সারাক্ষণের চিরায়ত সাহিত্য বিভাগে এবারে থাকছে মানিক বন্দোপধ্যায়ের দিবারাত্রির কাব্য।
দিবারাত্রির কাব্যে’র ভূমিকায় মানিক বন্দোপধ্যায় নিজেই যা লিখেছিলেন …..
দিবারাত্রির কাব্য আমার একুশ বছর বয়সের রচনা। শুধু প্রেমকে ভিত্তি করে বই লেখার সাহস ওই বয়সেই থাকে। কয়েক বছর তাকে তোলা ছিল। অনেক পরিবর্তন করে গত বছর বঙ্গশ্রীতে প্রকাশ করি।
দিবারাত্রির কাব্য পড়তে বসে যদি কখনো মনে হয় বইখানা খাপছাড়া, অস্বাভাবিক,- তখন মনে রাখতে হবে এটি গল্পও নয় উপন্যাসও নয়, রূপক কাহিনী। রূপকের এ একটা নূতন রূপ। একটু চিন্তা করলেই বোঝা যাবে বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে সীমাবদ্ধ করে নিলে মানুষের কতগুলি অনুভূতি যা দাঁড়ায়, সেইগুলিকেই মানুষের রূপ দেওয়া হয়েছে। চরিত্রগুলি কেউ মানুষ নয়, মানুষের Projection-মানুষের এক এক টুকরো মানসিক অংশ।
দিবা রাত্রির কাব্য
মানিক বন্দোপাধ্যায়
অপরাধীর মতো মন্থরপদে হেরম্ব আশ্রমে ফিরে এল। অন্ধকার বাগান পার হয়ে বাড়ির রুদ্ধ দরজায় সে করাঘাত করল আস্তে। তারপর আনন্দের নাম ধরে ডাকল। অভিশপ্ত দেবদূতের মতো মর্ত্যের প্রবাস সাঙ্গ করে সে যেন স্বর্গের প্রবেশ-পথে সসঙ্কোচে এসে দাঁড়িয়েছে। দরজা খোলার জোরালো দাবি জানাবার সাহসও নেই।
আলো হাতে এসে দরজা খুলে আনন্দ নীরবে একপাশে সরে দাঁড়াল। হেরম্ব মৃদুস্বরে বলল, ‘দেরি করে ফেলেছি, না ?’
‘কোথায় ছিলে এতক্ষণ?’
‘সমুদ্রের ধারে খানিকক্ষণ বেড়িয়ে মন্দিরে গিয়েছিলাম।’
‘তার বাড়ি যাওনি সকালে যিনি এসেছিলেন?’
‘গিয়েছিলাম। তিনি আমার সঙ্গে সমুদ্রের ধারে বেড়াতে এলেন। তাঁকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে ঘুরতে ঘুরতে মন্দিরের সামনে এসে হাজির হয়েছি। মন্দিরে উঠে একটু বসলাম। মনটা ভাল ছিল না, আনন্দ।’
‘কেন?’
‘তিনি বললেন আমায় তিনি ভালবাসেন। আমি ভালবাসি না বলায় মনে খুব ব্যথা পেলেন। কারো মনে ব্যথা দিলে মন খারাপ হয়ে যায় না?’
দরজা বন্ধ করার জন্য আনন্দ হেরম্বের দিকে পিছন ফিরল। হেরম্বের মনে হল, এই ছুতায় সে বুঝি মনের ভাব গোপন করছে। দরজায় খিল দিয়ে আনন্দ ঘুরে দাঁড়াতে বোঝা গেল, হেরম্বের অনুমান সত্য নয়। আনন্দ কখনো কিছু গোপন করে না।
‘তিনি অনেকদিন থেকে তোমায় ভালবাসেন, না?’
‘তাই বললেন।’
দু’জন তারা হেরম্বের ঘরে গেল। মালতীর কোন সাড়াশব্দ নেই। সবগুলি আলো আজ জ্বালা হয়নি, বাড়িতে আজ অন্ধকার বেশী, স্তব্ধতা নিবিড়। আলগোছে মেঝেতে আলোটা নামিয়ে রেখে আনন্দ বলল, ‘আমার ভালবাসা দু’দিনের!’
হেরম্ব অনুরাগ দিয়ে বলল, ‘কেন তুমি কেবলি দিনের হিসাব করছ আনন্দ?’
কথাগুলি হঠাৎ যেন আক্রমণ করার মতো শোনাল। আনন্দ থতমত খেয়ে বলল, ‘না, তা করিনি। এমনি কথার কথা বললাম।
Leave a Reply