শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৫:২৫ পূর্বাহ্ন

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৪০ তম কিস্তি )

  • Update Time : বুধবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৪, ১২.০০ পিএম
রবীন্দ্রনাথ পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যে আরেকটি নতুন যুগ সৃষ্টি হয়েছিলো। ভাষাকে মানুষের মুখের ভাষার কাছে নিয়ে আসা নয়, সাহিত্যে’র বিষয়ও হয়েছিলো অনেক বিস্তৃত। সাহিত্যে উঠে এসেছিলো পরিবর্তিত মন ও সমাজের নানান প্রাঙ্গন। সময়ের পথ ধরে সে যুগটি এখন নিকট অতীত। আর সে সাহিত্যও চিরায়ত সাহিত্য। দূর অতীত ও নিকট অতীতের সকল চিরায়ত সাহিত্য মানুষকে সব সময়ই পরিপূর্ণ মানুষ হতে সাহায্য করে। চিরায়ত সাহিত্যকে জানা ছাড়া বাস্তবে মানুষ তার নিজেকে সম্পূর্ণ জানতে পারে না।

সারাক্ষণের চিরায়ত সাহিত্য বিভাগে এবারে থাকছে মানিক বন্দোপধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য।

দিবারাত্রির কাব্যে’র ভূমিকায় মানিক বন্দোপধ্যায় নিজেই যা লিখেছিলেন …..

দিবারাত্রির কাব্য আমার একুশ বছর বয়সের রচনা। শুধু প্রেমকে ভিত্তি করে বই লেখার সাহস ওই বয়সেই থাকে। কয়েক বছর তাকে তোলা ছিল। অনেক পরিবর্তন করে গত বছর বঙ্গশ্রীতে প্রকাশ করি।

দিবারাত্রির কাব্য পড়তে বসে যদি কখনো মনে হয় বইখানা খাপছাড়া, অস্বাভাবিক,- তখন মনে রাখতে হবে এটি গল্পও নয় উপন্যাসও নয়, রূপক কাহিনী। রূপকের এ একটা নূতন রূপ। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের Projection-মানুষের এক এক টুকরো মানসিক অংশ।

 

দিবা রাত্রির কাব্য

মানিক বন্দোপাধ্যায়

 

 

হেরম্ব অশোকের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করল। বলল, ‘বেশ তো।’

‘আর বিকেলে যদি পারেন ওকে একবার মন্দির স্বর্গদ্বার-টার যা দেখার আছে দেখিয়ে আনবেন। আমার নিজের তো ক্ষমতা নেই নিয়ে যাবো।’

‘আচ্ছা।’

অশোক চুপি চুপি বলল, ‘আমার কি ভীষণ সেবাটাই যে ও করছে, দাদা বললে আপনার বিশ্বাস হবে না। নাওয়া নেই, খাওয়া নেই, ঘুম নেই, নিজের চোখে যে না দেখেছে- এখনো যথেষ্ট করছে। ও মনে করে আমি বুঝি কিছুই চেয়ে দেখি না, আমার কৃতজ্ঞতা নেই। কিন্তু আপনাকে বলে রাখছি, ওর সেবা আমি কখনো ভুলবো না।’

হেরম্ব বলল, ‘তুমি ভুল করছ অশোক, ও কৃতজ্ঞতা চায় না।’ ‘জানি, জানি। ওর মন কত উঁচু আমি জানি না!’

স্বপ্রিয়া বালিশ নিয়ে ফিরে আসায় এ প্রসঙ্গ থেমে গেল। অশোককে এ ঘরে দেখে সুপ্রিয়া সন্দিগ্ধভাবে দু’জনের মুখের দিকে চেয়ে দেখতে লাগল। বালিশটা মাদুরে ফেলে দিয়ে বলল, ‘হেরম্ববাবু এখন ঘুমোবেন। চল আমরা যাই।’

অশোক উঠল। ‘আমি ওঁকে এ বেলা খাবার নেমন্তন্ন করেছি, সুপ্রিয়া।’ ‘বেশ করেছ। নিজে রাঁধগে, আমি পারব না।’

