দিন সকালের ফ্লাইটে সিট খালি ছিল না। আর বিকেলের ফ্লাইটে গেলে ওই দিনই আমাদের পক্ষে শ্রীমঙ্গল গিয়ে পাখি দেখা সম্ভব হবে না। এসময় সাহায্যের হাত বাড়ালেন সেই নীলগিরির কুনুরের ডিএসসিতে ১৯৭৪-৭৬ সালে ট্রেনিং গ্রহণ করার সময় যে তিন-চারজন সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, তাঁদেরই একজন। তিনি তখনসেনাবাহিনীতে একজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। তিনি সরকারি কোটা থেকে আমার নামে তিনটি সিট রিলিজ করে দিলেন।
যথাসময়ে ১৯৮০ সালের ডিসেম্বর মাসে ড. সালিম আলী ঢাকা এলেন তাঁর সফরসঙ্গী বিএনএইচএসের গবেষক-বিজ্ঞানী এস এ হোসেনকে নিয়ে। প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ছাত্রছাত্রী, বিশেষ করে বন্য প্রাণীশাখার ছাত্রছাত্রীরা মহা ফুর্তিতে তাঁকে বিমানবন্দরে স্বাগতম জানাল এবং টিএসসি পর্যন্ত পৌছে দিল। তাদের সঙ্গে আরও ছিলেন অধ্যাপক জাকের হোসেন, অধ্যাপক আমীন এবং বন্য প্রাণী বিভাগেরবাকি সব শিক্ষক ও আমার পরিবারের সদস্যরা।
পরদিন ভোরবেলা আমরা পাখি দেখতে বের হলাম রমনা পার্কে ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। স্যার টিএসসি থেকে সোজা গেলেন আশপাশের উদ্যানে। সেখান থেকে তাঁকে নিয়ে যাই রমনায়। তখন পার্কেদেশি পাখির সঙ্গে শীতের পাখিরও বেশ আনাগোনা ছিল। স্যার খুব খুশি হলেন শহরের ভেতরে পার্ক দুটির অবস্থান এবং সেখানকার পাখিদের দেখে।
আমার নিজস্ব কোনো যানবাহন ছিল না। তখন আমি স্বপ্নেও দেখতাম না কোনো গাড়ির, আজও আমার যা নেই। কারণ, আড়াই যুগ ধরে সরকারি গাড়িই চালাচ্ছি। তবে এখন পরিবারের সবার ব্যক্তিগত গাড়ি হয়ে গেছে এ জন্য যে তারা বিদেশে থাকে এবং সেখানে তারা তাদের নিজ নিজ রোজগার দিয়েই তা কিনেছে। সালিম স্যারকে নিয়ে আমার সঙিন অবস্থা দেখে আমাকে উদ্ধারে এগিয়ে এল আমার সদ্য বিবাহিত শ্যালিকা মিসেস নুরুল আক্তার অরোরা এবং তার স্বামী মোহাম্মদ আবুল কালাম। তাদের বিয়ের আয়োজন করা হয়েছিল ১৯৮০ সালের মার্চে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের বাসা থেকেই। মূলত তাদের সেলুন কারে ড. সালিম আলীকে নিয়ে কেবল রমনা-মিরপুর যাইনি, সাহস করে ঢাকা-টাঙ্গাইল-মধুপরের ভাঙা রাস্তা দিয়ে মধুপুরে গিয়ে হাজির হলাম। সেখানে কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের চমৎকার বিশ্রাম ভবনে থাকার ও রাতে খাওয়ার বন্দোবস্ত হলো ছাত্র মোখলেসুর রহমানের এক নিকটাত্মীয়ের সৌজন্যে। তিনি পরদিন আমাদের মধুপুর বনে পাখি দেখা, তারপর সেখান থেকে মোমেনশাহী কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে দেওয়ার জন্য একটি গাড়িও দিয়েছিলেন।
