বয়ঃসন্ধি কালের সমস্যা কত হাজার বছরের পুরানো তা আজো কেউ সঠিক জানে না। তবে মানুষের সভ্যতা ও অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে এ সমস্যা আছেই। এর কারণ নিয়ে নানান কথা বলা হয়। সাধারণভাবে ধরে নেয়া হয়, ওই সময়টাতে হঠাৎ শরীরের বিকাশ যতটা ঘটে মনের বিকাশ ততটা ঘটে না বলেই এ সমস্যা।
শরীরের দ্রুত বৃদ্ধির সঙ্গে মন সমান তালে কেন বেড়ে উঠতে পারে না? এর জন্য দায়ী কি কেবল প্রকৃতি। প্রকৃতি দ্রুত তার শরীরটি বাড়িয়ে দেয়।
প্রকৃতি যেমন দ্রুত শরীর বাড়িয়ে দেয় তেমনি মনের বিকাশও প্রকৃতির মাধ্যমে ঘটে। বাস্তবে শরীর ও মন বেড়ে ওঠার ভেতর এই যে অসমঞ্জস পাওয়া যায় এর মূলে কাজ করে প্রকৃতি নয়, সমাজ ও পরিবার।
পৃথিবীর সভ্যতা অনেক পথ এগিয়েছে ঠিকই। কিন্তু অধিকাংশ সমাজ ও পরিবার এখনও মানুষের মনকে সঠিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্যে সহায়ক হয়নি। আর সত্যি অর্থে আজো অবধি পৃথিবীতে এমন কোন রাষ্ট্র বা রাজত্ব দেখা যায়নি যে সেখানে মানুষের মনকে বেড়ে ওঠার গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্রের চরিত্র সব সময়ই নির্মমতা দিয়ে ভরা। তাই সেখানে মনের বিকাশের অবস্থান না খোঁজাই ভালো। এবং আগামী হাজার বছরেও তা আশা করা যায় না।
এ কারণে মনের বিকাশের জায়গা খুঁজতে হবে, সমাজে ও পরিবারে। সমাজ ও পরিবারের মধ্যে সমাজের সবটুকু নিজের মত করে পাওয়ার থেকে পরিবারের সবটুকু নিজের মতো করে একটু সহজে পাওয়া যেতে পারে।
আর এজন্যই বয়ঃসন্ধি’র ও কিশোর কিশোরীদের মনের বিকাশের দায়টি পরিবারের ওপর গিয়ে পড়ে নব্বই ভাগ। এখানে পরিবারকে মনে রাখতে হয়, ভালো খাবার যেমন তার সন্তানের শরীরের পুষ্টি ঘটাচ্ছে তেমনি একটি সুস্থ ও বিকশিত পারিবারিক পরিবেশ তার সন্তানের মনের পুষ্টি দিতে সব থেকে সহায়ক।
কিশোর কিশোরীদের মনের পুষ্টির জন্যে তাদের সবার আগে প্রয়োজন পরিবারে তার নিজস্ব স্পেসটুকু। শিশুবেলা থেকে যেন সে পরিবারে তার নিজ্স্ব স্পেস পায়। তাকে যেন শুধু হুকুম পালন না করতে হয়। বরং মোটেই যেন তার ওপর হুকুম না পড়ে, অবুঝ বেলাতেও সে যেন বুঝতে পারে তার একটা স্বাধীনতা আছে। আর একটু বুঝতে শিখলেই যেন সে জানতে পারে, পরিবারের যে কোন বিষয়ে সবার মতো তারও একটা মত দেবার জায়গা আছে। তার কথাটি সে নির্ভয়ে বলতে পারবে, তাই সে যত ভুল কথা হোক না কেন। স্পেস যেমন একটি চারা গাছকে দ্রুত বেড়ে ওঠার সুযোগ দেয়, তেমনি পারিবারিক স্পেসও একটি শিশু বা কিশোরের মনকে অমনি দ্রুত বেড়ে ওঠার সুযোগ দেয়। তখন দেখা যায়, কেউ কেউ বলবে ইঁচড়ে পাঁকা। অর্থাৎ শরীরের থেকেও মন এগিয়ে গিয়েছে। ক্ষতি নেই ইঁচড়ে পাকা হলে। কারণ, তাহলে তো আর সে মন পিছিয়ে যাবার সমস্যায় পড়ছে না। পড়ছে না বয়ঃসন্ধির সমস্যায়।
পারিপাশ্বির্ক সমাজ যে পরিবারের মতো হবে এমনটা আশা করা যায় না। তাই পরিবার থেকেই মনকে শক্ত করার সুযোগ করে দিতে হবে, তাকে জানতে হবে- বাড়ি থেকে বের হলেই তুমি কিছু না কিছু বাধা পাবে। সেখানে তুমি পাহাড়ি নদীকে দেখো, তার জলস্রোত কেমন একের পর এক বড় বড় পাথর ঠেলে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
আর এজন্য, পরিবারে প্রয়োজন শিশু বা কিশোরকে যত বেশি পারা যায় প্রকৃতির কাছে নিয়ে যাওয়া। বর্তমান যুগের জটিল যন্ত্রের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটানো। এ জন্যে পরিবারগুলোর হয়তো অন্য বিলাসিতার ব্যয় কমে যাবে, কিন্তু প্রকৃত বিনিয়োগ তো সন্তানে। তাই বিনিয়োগ সেখানেই করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে একথা মনে রাখা প্রয়োজন, শেষ বিচারে নিজের মানসিক শান্তিই সর্বোচ্চ সফলতা। রাজার রাজদন্ড হোক, আর সেনাপতির ধারালো যুদ্ধজয়ী তরবারী হোক- সবই ব্যর্থ মনে হয়- সকল বিজয়ের পরে যখন পরিবারে ফিরে সন্তান ঘিরে শান্তি না মেলে।
প্রযুক্তি সবকালে ছিলো। একালে, এ সময়ে নতুন ফর্মে এসেছে। সবাই এ নিয়ে চারদিকে গেল গেল রব তুলেছে। যে প্রযুক্তি শেষ করে দিচ্ছে শিশু কিশোরদের। প্রযুক্তি এগিয়ে দেয়া ছাড়া কখনও শেষ করে দেয় না। প্রযুক্তি না হলে মানুষ আজ এখানে পৌঁছাতে পারতো না। প্রযুক্তি তৈরি বা আবিস্কারও মানুষের সহজাত ধর্ম। তাই প্রযুক্তি কোন বয়ঃসন্ধির বা কোন কিশোর কিশোরীর সমস্যা নয়। বরং সে যেন স্বাধীনভাবে নিজের স্পেসে দাঁড়িয়ে প্রযুক্তিকে গ্রহন করতে পারে- সেই পরিবেশই পরিবারকে গড়তে হবে।
২ মার্চ, বিশ্ব কৈশোর মানসিক স্বাস্থ্য দিবসে প্রতিটি পরিবার এমনই ভাবেই যেন তার পরিবার নিয়ে ভাবনাগুলোর ডানা মেলায়। আর সেই ভাবনার পাখনায় ভর করে ওড়ে যেন তার পরিবার। ২ মার্চ বিশ্ব কৈশোর মানসিক দিবসের গুরুত্ব এটাই যে একবার হলেও সারা বছরের জন্যে নাড়া দিয়ে যাবে সে প্রতিটি পরিবারকে। তাই রাষ্ট্র ও সমাজেরও উচিত অন্য অনেক দিবসের থেকে এটাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে পালন করা।
– নির্বাসিতা
Leave a Reply