সাজ্জাদ কাদির
আমি নিজেকে ইতিহাস,রাজনীতি ও অর্থনীতির ছাত্র বলতে সবচেয়ে বেশি স্বাচছন্দ্য বোধ করি।সাবজেক্ট বলি আর বিষয় বলি এগুলো পাঠ্য হিসেবে জীবনভরই পাঠ করেছি সেই স্কুল জীবন থেকে শুরু করে কলেজ,বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এবং এখনও সময় সুযোগ পেলেই পাঠ করি।আমার সদ্য পাঠ করা গ্রন্থ হেদায়েতুল্লাহ আল মামুনের লেখা ‘উপনিবেশবাদ ও বাঙালির সংস্কৃতি’ গ্রন্থটি।
এত সহজ,সরল ও সাবলিল ভাষায় ইতিহাসের যে নির্মোহ বয়ান করা যায় এই গ্রন্থটি তার একটি প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ হয়ে থাকবে।অনেকের কাছে ইতিহাস পাঠ খানিকটা একঘেয়ে কিংবা দুর্বোধ্য লাগে।কিন্তু এই গ্রন্থটি তেমনটা লাগবে না বরং পাঠ শুরু করতে ধরলে শেষ না করে পারবেন না।
গ্রন্থের লেখক হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন এনডিসি মূলত: ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র।পরে তিনি অবশ্য মাস্টার্স ইন পাবলিক এফেয়ার্স বা এমপিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। মূলত: সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে ইতিহাস সুখপাঠ্য করে লিখে খানিকটা বিস্মিত করেছেন।আবার কর্মজীবনে হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।তিনি বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব।তিনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব এবং বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।এমন একজন মানুষ লেখার ক্ষেত্রে এ ধরণের বিষয়ই নির্বাচন করলেন কিভাবে?
দীর্ঘদিন ধরে, বিশেষ করে তিনি যখন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন তখন থেকে তাকে জানার সুযোগ হয়েছে এবং সেই জানা থেকে আমার কাছে মনে হয়েছে তিনি আর দশজন আমলা থেকে জ্ঞান চর্চা,রুচিবোধ,মানবিক বোধের জায়গায় অনেক অগ্রসর ও খানিকটা ভিন্ন প্রকৃতির।তিনি একজন সংস্কৃতিজন এবং উপমহাদেশের ইতিহাস,সভ্যতা,সংস্কৃতি ও রাজনীতির একজন নিমগ্ন পাঠক।তাকে পাঠক বল্লে মোটেই ভুল হবে না এজন্য যে তিনি এই গ্রন্থ রচনা করতে গিয়ে একটি বড়সড় গবেষণা কর্ম করেছেন তা বোঝা যায়।গ্রন্থের শেষে তথ্যসূত্রে অসংখ্য সহায়ক গ্রন্থ,প্রবন্ধ-নিবন্ধের রেফারেন্স দিয়েছেন,যা তাঁর জ্ঞান চর্চা সম্পর্কে বেশ খানিকটা ভাবিয়ে তোলে।
ছয় অধ্যায় ও উনিশ পরিচ্ছদে বিভক্ত বইটির সামগ্রিক যে বিষয় নির্বাচন তা চমকপ্রদ হবার মতই। এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে ছয় অধ্যায় ও উনিশ পরিচ্ছদের বিস্তৃত আলোচনা এক প্রকার অসম্ভব।তবু খুব সংক্ষিপ্ত আকারে সামগ্রিকভাবে গ্রন্থটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ করা চেষ্টা করছি।গ্রন্থের বিষয়বস্তুতে আমাদের সমৃদ্ধ উপমহাদেশের চিত্র উঠে এসেছে।দুই শতাব্দী জুড়ে বিস্তৃত ব্রিটিশ শাসন কিভাবে আধুনিক বাঙালির সংস্কৃতি আর মনোজগতে প্রভাব ফেলেছে তা সুনিপুন মুন্সিয়ানায় তুলে এনেছেন লেখক।আজও আমাদের প্রতি পদক্ষেপে সেই প্রভাব রয়ে গেছে সেকথাও জোরালোভাবে বলবার চেষ্টা করেছেন তিনি।
গন্থের প্রাককথনে লেখক নিজেই বলেছেন,‘ উপনিবেশবাদ ও বাঙালির সংস্কৃতি’ গ্রন্থটিতে দু’শতাব্দীর ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের যাবতীয় নেতিবাচক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সাথে বাঙালি সংস্কৃতির গুরুতর সংঘাত ও অভিঘাতের বিষয়টি আলোচনা করা হয়েছে।সংস্কৃতি বলতে এখানে সংকীর্ণ অর্থে শুধুমাত্র শিল্প,সাহিত্য,চিত্রকলা,দর্শন,সংগীত,নৃত্য কিংবা নাট্যকলার মতো অবস্তুগত সংস্কৃতিকে বিবেচনা করা হয়নি।আধুনিক নৃ-বিজ্ঞান ও সমাজ-বিজ্ঞানে ‘সংস্কৃতি’ প্রত্যয়টির যে বিপুল পরিসর ও পরিমণ্ডল রয়েছে,তা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।সহজ কথায়,সংস্কৃতি প্রত্যয়টির আধুনিক পরিধি ও মানদণ্ডে বাঙালি সংস্কৃতি বলতে যা বোঝায় যতটুকু বোঝায় তার সাথে ইংরেজ উপনিবেশকালের সাংস্কৃতিক ঘাত-অভিঘাত ও সংঘাতের নানা দিক এ গ্রন্থে উপস্থাপন করা হয়েছে।’ অর্থাৎ লেখকের এ বক্তব্যে স্পষ্ট হয় যে, সংস্কৃতির সুবিশাল পরিসর নিয়ে এ গ্রন্থে আলোচনা করা হয়েছে।