মধুপুর পৌছার দ্বিতীয় দিন ভোরে অধ্যাপক জাকের হোসেনের নেতৃত্বে কোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্য প্রাণীর শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীরা বাসে চেপে হাজির মধুপুরে। সেখানে পাখি দেখার জন্য বেশ সময় পাওয়া গেল। ড. সালিম আলী খুবই খুশি হলেন ছাত্রছাত্রীদের উদ্দ্যোগ ও উদ্দীপনা দেখে। তারও অভিভূত হলেন ধ্বংসপ্রায় শালবনে তখন দিনান্তে প্রায় ৭০ প্রজাতির কবি দেখা গেল বলে। গাছে ঝুলছিল লালচে হনুমান। মানুষ দেখে গাছ থেকে লাফিয়ে ঝপাঝপ মাটিতে পড়ল বানরের দল।
রাতে থাকার বন্দোবস্ত হলো কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিআইপি মেহমানখানায়। অধ্যাপক আমীনুল হক খুবই উদার আতিথেয়তার ব্যবস্থা করেছিলেন। পরদিন সকালে ক্যাম্পাসে পাখি দেখতে বের হলাম মেজবান ও মেহমানদের সঙ্গে নিয়ে। বুলবুলি, ফিঙে, কাক, শালিক, আবাবিল, কাঠঠোকরা, মৌটুসি, ফুলঝুরি, তৌফিক, শ্বেতাক্ষি, কানকুয়া বা কানাকোকা ও বক প্রচুর দেখা গেল। শেষ সকালে ড. সালিম আলী ভাষণ দিলেন। তিনি জোর দিয়েছিলেন অর্থনৈতিক পক্ষীবিদ্যার ওপর। তাঁর দেখানো ৮ মিমি মুভিতে বর্ণনা করা হয় কী করে পাখিরা পরগাছার পরাগায়ন করে এবং এর বীজ বিস্তার করে। মূলত পাখি ছাড়া এই প্রাকৃতিক কাজগুলো হবেই না বলা চলে।
সেদিন দুপুরের ট্রেনে চেপে স্যারকে নিয়ে বিকেলে ঢাকা ফিরলাম। বিভাগীয় সহযোগী শিক্ষক ড. সোহরাব ভাই রাজি হয়েছিলেন তাঁর গাড়িতে করে ড. সালিম আলীকে টিএসসিতে পৌছে দেবেন বলে। পরদিন সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয়ের বাসভবনে নাশতার দাওয়াতে উপস্থিত ছিলেন উপাচার্য ফজলুল হালিম চৌধুরী, তাঁর পরিবার, ড. সালিম আলী, হোসেন ভাই, অধ্যাপক জাকের হোসেন, অধ্যাপক আমীন, অধ্যাপক এস এম এইচ কবীর ও উপাচার্যের সেক্রেটারি সেলিম।
এরপর খাবারের দাওয়াত ছিল কবি, গবেষক ও লেখক অধ্যাপক মনসুর উদ্দিনের শান্তিনগরের বাসভবনে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন বন বিভাগীয় সাবেক আমলা, যাঁর মধ্যে জ্যেষ্ঠ ছিলেন ওয়াই এস আহমদ ও বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দিন ও অধ্যাপক কাজী জাকের হোসেন। ড. সালিম আলী দারুণ মজলিসি লোক। প্রায় সব পরিবেশে খাপ খাওয়ানোতে তাঁর জুড়ি নেই। খুবই আনন্দঘন পরিবেশে ওখানকার পুরো সময়টা কাটে।
হাইলা হাওরে যাওয়ার ভোরে আমরা সিলেট বিমানবন্দরে নামলাম। বন বিভাগের কর্মকর্তা সুন্দর সরকারি জিপ নিয়ে উপস্থিত ছিলেন। তিনি গাড়ি হাঁকিয়ে আমাদের সোজা নিয়ে পেলেন লাউয়াছড়া বনে। সেখানে সামান্য সময় পাখি দেখার পর ছুটলাম হাইলা হাওরের দিকে। ছোট ছোট তিনটা নৌকায় ডিএফও মহোদয় ও আমরা তিনজন উঠেছিলাম। ঘণ্টা দুয়েক পাখি দেখা হলো। চোখে পড়ল প্রচুর রাজহাঁস, লেনজা, পান্তামুখী, লালশির, নীলশির, বড় ও ছোট সরালি, বালিহাঁস, হাজার হাজার জলাভূমির পাখি বা ওয়েডারস, যার মধ্যে ছিল চা-পাখি, জিরিয়া, গুলিন্দা ও কাঁদাখোঁচা। অসংখ্য ছিল খঞ্জনি ও আবাবিল, পানকৌড়ি ও বক। ড. সালিম আলী হাইলা হাওরকে তুলনা করলেন রাজস্থানের ভারতপুর জেলার ভারতপুর পাখি অভয়ারণ্যের সঙ্গে।
