স্বদেশ রায়
পৃথিবীর বৃহত্তম সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের লোকসভা নির্বাচন ১৯ এপ্রিল থেকে শুরু হবে। যে সময়ে এ লেখা লিখছি, এখন থেকে আর মাত্র সাতদিন বাকি নির্বাচন শুরু হতে। এবং দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে সাতটি পর্বে আগামী ১ জুন নির্বাচন শেষ হবে।
এ মুহূতে ভারতরে রাজধানী দিল্লি বা তার আশে পাশের বেশ কয়েকটি প্রদেশ ও রাজধানীতে বসবাসকারী সাধারণ মানুষ, সাবেক কূটনীতিক, অধ্যাপক, ব্যবসায়ী, ও বিভিন্ন দলের রাজনীতিবিদদের সঙ্গে কথা বলে মনে হচ্ছে, ভারতের রাষ্ট্র ক্ষমতা কে আসছে তা নিয়ে বেশিভাগ মানুষই অনেকটা নিশ্চিত।
তারপরে বিভিন্ন দেশের নির্বাচন পর্যবেক্ষন ও নির্বাচনী রিপোর্ট করার অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় কখনই নির্বাচনের আগে চূড়ান্ত কোন কথা বলা সঠিক না।
কারণ নির্বাচনের আগে যে কোন একটি দৈব দুর্বিপাক বা কোন মহলের বা কোন গোষ্টির কোন সিদ্ধান্ত যেকোন নির্বাচনের রায়কে ভিন্ন পথে নিয়ে যেতে পারে।
যেমন বারাক ওবামা’র দ্বিতীয় র্টামের নির্বাচনে শুরুতে ওয়েভ তার পক্ষে বেশি ছিলো এমনটি কেউ বলবেন না। বরং রিপাবলিকান প্রার্থীও তার সঙ্গে সঙ্গে সমানতালে চলছিলেন। নিউ ইর্য়কের ঘুর্নিঝড়ের পরে তার কাজের নিষ্টা পরিস্থিতি বদলে দেয়। একইভাবে ট্রাম্প ও হিলারির নির্বাচনের সময় মিডিয়া এক ধরনের ওয়েভ সৃষ্টি করেছিলো হিলারির প্রতি। অন্যদিকে সোশাল ফোরাম ও ব্যবসায়ী গোষ্টির একটি শ্রেনীর সিদ্ধান্ত ট্রাম্পকে চূড়ায় উঠিয়ে দেয়।
এমনকি আমাদের বাংলাদেশে’র ১৯৯১ ও ২০০১ এর নির্বাচনে যদি প্রশাসন ভিন্ন সিদ্ধান্ত না নিতো তা হলে ফল ভিন্ন হলেও হতে পারতো।
এছাড়া যে নির্বাচন দুই মাসের বেশি সময় ধরে সাতটি পর্যায়ে শেষ হবে। তাই যে কোন পর্যায়ের আগে যে কোন ধরনের পরিস্থিতিও হতে পারে, এমন একটি নির্বাচন নিয়ে আগাম কোন চূড়ান্ত কেন, নিশ্চিতের কাছাকাছি মন্তব্য করা সঠিক বিবেচনার কাজ নয়।
তাছাড়া যে দেশে নির্বাচনে মোটামুটি স্বাধীনভাবে ভোট দেবার সুযোগ আছে- সে দেশের নির্বাচনে ভোটের সাতদিন আগে কেন, ভোটের আগের দিনও চূড়ান্ত কোন রায় দেয়া যায় না।
তবে এ মুহূর্তে ভারতের নির্বাচন ঘিরে যা দেখা যাচ্ছে, তার মধ্য অন্যতম, এ দেশের সব থেকে বড় প্রদেশ এবং যে প্রদেশটির নির্বাচনী ফল অধিকাংশ সময় ভারতের কেন্দ্রে সরকার গঠন করার মূখ্য ভূমিকা পালন করে, সেই উত্তর প্রদেশে এখনও পর্যন্ত যে নির্বাচনী হাওয়া তাতে ক্ষমতাসীন বিজেপিই বেশি সংখ্যক আসন পাবে।