জীবনযাপন,অর্থনীতি,সাম্রাজ্যবাদ,ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিকরাষ্ট্র থেকে পরে ব্রিটিশরাজের অধীনস্ত হওয়া,সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা,দাঙ্গার চুড়ান্ত পরিণতি দেশভাগ গ্রন্থের বিষয়বস্তু থেকে বাদ যায়নি।উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের ফাটল সৃষ্টিতে উপনিবেশিক শক্তি যে নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছিল সেটি লেখক সুষ্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিয়েছেন।
দুশো বছরের নানা ঘটনা প্রবাহ এক মলাটে বিশ্লেষণ করা খানিকটা জটিল।কিন্তু সেই জটিল কাজটি পাঠকের সামনে অত্যন্ত সহজভাবে উপস্থাপন করেছেন লেখক।আমি নিজে যখন লেখক হিসেবে কোন বিষয়ে লিখতে বসি তখন মাথায় রাখি আমার লেখাটি যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারির সাথে সাথে প্রাইমারি পেরুনো স্বল্প শিক্ষিত মানুষটির কাছেও বোধগম্য হয়।লেখার সার্থকতা আমার কাছে সেখানেই মনে হয়।হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন তার লেখায় এই বিষয়টির পরিচয় দিয়েছেন দেখে আমার অত্যন্ত ভালো লেগেছে।লেখক বারবার এক সমৃদ্ধ উপমহাদেশকে উপস্থাপন করেছেন,বাংলাকে উপস্থাপন করেছেন।সেই সমৃদ্ধ উপমহাদেশ ও বাংলায় কিভাবে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদ ঢুকে পড়ে নানা বিপর্যয়কর পরিস্থিতি তৈরি করে,উপমহাদেশ ও বাংলার যে নিজস্ব একটি অগ্রগামীতা বিকৃতির সম্মুখিন হয় সেসব উঠে এসেছে গ্রন্থে।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে ভ্রাতৃঘাতী বিভাজন,অধস্তনতা ও হিনমন্যতার যে সংস্কৃতি ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ ভারতে ঢুকে পড়েছে এবং হিন্দু-মুসলমানের যে সাংঘর্ষিক মনোভাব গড়ে উঠেছিল,যা আজও উপমহাদেশে প্রবলভাবে বিদ্যমান সেসব উঠে এসেছে।আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের পরেই যে বিষয়টি আমাকে সবচেয়ে বেশি নাড়া দেয় তা হল দেশভা-দেশান্তরি।আমি আজও মানসিকভাবে ব্রিটিশ আইনজীবী এই অঞ্চলের সাথে সম্পূর্ণ অপরিচিত সিরিল র্যাডক্লিফের ব্রিটিশ শাসিত ভারতকে মাত্র পাঁচ সপ্তাহ সমযয়ে ভাগ করে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের অযৌক্তিক সীমানা ঠিক করাটাকে মানতে পারি না।এই গ্রন্থের লেখক হেদায়েতুল্লাহ আল মামুনও মেনে নিতে পারেননি বলেই গ্রন্থের পাতায় পাতায় সে বর্ণনাও তিনি দিয়েছেন।যে ভাগের নির্মম প্রভাব আজও উপমহাদেশ বয়ে বেড়াচ্ছে সেকথা বলেছেন তিনি।কত জনম বয়ে বেড়াতে হবে আমরা কেউ তা জানি না।ব্রিটিশরা ভাগ করে দিয়ে চলে গেছে কিন্ত আজও এখানে মেজরিটি, মাইনরিটি ও রিফিউজি তর্ক চলে দিবারাত্রি।এমন নানা বিষয় উঠে এসেছে গ্রন্থটিতে।
সার্বিকভাবে বলতে হয় এটি ইতিহাসের একটি অত্যন্ত সুখপাঠ্য গ্রন্থ।ইতিহাসের ছাত্র না হয়েও লেখক হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন এমন একটি ঐতিহাসিক গ্রন্থ রচনা করে তার সম্পর্কে আমাদের জানা বোঝাটকে আরও উচ্চস্তরে নিয়ে গেছেন।একথা বলতেই হয় যে ‘উপনিবেশবাদ ও বাঙালির সংস্কৃতি’ ইতিহাসের এক নির্মোহ বিশ্লেষণী গ্রন্থ।ভবিষ্যতে তিনি আরও এধরণের বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করবেন সেই প্রত্যাশা রইল তাঁর কাছে।এই গ্রন্থটি প্রকাশ করেছে জার্নিম্যান বুকস।গ্রন্থটির বহুল প্রচার কামনা করছি।
লেখক:গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব
ই-মেইল: sazzadkadir71@gmail.com
Leave a Reply