সারাক্ষণের চিরায়ত সাহিত্য বিভাগে এবারে থাকছে মানিক বন্দোপধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য।
দিবারাত্রির কাব্যে’র ভূমিকায় মানিক বন্দোপধ্যায় নিজেই যা লিখেছিলেন …..
দিবারাত্রির কাব্য আমার একুশ বছর বয়সের রচনা। শুধু প্রেমকে ভিত্তি করে বই লেখার সাহস ওই বয়সেই থাকে। কয়েক বছর তাকে তোলা ছিল। অনেক পরিবর্তন করে গত বছর বঙ্গশ্রীতে প্রকাশ করি।
দিবারাত্রির কাব্য পড়তে বসে যদি কখনো মনে হয় বইখানা খাপছাড়া, অস্বাভাবিক,- তখন মনে রাখতে হবে এটি গল্পও নয় উপন্যাসও নয়, রূপক কাহিনী। রূপকের এ একটা নূতন রূপ। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের Projection-মানুষের এক এক টুকরো মানসিক অংশ।
দিবা রাত্রির কাব্য
মানিক বন্দোপাধ্যায়
হাতটা চোখের সামনে ধরে সে কাটা আঙুলের গোড়া দুটি পরীক্ষা করে নিল। বলল, ‘একজন ছোরা মেরে উড়িয়ে দিয়েছে।’
‘ছোরা, অশোক?’
‘উহু, দেশী দা-ভয়ানক ধার। আটকাতে গিয়ে আঙুল দুটো উড়ে গেছে। উড়ে যাওয়া উচিত ছিল মাথাটার, কেন যে গেল না ভাবলে মাথাটা আজও গরম হয়ে ওঠে।’
সুপ্রিয়া বলল, ‘মাথা গরম করে আর কাজ নেই। দোষ তো তোমার। খানাভরা সেপাই জমাদার, তবু নিজে ডাকাতের সামনে গলা এগিয়ে দেবে, বিবেচনা তো নেই।’
অশোক নির্মমভাবে হাসল। বলল, ‘বিবেচনা করেই গলা বাড়িয়ে ছিলাম, কর্তব্যের খাতিরে। তুমি যা ভেবেছিলে তা একেবারেই সত্য নয়।’
‘আমি কিছুই ভাবিনি।’
‘ভাবোনি? তবে যে ডাকাত ধরতে গেলেই বলতে জেনে-শুনে প্রাণটা দিতে যাচ্ছি নিজের, খুন হতে যাচ্ছি সাধ করে? অমনি করে অমঙ্গল ডেকে আনতে বলেই তো আঙুল দুটো আমার গেল।’
সুপ্রিয়া বিবর্ণ মুখে বলল, ‘কি সব বলছ তুমি? চুপ কর।’
হেরম্ব এতক্ষণ ভেতরে ভেতরে রেগে আগুন হয়ে উঠেছে। মানুষকে ব্যঙ্গ করার যে ধারালো ক্ষমতা সে প্রায় পরিত্যাগ করেছিল, এবার তাই সে কাজে লাগাল।
‘আহা বলুক না, সুপ্রিয়া, বলুক। অতিথিকে অশোক এন্টারটেন করছে বুঝতে পারিস না! গৃহস্বামীর এই তো প্রথম কর্তব্য। ওর কথা শুনো না, অশোক, তোমার যা বলতে ইচ্ছা হয় এমনি রস দিয়ে বলো। তোমার কর্তব্য তুমি করবে বই কি!’
অশোকের স্তিমিত চোখ জ্বলজ্জ্বল্ করে উঠল। স্বামীর লাঞ্ছনায় সুপ্রিয়ার মুখও ব্যথায় ম্লান হয়ে গেছে। হেরম্ব স্পষ্ট দেখল অসুস্থ কিন্তু হেরম্বের মধ্যে গলা নামিয়ে সে যে নিষ্ঠুরতা মরে যাচ্ছিল আজ তা মরণ-কামড় দিতে চায়। যোগ দিল, ‘তুমি গৃহস্বামী যে!’ অশোক দেয়ালের দিকে মুখ করে বলল, ‘না। -না।’
হেরম্ব শান্তভাবে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি না, অশোক?’
‘গৃহস্বামী অসুস্থ। তার কর্তব্য নেই।’
হেরম্ব বলল, ‘তাহলে তোমায় বিরক্ত করা উচিত হবে না। আমরা অন্য ঘরে যাই।’
হেরম্ব ঘর থেকে বেরিয়ে এল। সুপ্রিয়া তাকে অন্য একটি ঘরে যে ঘরের মেঝেতে শুধু মাদুর পাতা ছিল, নিয়ে গিয়ে বলল, ‘বসুন। ওকে একটু শান্ত করে আসি।’
‘পারবি না সুপ্রিয়া, ও একটা আস্ত বাঁদর।’
‘গালাগালি কেন?’ বলে সুপ্রিয়া চলে গেল।
Leave a Reply