বিজেপি’র রাজনীতি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে মুসলিম বিরোধী বলে চিহ্নিত হলেও এই উত্তর প্রদেশের রাজনীতিতে এবার ভোটে একটা বিষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে- যা পিছিয়ে পড়া মুসলিম ভোটারদের ভোট। যারা ভারতে পশ্চমন্দ মুসলিম হিসেবে চিহ্নিত- কৃষি কাজে বা বিভিন্ন ছোট ছোট পেশায় নিয়োজিত এই শ্রেনীর মুসলিমদের ভেতর এ রাজ্যে বিজেপি ভালো ভোট পাবে বলে অনেকেই ধারণা করছে। ওই শ্রেনী সে বিষয়ে মুখ খুলছে। সে প্রদেশের নির্বাচনের আগে যদি বড় ধরনের কোন অঘটন না ঘটে তাহলে ভোটের ক্ষেত্রে এটা ঘটবে বলেই আভাস পাওয়া যাচ্ছে। তার অর্থ, বিজেপি সেখানে পিছিয়ে পড়া মুসলিমদের ভোটের একটি অংশ পেতে পারে।
উত্তর প্রদেশের পরেই দিল্লির ক্ষমতার দ্বিতীয় ভূমিকা পালনকারী দেশ মধ্যপ্রদেশ। সেখানে উত্তর প্রদেশের পরেই বেশি আসন সংখ্যা। সেখানকার সাধারণ মানুষ ও দিল্লি’র বিশেষজ্ঞদের মত হলো, মধ্য প্রদেশে বিজেপি যে সব থেকে বেশি আসন পাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তবে তার পরেও এ জন্য নির্বাচনের দিন পর্যন্ত বর্তমান হাওয়া বজায় রাখা ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে অনেক বড় কাজ।
অন্যদিকে বিজেপির মূল নেতা এবং এ মুহূর্তে ভারতের সব থেকে জনপ্রিয় নেতা যিনি নিজেই ২০% এর বেশি ভোট নিজ দলের পক্ষে টানার ক্ষমতা রাখেন, ভারতের এই নেতা ও প্রধানমন্ত্রী মি. নরেন্দ্র মোদির নিজস্ব রাজ্য গুজরাট। এখানে যে বিজেপির বিজয় ছাড়া অন্যকিছু ঘটবে না এ নিয়ে সকলেই নিশ্চিত।
গুজরাটের পরে আসে মহারাষ্ট্র। মহারাষ্ট্রে শিবসেনা একটি ফ্যাক্টর। এক সময়ে বিজেপির সঙ্গে তাদের সখ্য থাকলেও এখন সেটা নেই। তারা মাঝখানে কংগ্রেসের সমর্থনে সরকার গঠন করে বিজেপি থেকে সরে এসেছিলো। তবে এ মুহূর্তে শিবসেনার ভেতর ও তাদের নেতৃত্বে’র ভেতর যেমন কোন্দল রয়েছে তেমনি মহারাষ্ট্রের মানুষের মনেও একটা দোলাচল রয়েছে। তারা রাজ্যের উন্নতি ও স্থিতিশীলতার জন্যে লোকসভায় বিজেপির দিকে ঝুকে পড়তে পারে এমন বক্তব্য অনেক অধ্যাপক ও সাবেক কূটনীতিকের। তবে যে কোন নির্বাচনে ধারণা আর বাস্তবতা সব সময় একই খাদে বয় না- এটাও মনে রাখা দরকার।
দিল্লিস্থ হিন্দি বেল্টের কয়েক সাংবাদিকের মতে রাজস্থানেও এ মুহূর্তে যে ভাবে নির্বাচন এগুচ্ছে তাতে কয়েকটি সিট বাদে অধিকাংশ আসনেই বিজেপি’র জেতার সম্ভাবনাই স্পষ্ট।
