শ্রী নিখিলনাথ রায়
জগৎশেঠ
গৌরব কিরীটভূষিতা অমিতৈশ্বর্য্যশালিনী সৌভাগ্য-লক্ষ্মীর আশী- মালা যাহাদের মস্তকে নিপতিত হয়, সমগ্র জগতীতলে তাঁহারাই বর- নীয় হইয়া থাকেন। তখন সন্তঃপ্রকাশিত অরুণালোকের নিকট অমা– রজনীর গাঢ় তমোরাশির অপসরণের ন্যায়, তাঁহাদের গৌরবপ্রভায় দুর্ভাগ্যের ঘনীভূত অন্ধকার দূরদূরান্তরে বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়ে।
ক্রমে সেই আলোকপ্রবাহ তরঙ্গায়িত হইতে হইতে দিগদিগন্তে চলিয়া যায়, এবং যাহাকে সম্মুখে পায়, তাহাকেই আলোকময় করিয়া তুলে। ঐন্দ্র- জালিকের মত তাঁহাদের করস্পর্শে ধূলিমুষ্টি স্বর্ণমুষ্টিতে’ পরিণত হয়,- সামান্য উপলখণ্ড মহামূল্য হীরকের আকার ধারণ করে। তাঁহাদের প্রতিপদবিক্ষপে মরুভূমিতে অযুত কুসুম ফুটিয়া উঠে, মহাশ্মশানে চন্দ- নের গন্ধ অনুভূত হয়।
জগতের সমস্ত পদার্থ তাঁহাদের নিকট মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় অবস্থিতি করে। কি জড়জগৎ কি জীবজগৎ, উভয়ই তাঁহাদের আজ্ঞাবহ হইয়া উঠে। তাঁহাদের অঙ্গুলিসঙ্কেতে নীলাকাশের বিরাট- বক্ষোবাসিনী সৌদামিনী রাজপথে সমস্ত রজনী প্রহরীর কার্য্যে নিযুক্ত থাকে এবং সলিলগর্ভে লুক্কায়িত বাষ্পলহরী সহস্র সহস্র মত্তমাতঙ্গের বল ধারণ করিয়া শকটবহন কার্য্যে নিযুক্ত হয়।
আবার সামান্য পশু পক্ষী হইতে জগতের প্রত্যেক মনুষ্য, প্রত্যেক জাতি তাঁহাদের নিকট কৃতাঞ্জলিপুটে দণ্ডায়মান থাকে। সহস্র সহস্র রাজরাজেশ্বরের মণিমাণিক্য- খচিত মুকুটমালা তাঁহাদের পদতলে বিলুন্ঠিত হয় এবং তাঁহাদের ইঙ্গিতমাত্রে কত কত নবাববাদসাহের সিংহাসন পর্যন্ত টলিয়া যায়। যাঁহারা সৌভাগ্যলক্ষ্মীর প্রকৃত বরপুত্র, তাঁহাদের মোহিনী শক্তিতে জগতে এমন কোন কার্যাই নাই যাহা সম্পাদিত হইতে না পারে। ঐন্দ্রজালিকের মায়ায় পদার্থের বাস্তব পরিণতি ঘটে না। কিন্তু ভাগ্য- লক্ষ্মীর বরপুত্রের শক্তিতে প্রতিনিয়ত সেই পরিণতি সংঘটিত হয়।
পৃথিবীর যে যে জাতি ও যে যে ব্যক্তি ভাগ্যলক্ষ্মীর অনুগ্রহভাজন হই- রাছেন, তাঁহাদের গৌরবপ্রভায় বসুন্ধরা চিরপ্রভাময়ী থাকিবেন এবং অনন্তকাল ধরিয়া তাঁহাদের যশোগাথা দিগন্তহৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হইবে।
ভাগ্যদেবীর অনুগ্রহের পাত্রবিচার নাই; তিনি যাহাকে ইচ্ছা তাহা- কেই জয়মাল্য পরাইয়া থাকেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর বাঙ্গলার ধনকুবের শেঠবংশীয়গণ প্রথমে দরিদ্র্যের কঠোর-চক্রে নিষ্পেষিত হইয়া, আপনা- দিগের নিবাসস্থান পরিত্যাগপূর্ব্বক বাঙ্গলারাজ্যে উপস্থিত হইলে, তাঁহা- দের উপর সৌভাগ্য-লক্ষ্মীর করুণা-দৃষ্টি নিপতিত হয়।
Leave a Reply