প্রতিম বসু
ভারতের ২০২৪ সালের নির্বাচনের ফলাফল কী হতে পারে সে নিয়ে বিশেষ সংশয়ের অবকাশ নেই। সাঙ্ঘাতিক কোন অঘটন না ঘটলে নরেন্দ্র মোদী আরো বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরবেন। আর তার সঙ্গেই পারদ বাড়বে চিন-ভারত দ্বৈরথের।
কারনটা খুব স্বাভাবিক। আধুনিক পৃথিবীতে চিনের অবদান হল, তৃতীয় বিশ্বকে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতির মাধ্যমে ক্ষমতায়নের স্বপ্ন দেখানো। চিনে গনতন্ত্র নেই। তাই বড় গনতান্ত্রিক দেশের পক্ষে এ মডেল কতটা প্রযোজ্য সে নিয়ে সন্দেহ ছিল।
গত ১০ বছরে ভারত সেই ধারনাটা ভেঙ্গেছে। জিডিপির বিচারে, ২০১৪ সালে দশম স্থান থেকে ভারত এখন পঞ্চম। আগামী দু বছরের ভেতর আমেরিকা ও চিনের পরে তৃতীয় বড় অর্থনীতি হবে ভারত।
ঠিক উল্টো দিকে, ১৯৭৮ থেকে ২০০৮ তিরিশ বছর প্রায় ১০ শতাংশ হারে বাড়ার পর, চিনের বৃদ্ধির গতি স্লথ, অর্থনীতি ২০০৮ সালের আমেরিকান সাবপ্রাইমের থেকে বড় ‘ক্রেডিট ক্রাইসিস’-এর মুখোমুখি।
শুধু ঋণ সংকট না। কোভিড পরবর্তী বিশ্ব-রাজনীতি, চিন থেকে আমদানীর ওপর মার্কিনি বিধিনিষেধ, বিনিয়োগের স্থানান্তকরন ইত্যাদি মিলিয়ে বেইজিং খুব সুখে নেই। অ্যাপল কোম্পানি, রপ্তানির লক্ষ্য নিয়ে চিনে বড় কারখানা খুলেছিল, এখন সে ভারতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। অর্থাৎ চিনের রপ্তানির ওপর চাপ বাড়ছে।
এর মধ্যে ভারতের দ্রুত ক্ষমতায়ন চিনের পক্ষে সুবিধেজনক না। সুতরাং ভূ-রাজনীতির সাধারন সুত্র মেনে, বেইজিং চাইবে দিল্লিকে লক্ষ্য থেকে সরাতে। ঠিক সেকারনেই গালোয়ান ভ্যালিতে সংঘর্ষ হয় কিংবা ভারতের অরুণাচল প্রদেশকে চিনের সম্পত্তি বলে দাবি করা হয়।
ঘটনা এখানেই শেষ না। ভারতের পশ্চিম ও উত্তরপুর্ব সীমান্তে ড্রাগের চালানে হটাৎ বৃদ্ধির পেছনেও বড় শক্তি আছে। তফাতের মধ্যে গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত জনপ্রিয় সরকার সেটাকে কড়া হাতে মোকাবিলা শুরু করেছে।
গত ১০ বছরে সমস্ত সীমান্ত অঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি; নতুন বিমান, সাবমেরিন, মিসাইল নিয়ে সেনাবাহিনীর সাজো সাজো রব; কাশ্মির থেকে ৩৭০ ধারা ওঠানো; লাদাখকে কাশ্মীরের থেকে আলাদা করা ইত্যাদি সব কিছুই এক সুতোয় বাঁধা।
কাশ্মিরে এবছরেই বিধানসভা নির্বাচন হবে। লাদাখ কিন্তু কেন্দ্রশাসিত। অর্থাৎ যে কোন পদক্ষেপ নিতে গেলে রাজ্যের অনুমতি বা সহযোগিতা কিছুই লাগবে না। কাশ্মীর পাকিস্তান সীমান্তে। লাদাখ চিন সীমান্তে।