উত্তর ভারতের পরে দক্ষিণ ভারতের বাইরে বেশি সংখ্যক আসন চারটি রাজ্যে। উড়িষ্যা, বিহার, পশ্চিমবঙ্গও অসমে।
উড়িষ্যায় নবীন পটনায়েকের আঞ্চলিক দল রাজ্যে ক্ষমতায় থাকলেও বিজপির সঙ্গে তার সম্পর্ক খুবই ভালো। তাছাড়া কিছুদিন আগে উড়িষ্যার বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে দেখেছি তারা যেমন রাজ্যে নবীন পটনায়েকের সরকার চায় তেমনি কেন্দ্রীয় সরকারের ভোট সেখানকার বেশিভাগ মানুষ বিজেপিকে দেবার পক্ষে। তারা সেখানে যেভাবে বিজেপি’র তরুণ নেতাদের মধ্যে অন্যতম নেতা হিমন্ত বিশ্ব শর্মা’র আগমনকে গুরুত্ব দিয়ে গোটা শহর তার ছবিতে ঢেকে ফেলেছিলো – তা মূলত ওই রাজ্যর সরকার ও কেন্ত্রীয় সরকারের মিলনের একটি বড় চিহ্ন বলে মনে হয়েছিলো। ওই রাজ্যের সাধারণ মানুষও তার আগমন ও তাকে নিয়ে গর্বিতও ছিলো। তাই ওড়িষা হয়তো বিজেপির বাইরে যাবে না। দিল্লি’র বেশ কয়েকজন থিঙ্কট্যাঙ্কের মতামতও তেমনটি। তারা মনে করেন ওড়িশাতে বিজেপি ভালো করবে তাতে কোন সন্দেহ নেই।
বিহারের নীতিশ মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে ইন্ডিয়া জোট ছেড়ে বিজেপি’র সঙ্গে সম্পর্ক গড়েছেন। বিহারের মানুষ নীতিশকে নতুন বিহারের রূপকার মনে করেন। তাই সেখানে বিজেপির সঙ্গে নীতিশের হাওয়া মিলে বিজেপির জন্য ভালো ফলই আসার কথা।
বিহারের পরেই আসে পশ্চিমবঙ্গ। পশ্চিমবঙ্গের সন্দেশখালি ঘটনা মমতার মুখে অনেক চুনকালি লাগিয়েছে। তারপরেও তার দল না হোক মমতা নিজে সেখানে জনপ্রিয়। বিজেপির পশ্চিমবঙ্গের নেতা মমতার সমান জনপ্রিয় নন। এবং ওই অর্থে মমতার মত বড় নেতাও নন। বাস্তবে ভালোয় মন্দয় এ মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের মাস পিপলের নেতা মমতা ব্যানার্জী। তাই বিজেপির পশ্চিমবঙ্গের নেতাকে নির্বাচন করতে হবে মোদির জনপ্রিয়তা ও ইমেজের ওপর ভর করে। পশ্চিমবঙ্গে মমতার জন্যে অন্যতম একটা প্লাস পয়েন্ট নারী ভোট। এই ভোটের ওপর তার একটি শক্ত অবস্থান। তবে বর্তমানের সন্দেশখালি ঘটনা এই নারী ভোটকে কিছুটা হলেও নাড়িয়ে দিয়েছে। এর কিছুদিন আগে সেখানকার বাসন্তী এলাকাতেও একই ঘটনা ঘটেছিলো। এবং সেই নারীর শ্লীলতাহানি নিয়ে মমতা ব্যানার্জীর বক্তব্যও শুধু দুঃখজনক ছিলোনা, শালীনতার বাইরেও চলে গিয়েছিলো। তাছাড়া সম্প্রতি তার দলের এক নারী নেত্রী সাক্ষাত্কার দিয়েছেন, সেখানে তিনি বলেছেন, তাকে রাত বারোটার পর তার দলের নেতারা ফোন করে তাদের আস্তানায় যেতে বলেন। এ সবের একটা প্রভাব নারী ভোটের ওপর পড়া স্বাভাবিক।
অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে যারা সচেতন, বিশেষ করে ভারতের নিরাপত্তা নিয়ে তারা ভবিষ্যতের চায়না’র বিপরীতে ভারতের সিকিউরিটি নিয়ে কিছুটা উদ্বিগ্ন। তারা এক্ষেত্রে মমতাকে নিরাপদ মনে করেন না। এছাড়া মমতা ব্যানার্জ্জী ইন্ডিয়া জোটের একজন নেত্রী হলেও, তিনি তার রাজ্যে একা লড়ছেন। সেখানে কংগ্রেস ও বামফন্ট্র আলাদা লড়ছে।
পশ্চিমবঙ্গে ভোটের ক্ষেত্রে অনেকে মনে করেন মুসলিম ধর্মাবল্বীদের ভোট একটি ফ্যাক্টর। তাদের সংখ্যা ৩০% এর ওপরে। ষাটের দশক অবধি এই মুসলিম ধর্মালম্বীদের ভোটের বড় অংশ কংগ্রেসের রিজার্ভ ভোট ছিলো।
তারপরে বামপন্থীরা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার সময় ধীরে ধীরে এই ভোটের বড় অংশ বামফ্রন্টদের রিজার্ভ ভোট হয়ে যায়। বাস্তবে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে যেখানে এখনও আইন ও প্রশাসনের চোখ মেশিনের মতো হয়ে উঠতে পারেনি- সেখানে সব দেশেই সংখ্যালঘুরা নিজস্ব স্বার্থে সব সময়ই ক্ষমতাসীনদের দিকে ঝুঁকে যায়। মমতা দশ বছরের বেশি সময় ক্ষমতায় থাকার ফলে বামফ্রন্ট থেকে এই সংখ্যালঘু ভোট তার দিকে গড়িয়েছে ঠিকই , তবে কেন্দ্রে বিজেপি’র টানা ক্ষমতায় থাকা ও পশ্চমন্দ মুসলিমদের পক্ষে বিজেপির অবস্থান নেয়া ও তিন তালাক উঠিয়ে দেয়া সব মিলে পশ্চিমবঙ্গে’র মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের ভোটে একটা নাড়া পড়েছে বলে সেখানে অনেকেই মনে করেন।
তবে তারপরেও পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির নির্বাচনী মনোনয়ন, নির্বাচন পরিচালনা ও সর্বোপরি বামফ্রন্ট আমল থেকে ভোট দেয়া ঠেকানো নিয়ে যে গুন্ডামির রাজত্ব শুরু হয়েছে- তার ধারাবাহিকতায় সেখানে ভোটে মানুষের ইচ্ছে’র প্রতিফলন কতটা ঘটার সুযোগ পাবে তাও নিয়েও প্রশ্ন আসে।
কিছু কিছু থিঙ্ক ট্যাঙ্ক মনে করেন, এবার গতবারের থেকে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ভালো করবে। তাদের আসন সংখ্যা বাড়বে। অবশ্য কিছুদিন আগে হয়ে যাওয়া পঞ্চায়েত ভোটে তার কোন নির্দশন মেলেনি। তাই অনেকে মনে করেন, বিজেপির আসন পশ্চিমবঙ্গে আগের স্থানে থাকতে পারে। তবে উভয় পক্ষ একমত, মানুষ ভোট দেবার সুযোগ পেলে বিজেপির পাল্লা ভারী হবার সম্ভাবনা বেশি।
অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গে শিল্প নেই। সেখান থেকে শিল্প জম্বু ও কাশ্মীরেও চলে যাচ্ছে। মানুষের চাকুরি নেই। রাজধানী কোলকাতা একটি ডেড সিটি। তারপরেও বিজেপির বড় ঘাড়তি রয়ে গেছে সংগঠনে এবং মনোনয়নে এমনটি অনেকে মনে করেন। তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গে পুরানো বিজেপি কর্মীরা মনে করেন তারা বঞ্চিত। এই সব মিলে কেউ কেউ মনে করছেন পশ্চিমবঙ্গে লোকসভার ৪২টি সিটের মধ্যে মমতার দল বেশি পেলেও বিজেপি ১৮ ছাড়িয়ে বিশ বাইশে যেতে পারে। অন্যদিকে আবার অনেকে মনে করছেন, তারা ১৮’র কাছাকাছি থাকতে পারে। আবার কেউ কেউ মনে করছে পশ্চিমবঙ্গে মিরাকল হতে পারে; বিজেপির নমিনেশান যাই হোক না মানুষ নরেন্দ্র মোদিকে ভোট দিতে পারে। তবে তাদেরও শেষ কথা, মানুষ যদি ভোট দেবার সুযোগ পায়। কারণ বেঙ্গলে সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার নেই বললেই চলে। তাদের ভোট দেবার কাজটি সরকার দলীয় কর্মীরাই করে।
অসমে হিমন্ত বিশ্ব শর্মা অনেক ডায়ানেমিক লিডার। তিনি নানান এথনিক গ্রুপের একটি প্রদেশে মানুষের মূল মনোযোগ ডেভেলপমেন্টের দিকে নিয়ে এসেছেন। আর সে ডেভেলপমেন্ট শুধু অবকাঠামো নয়, মানব সম্পদ তৈরি থেকে নিরাপত্তা অবধি। তাই অসমে কংগ্রেস কিছু সিট পেলেও বিজেপি জোটই বেশি সিট পাবে বলে সেখানকার সাংবদিক ও সাধারণ মানুষ মনে করছে। মাত্র কিছুদিন আগে আসাম ঘুরে দেখেছি, আসামের মানুষের একটি নতুন উপলব্দি তারা, আর অতীতে ফিরতে চায় না। তারা আধুনিক ভারতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আগামীর পথে যেতে চায়। তাদের বিমানবন্দর গুলো এখন ভরা থাকে দিল্লি, চেন্নাই ও হায়দারাবাদের যাওয়া বা ফেরার যাত্রীতে। এরা দিল্লিতে যেমন নানান কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছে তেমনি তারা হায়দারাবাদ ও চেন্নাইতেও আইটি ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের কাজের সঙ্গে যুক্ত।
উত্তরপূর্ব ভারতে অসম ছাড়া অন্য ছয়টি প্রদেশের লোকসভা আসন খুবই কম। তার ভেতর মনিপুরে বিজেপি খারাপ করবে বলে সকলে মনে করছে। মেঘালয়ে কংগ্রেস জোট জিতবে অনেকের ধারণা। মিজোরামে ও নাগাল্যান্ডে বিজেপি বেরিয়ে আসার সম্ভাবনাকে সকলেই গুরুত্ব দিচ্ছে। তাছাড়া বর্তমান মিয়ানমারের পরিস্থিতি এই এলাকার একটি বড় সমস্যা। এছাড়া উত্তর পূর্ব ভারতের ত্রিপুরাতে অবশ্য যেমন আছে তার কোন ব্যতিক্রম হবে বলে কেউ মনে করছেন না। বিজেপিই সেখানে লোকসভায় জিতবে।
এর বাইরে দিল্লির সাতটি আসন, পাঞ্জাব ও হরিয়ানা ভারতের রাজধানী ও রাজধানীর কাছের নির্বাচন।