বলে সুপ্তিরা হাসল। সুপ্রিয়াকে এত ঠাণ্ডা হেরম্ব আর কখনো দেখেনি।

বজ্রপাতের শব্দে ঘুম ভেঙে হেরম্ব দেখতে পায় তার ঘুমের অবসরে আকাশে মেঘের সঞ্চার হয়ে বাইরে দারুণ দুর্যোগ ঘনিয়ে এসেছে। বাতাস বইছে সাঁ সাঁ শব্দে, উত্তাল সমুদ্রের গর্জন বেড়ে গেছে। উঠে ঘরের বাইরে যেতে গিয়ে হেরম্ব অবাক হয়ে যায়। দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। ডাকাডাকি শুনে সুপ্রিয়া এসে দরজা খুলে দেয়। ভারী তালা খোলার শব্দ হেরম্ব শুনতে পায়।

দরজা খুললে তালাটিকে সে খুঁজে পায় না। সন্দিগ্ধ হয়ে বলে, দেখি তোর হাত? ওটা নয়, আঁচলের নিচে যেটা লুকিয়েছিস।’

‘কেন?’

‘দেখা কি লুকিয়েছিস, তালা বুঝি? দরজায় তালা দেওয়ার মানে?’

স্বপ্রিয়া হেসে বলে, ‘মানে আর কি, পালিয়ে না যেতে পারেন তাই। যে পালাই-পালাই স্বভাব।’

হেরম্ব বলে, ‘আমার ঘুমের মধ্যে অশোক বুঝি ছোরা হাতে এদিকে আসছিল?’

স্বপ্রিয়া গলা নামিয়ে বলে, ‘আস্তে কথা কইতে পারেন না।-তা আসেনি। আসতে পারত।’

হেরম্ব হেসে বলে, ‘ও, তোর শুধু সন্দেহ। তুই সত্যি দারোগার বৌ, স্বপ্রিয়া। সে গেছে কোথায়?’

‘ছাতে।’

‘এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে ছাতে?’

‘সমুদ্র দেখতে গেছে। বললে, ঝড় উঠলে সমুদ্র কেমন দেখায় দেখবার এ সুযোগ ছাড়া উচিত নয়। আমাকে জোর করে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। একটু ধস্তাধস্তি করে পালিয়ে এসেছি।’

‘ধস্তাধস্তি কেন?’

‘কারণ ছিল বই কি। আমায় ধাক্কা দিয়ে ছাদ থেকে ফেলে দেবার চেষ্টা করেছিল। যত সব বিদঘুটে খেয়াল!’

হেরম্ব ফিরে গিয়ে মাদুরে বসল। ঘরের জানালা দুটি বায়ুর গতির দিকে খোলে, বন্ধ করার দরকার হয়নি। বাইরে এমন দুর্যোগ নামলে আনন্দ তার ঘরে সমুদ্রের ঝিনুক নিয়ে খেলা করে, তার যখন খুশী তাকায়, যখন খুশী কথা বলে। তাদের নিজেদের প্রেমের সমস্তা ছাড়া সে ঘরে দুর্ভাবনার প্রবেশ নিষেধ। কারো জীবনের প্রভাব সেখানে নেই, সুপ্রিয়ারও নয়-তাকে সে ভুলে যায়। কিন্তু সুপ্রিয়ার কাছে থাকলে একটি বেলার জন্যও তার রেহাই নেই। আবহাওয়া অবিলম্বে বৈদ্যুতিক হয়ে ওঠে। দুর্ঘটনা ঘটে, দুঃসংবাদ পাওয়া যায়। তাদের মাঝখানে আর একটি জীবনের নাটকীয় অভিনয় ঘটে চলে। বাড়ির ছাদের ভয়ঙ্কর ঘটনাটুকুর সংবাদ সুপ্রিয়া তাকে কেন দিয়েছে বুঝে হেরম্বের বড় কষ্ট হয়। সুপ্রিয়াও কি মালতী হয়ে উঠল?

‘কি হয়েছিল?’ হেরম্ব জিজ্ঞাসা করল।

‘শুনে অবিচার করবেন না। আমাকে ছাদে ডেকে নিয়ে যাবার সময় ওর কোন মতলব ছিল না, শুধু ছেলেমানুষী খেয়াল। আমাকে ধারে দাঁড়াতে দেখে লোভ সামলাতে পারেনি।

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৩৯ তম কিস্তি )

দিবারাত্রির কাব্য: মানিক বন্দোপধ্যায় ( ৩৯ তম কিস্তি )

 

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024