অতীতে কাশ্মিরের ভেতর দিয়ে লাদাখ যেতে হত। এখন সরাসরি যোগাযোগ ব্যবস্থা। সীমান্তে বিমানঘাঁটি, মিসাইল আর হাজারে হাজারে সৈন্য মোতায়েন।
একই ঘটনা ঘটছে উত্তরপূর্ব ভারতে। সেলা পাস দিয়ে সারা বছর মিলিটারি ট্যাঙ্ক গড়গড়িয়ে তাওয়াং চলে যাবে। আগে ছ-মাস বরফে রাস্তা বন্ধ থাকত। মেচুকাতে বড় বড় মিলিটারি কার্গো আর ফাইটার প্লেন নামার বিমানঘাঁটি।
পূর্ব-অরুণাচলের টুটিং-এ যেতে হলে আগে তিনদিন হাঁটতে হত। সেখানে এক কোম্পানি সৈন্য থাকত। ১৯৭০-এর দশকে পিপলস লিবারেশন আর্মি সাতজন ভারতীয় সৈন্যকে মেরে ফেলে।
এখন আসামের ডিব্রুগড় থেকে টুটিং ৫০০ কিমি রাস্তা একদিনের ভেতর হাইওয়ে দিয়ে যাওয়া যায়। পথে তেজুতে নাগরিক ব্যবহারের জন্যে বিমানবন্দর, টুটিং-এ মিলিটারি বিমানবন্দর।
উত্তরপূর্ব ভারত থেকে থেকে বাকি ভারতে যোগাযোগের রাস্তা পশ্চিমবঙ্গের ভেতর দিয়ে ৬০ কিমি লম্বা আর ১৭-২২ কিমি চওড়া ‘শিলিগুড়ি করিডোর’ যাকে ঘিরে বাংলাদেশ, নেপাল আর ভুটান। আকাশপথে হাত বাড়ালেই চিন।
এই শিলিগুড়ি দিয়েই আবার দার্জিলিং হয়ে তিব্বত সীমান্তে সিকিম। দলাই লামা এদিক দিয়েই ভারতে এসেছিলেন। সব মিলিয়ে চিন ভারত দ্বৈরথে এই অঞ্চলের গুরুত্ব অসীম। এইটুকু জায়গায় দু-দুটো বিমানঘাঁটি – বাগডোগরা আর হাসিমারা। সেখানে রাফাল প্লেনও আছে।
ভারত যা জানে, সেটা চিনও জানে। তাই বেইজিং এখানেই বাংলাদেশের তিস্তা প্রকল্প করতে চায়, আর ভারত আপত্তি তোলে, নেপাল চিনের সঙ্গে দহরম-মহরম করলে দিল্লি ভ্রু-বাঁকায় আর ভুটানকে নিজের কোলে রাখে। যে কোন বড় শক্তিই এ কাজ করত।
কিন্তু একটা ছোট খোঁচা থেকে গেছে। শিলিগুড়ি পশ্চিমবঙ্গে। আর পশ্চিমবঙ্গে মমতা ব্যানার্জি সরকারের সঙ্গে দেশের সরকারের সম্পর্ক সুমধুর নয়। সন্দেশখালি কিংবা ভুপতিনগরে কেন্দ্রীয় সংস্থার ওপর হামলা আর তাকে ঘিরে রাজনীতি একরকমের নিদর্শন।
সম্পর্কের সমস্যাটা আজকের নয়। কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং থেকে বিজেপির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দুজনেই মমতা ব্যানার্জির আপত্তিতে বাংলাদেশকে তিস্তার জল দিতে পারেন নি।
শোনা যায়, সে কারনেই শিলিগুড়ি করিডোর অঞ্চলকে কেন্দ্রশাসিত করার একটা প্রস্তাব কিছুদিন ধরে ঘোরাফেরা করছে। সেটা হলে, পশ্চিমবঙ্গের মাথা না হলেও টিকি কাটা যাবে। অবশ্য এসব হবে কিনা কেউ জানে না। মোদীর শাসনে তো আরো বেশি জানে না।
কেউ কি জানত যে কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা উঠবে?
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
Leave a Reply