দিল্লিতে রাজ্য সরকারে ক্ষমতায় থাকা কেজরিওয়ালকে নির্বাচনের আগে গ্রেফতার করা নিয়ে দ্বিমত রয়েছে দিল্লি শহরে। অনেকে মনে করছেন, এ কারণে যেখানে দলটির লোকসভায় পাঞ্জাব থেকে একটি মাত্র আসন সেটা দিল্লি থেকে বেড়ে চার বা পাঁচটি হতে পারে।
অন্যদের অবশ্য তা নিয়ে ভিন্ন মত আছে। তাদের মতে কেজরিওয়ালকে গ্রেফতার করার পরে গাছের পাতাও নড়েনি। দিল্লি থেকে পাঞ্জাব অবধি কোন প্রতিবাদ হয়নি। তাই মুলত কেজরিওয়ালকে গ্রেফতার করায় আম আদমি পার্টি নেতৃত্ব শূন্য হয়ে গেছে। এবং এতে তাদের দিল্লিতে যেমন আসন নেই- তেমনিই ঘটবে এবার। বরং ভোটের হার কমতে পারে। তাদের বক্তব্য হলো কেজরিওয়াল যে খালিস্তানিদের টাকার বিষয়ে একটা রহস্য শুধু নয় তার যথেষ্ট প্রমানও আছে। তাই দেশদ্রোহিতার একটা বিষয় এখানে এসে যেতে পারে।
তবে দিল্লি’র অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও থিঙ্ক ট্যাংকের মতে দিল্লি ও পাঞ্জাবের মাঝখানের ছোট রাজ্য হরিয়ানা অনেক গুরুত্বপূর্ণ । দিল্লির ক্ষমতায় যেই থাকুক না কেন, হরিয়ানা তার পক্ষে থাকলে সীমান্ত রাজ্য পাঞ্জাব নিয়ন্ত্রন করা তার পক্ষে সম্ভব হয়। অনেকের মতে হরিয়ানা এখনও স্পষ্ট নয়, কোন দিকে ঝুঁকবে।
এর বাইরে নির্বাচনে বড় ফ্যাক্টর দক্ষিন ভারত। ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি এখনও দক্ষিন ভারতে ওইভাবে শেকড় গাড়তে পারেনি যেমনটি তারা গেড়েছে হিন্দি বলয়ের বাইরে উত্তরপূর্ব ভারতে। তবে তারপরেও কর্ণাটকে বিজেপি কয়েকটি সিট পেতে পারে বলে অনেকে মনে করছে। কারণ, কর্ণাটকের এক শ্রেনীর হিন্দু ভোটের বাইরে খৃষ্টান ভোট বিজেপির কাছে আসতে পারে। অনেক মুসলিম ভোটও বিজেপির দিকে যেতে পারে। তবে সেখানে শেষ অবধি সংখ্যাগরিষ্টতা কংগ্রেস জোটই পাবে বলে তাদের ধারনা। ঠিক একই অবস্থা তেলেঙ্গনা, অন্ধ্র ও তার শহর হায়দারাবাদে। দক্ষিন ভারতে সবখানে বিজেপি তাদের পা রাখছে তবে নির্বাচনে বড় কিছু আশা করার মতো এখনও কিছু ঘটেনি। অবশ্য কেউ কেউ মনে করছেন তামিল নাড়ুতে বিজেপি এবার পা আরো শক্ত করতে পারে।
বিজেপির এই অগ্রযাত্রার পথে বাদবাকি দলগুলোগুলো যে হারিয়ে যাবে তা নয়। তবে এ মুহূর্তের পৃথিবীতে ভারতের রাজনীততে অন্যতম একটি ফ্যাক্টর হয়েছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি শুধু এ মুহূর্তে ভারতে সব থেকে জনপ্রিয় নন, দেশের ব্যবসায়ী ও অনেক সচেতন গ্রুপ মনে করেন, আগামী আমেরিকার নির্বাচনের পরে সে দেশের রাজনীতি ও চায়নার রাজনীতি যে পথে হাটুক না কেন, ভারতে শক্তিশালী নেতা