বিল থেকে ফিরে শ্রীমঙ্গল শহরে এলাম। ডিএফও সাহেবের জিপ এক জায়গায় থামল। সিতেশ বাবু নামে একজনের বাড়ি থেকে বস্তাবন্দী একগাদা জলার পাখি ও হাঁস ঢুকিয়ে দেওয়া হলো জিপের পেছনে, যেখানে আমি ও হোসেন ভাই বসে ছিলাম।
হোসেন আঁতকে উঠে বললেন, রেজা, এরা করছে কী! ‘ওন্ডম্যান’ (সমিতির সবার কাছে এটা ছিল সালিম আলীর পেট নেম) দেখলে লঙ্কাকাণ্ড হয়ে যাবে। ওদের বলো, অন্তত পাখিগুলো হালাল করে দিক, মানে জবাই করে দিলে পাখিরা কোনো শব্দ করবে না।
এর ফলে ড. সালিম আলীও টের পাবেন না কীভাবে বাংলাদেশের বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন প্রয়োগের দায়িত্বে নিযুক্ত বন বিভাগের অফিসারই আইন ভঙ্গ করছেন। আমি উপস্থিত লোকজনকে সেটা করতে বললাম। তারপর তারা সেটাই করল।
এবার আমাদের সঙ্গে জবাই করা বস্তাবন্দী হয়ে চলল হাওরে আসা পরিযায়ী পাখি। ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, বন বিভাগ বুঝতেও পারল না তারা একজন বিশ্ববিখ্যাত পাখিবিশারদকে তাদের অজান্তেই কী ভীষণভাবে অপমান করল।
কপাল ভালো ড. সালিম আলী কানে কম শুনতেন এবং হেয়ারিং এইড ব্যবহার করতেন কেবল কথাবার্তা বলার সময়। অন্য সময় ওটা পকেটেই রাখতেন। আর হোসেন ভাই কখনো ঘটনাটা সালিম আলীকে জানাননি আমার সম্মান নষ্ট হবে, এ কথা ভেবে। সেদিন অবশ্যই আমি ভীষণ মনঃকষ্ট নিয়ে ঢাকায় ফিরলাম।
বন্ধুবর আলী ইমাম, বাংলাদেশ টিভির খুবই পরিচিত প্রযোজক সে ড. সালিম আলীর একটা ইন্টারভিউ নেওয়ার কথা বললে আমি অধ্যাপক আমীনকে উপস্থাপক হিসেবে নেওয়ার প্রস্তাব দিলাম। কারণ, আমি তখন ‘এসো বিজ্ঞানের রাজ্য’ নামে ২২ মিনিটের একটা সাপ্তাহিক অনুষ্ঠান (১৯৭৭- এর ডিসেম্বর থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত) উপস্থাপনা করতাম।
এশিয়াটিক সোসাইটির অনুষ্ঠানে ড. সালিম আলীর প্রাক্তন ছাত্র এবং সোসাইটির বিজ্ঞান সম্পাদক হওয়ায় এর কাউন্সিল স্বর্ণপদক প্রদান অনুষ্ঠানে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমাকেই দিল। সোসাইটির পুরো অডিটরিয়াম কানায় কানায় ভরা ছিল। যেমন ছিল টিএসসির পুরো হলঘর, যখন তিনি তাঁর বাংলাদেশ সফরের সমাপনী ভাষণ দেন এবং তাঁর বানানো পাখির ওপর খুবই চমৎকার একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি প্রদর্শন করেন।