দরকার। এবং তার জন্যে জনসমর্থন ও সঠিক নির্বাচনের মাধ্যমে জিতে আসা দরকার। কারণ, কখনও কখনও হয়তো ভারতকে তার নিজস্ব স্বার্থে ও অস্তিত্বে একাই লড়তে হতে পারে। সেজন্য সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ভারত ভবিষ্যতে গড়ে তোলা প্রয়োজন। আর তার জন্যে সততার সঙ্গে চলা একজন শক্তিশালী নেতা ভারতে দরকার।
এ কারণে ব্যবসায়ী মহল থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত এ মুহূর্তে নরেদ্র মোদিকে তাদের বেস্ট চয়েস মনে করছেন। কারণ, কংগ্রেস কাশ্মীরের আর্টিকেল ৩৭০ পুনস্থাপন তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে এনেছে। কংগ্রেস হয়তো মনে করছে এ উদার নীতি। অন্যদিকে বর্তমানের কঠোর ও অথরিটিয়ানদের আগ্রাসানপূর্ণ পৃথিবীতে কাশ্মীরে ৩৭০ পুনস্থাপন পৃথিবীর দ্বিতীয় শক্তি চায়নার বিপরীতে ভারতের জন্যে কতটা ভালো হবে সেটাও হয়তো নতুন জেনারেশান ও শিক্ষিত ভোটাররা চিন্তা করবেন। কারণ, প্রশ্নটি যতটা কাশ্মীরের ঠাকুরও মুসলিম নিয়ে তার থেকে বেশি চায়নার বিপরীতে ভারতের নিরাপত্তা নিয়ে।
আবার মুসলিম বিরোধী বলে অনেকখানি চিহ্নিত মি. মোদি ভারতের মুসলিম নারীদের বৈবাহিক জীবনের অনিশ্চয়তা কাটানোর জন্যে তিন তালাক বাতিল করেছেন। অনেকে মনে করছেন, মুসলিম নারীদের অনেকে এবার এ কারণে বিজেপিকে ভোট দেবে। কংগ্রেস আবার তিন তালাক ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে। নারী ক্ষমতায়ন ও প্রগতিশীলতার কথা বলা কংগ্রেসের এটা কি পেছনের দিকে হাঁটা নয়?
কংগ্রেস হয়তো বলতে পারে সুপার সনিক জেটের যুগে রাম মন্দির কি সামনে হাঁটা? তারপরেও নির্বাচন এলে ভোটের জন্যে,ক্ষমতায় যাবার জন্য তৃতীয় বিশ্বের অনেক প্রগ্রেসিভ দল অনেক পশ্চাদপদ সিদ্ধান্ত নেয়। তা তাদের ভোটে বা নির্বাচনে কাজ করে। কংগ্রেসের এই তিন তালাকের পক্ষে যাওয়া, বিজেপির রাম মন্দির তেমনও হতে পারে।
বাস্তবে প্রাকটিক্যাল ভোটের রাজনীতি এবং রাষ্ট্র বিজ্ঞানের রাজনীতি তৃতীয় বিশ্বে এক নয়। তারপরে ২০২৪ এর এই পৃথিবী জোড়া নির্বাচন ও বড় বড় কয়েকটি আগ্রাসন ও সেই সঙ্গে যুদ্ধ উম্মাদনার মধ্যে ভারতের এই নির্বাচন শুধু নির্বাচনে জেতা নয়- আগামী দিনের বিশ্ব রাজনীতি ও যে কোন পরিস্থিতিতে ভারতকে শক্তভাবে দাঁড়ানোর জন্যে গুরুত্বপুর্ন। গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্যেও।
লেখক; সর্বোচ্চ জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World ।
Leave a Reply