ড. সালিম আলীর সংক্ষিপ্ত সফরের মাঝখান দিয়ে তাঁর মনে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে পাখি দেখতে না পারার যে দুঃখ ছিল, তার কিছুটা লাঘব হলো। তাঁর পাকিস্তানে যাওয়ার বাসনা বাংলাদেশে আসার আগেই পূর্ণ হয়। কারণ, বছরখানেক আগে পাকিস্তানের পেশোয়ারে অবস্থিত ফরেস্ট কলেজ পাখির ওপর এক বিশেষ সেমিনার করে। সেখানে ড. সালিম আলীকে বিশেষ অতিথি হিসেবে সরকারিভাবে দাওয়াত করে নিয়ে যায় ওখানকার বন বিভাগ। বাংলাদেশ সফরের পাট চোকানোর আগ মুহূর্তে আমরা শহীদুল্লাহ হলের বাসায় যখন একান্ত আলাপচারিতায় ব্যস্ত, তখন তিনি আমার ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ড কী রকম হতে পারে, বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও সুন্দরবনের পাখির ওপর ব্যাপক গবেষণা প্রয়োজন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
ব্যক্তিগত পর্যায়ে তিনি যখন জানতে চান, আমি কেমন আছি, তখন জানালাম চাকরি, মাঠের গবেষণাকাজ ও পরিবার পোষণের জন্য অতিরিক্ত লেখালেখি সব সময় খেয়ে ফেলে। গবেষণার জন্য যে কোয়ালিটি টাইম দেওয়া দরকার, তা দিতে পারছিলাম না। এরপর মনে হয় না শিক্ষকতা করে কখনো বাড়ি-গাড়ি করা সম্ভব হবে।
সালিম আলী হেসে বললেন, বুঝেছি, তুমি পেট্রো ডলার খুঁজছ! এ পর্যন্তই ব্যক্তিগত আলাপ।
এরপর ১৯৮২ সালে হঠাৎ সালিম আলী চিঠি লিখলেন, তোমার পেট্রো ডলারের ডাক এসেছে। যেকোনো সময় সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) থেকে চিঠি পেতে পারো। হলোও তাই। একদিন দৈবাৎ বিভাগীয় চেয়ারম্যান ডেকে পাঠালেন। যাওয়ার পর বললেন, উপাচার্য মহোদয় (ফজলুল হালিম চৌধুরী) তোমাকে ডেকেছেন। হন্তদন্ত হয়ে নীলক্ষেত অফিসে পৌঁছালে তিনি বললেন, ইউএইর চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স তোমাকে দেখা করতে বলেছেন। তাঁর নামধাম, ঠিকানা ও ফোন নম্বর দিলেন। পরদিন আমিরাতের সিডিএ (চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স) জনাব খামিস মোহাম্মদ সোহেইলের সঙ্গে টেলিফোনে সাক্ষাৎকারের সময় নির্ধারণ করে দেখা করতে গেলাম গুলশানে। মহাখালী থেকে গুলশানে ঢোকার যে পুল ছিল, তার ডান দিকের একটি বাসায় ছিল এমবাসি।
সালিম মঈজুদ্দীন আব্দুল আলি (জন্ম: নভেম্বর ১২, ১৮৯৬ – মৃত্যু: জুন ২০, ১৯৮৭) একজন বিখ্যাত ভারতীয় পক্ষীবিদ এবং প্রকৃতিপ্রেমী। তিনিই প্রথম কয়েকজন ভারতীয়দের মধ্যে একজন যাঁরাভারতের পাখিদের সম্বন্ধে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে জরিপ পরিচালনা করেন। তার পাখিবিষয়ক বইগুলি পক্ষীবিজ্ঞানের উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন।
তথ্য সুত্র: ডঃ রেজা খান লিখিত’ পাখি বিশারদ সালিম আলী
সলিম আলি: দ্য বার্ডম্যান অব ইন্ডিয়া, Mohammad Saiful Islam
ফিচার ছবি: artstation.com
anandabazar
তারেক অণুর নিবন্ধ পাখিবুড়ো সালিম আলীর কথা
Leave a Reply