মাক্সিম গোর্কি
জেনোয়া-র রেল স্টেশনের সামনেকার স্কোয়ারে প্রচণ্ড ভিড় জমেছে। তাদের সকলেই প্রায় মজুর, এখানে-ওখানে বেশ কিছু ভোজন তৃপ্ত ভদ্র পোষাকের লোকও ছড়ানো। ভিড়ের সামনে নগরপরিষদের সদস্যেরা দাঁড়িয়ে। তাদের মাথার ওপরে নগরের ভারি পতাকা – তাতে সুনিপুণ রেশমী এন্দ্রয়ডারি। তার পাশেই শ্রমিক সংগঠনগুলোর নানা- রঙা নিশান। ভিড়ের মধ্যে চকচক করে সোনালী চুড়ো, ঝালর, আর রাশি, পতাকাদণ্ডের শীর্ষগুলো ঝকমক করে, পত পত শব্দ শোনা যায় সিল্কের, আর উৎসবমুখর ভিড়টা থেকে যে মৃদু গুঞ্জন উঠে তাকে মনে হয় যেন এক অনুচ্চ ‘সটো ভোসে’ স্তবগানের সুর।
মাথার ওপরে, উচ্চ বেদীতে দাঁড়িয়ে আছে স্বপ্নদ্রষ্টা কলম্বাসের মূর্তি-সেই তার মূর্তি যে কি না সহ্য করেছিল বিশ্বাসের জন্য, আর শেষ পর্যন্ত জিতেছিল কেননা তার বিশ্বাস ছিল। আজকেও যেন সে
লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে, মর্মর মুখ তুলে যেন বলে চলেছে: ‘তারাই জিতবে যাদের বিশ্বাস আছে।’
বেদীর ওপর মুতির পায়ের কাছে গায়কদল তাদের বাজনাগুলো নামিয়ে রেখেছে। পেতলগুলো রোদে ঝকমক করে সোনার মতো।
স্টেশনের অর্ধবৃত্তাকার বাড়িখানা যেন মর্মরের পাখা প্রসারিত করে অপেক্ষমাণ জনতাকে আলিঙ্গন করতে চায়। বন্দর থেকে ভেসে আসে জাহাজের টানাটানা নিঃশ্বাস, জলের মধ্যে প্রপেলার ঘোরার অস্পষ্ট শব্দ, শেকলের বানান, হুইসিল আর হল্লা। ফুটন্ত সূর্যের নিচে স্কোয়ারখানা কিন্তু নিঝুম, উত্তপ্ত। বাড়ির জানলা আর ব্যালকনিতে মেয়েরা ফুল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে, তাদের পাশের বাচ্চাগুলোকেও ছুটির পোমাকে দেখায় যেন ফুলের মতো।
স্টেশনে যেই হুইসিল দিয়ে ইঞ্জিনটা ঢোকে অমনি চঞ্চল হয়ে উঠে ভিড়, দলামোচড়া কয়েকটা টুপি ওড়ে বাতাসে, যেন কালো কয়েকটা পাখি। বাজনদাররা বাজনা তুলে নেয়, আর জনকয়েক গম্ভীর প্রকৃতির বয়স্ক লোক পোষাক ঠিক করে সামনে এগিয়ে যায়, তারপর জনতার দিকে ফিরে ডাইনে বাঁয়ে ক্রমাগত হাত নেড়ে কি বলতে শুরু করে।
ধীরে ধীরে লোক দুভাগ হয়ে রাস্তায় যাবার একটা চওড়া পথ করে দেয়।
‘কাকে অভ্যর্থনার জন্যে ওরা এসেছে?’
‘পার্মা শহরের ছেলেগুলোর জন্যে।’
পার্বাতে একটা ধর্মঘট চলছে, মালিকেরা হার মানতে রাজী নয়। মজুরদের অবস্থা এমন সঙ্গীন যে তারা ঠিক করেছে, উপোসের হাত থেকে ছেলেগুলোকে বাঁচাবার জন্যে ওদের পাঠিয়ে দেওয়া হোক জেনোয়া-র সাথীদের কাছে।
স্টেশনের খাম্বাগুলোর পেছন থেকে আবির্ভূত হয় ছোটোদের দিব্যি একটা মিছিল; ছেলেগুলো অর্ধনগ্ন, ছেঁড়াখোঁড়া পোষাকে তাদের দেখায় যেন কতকগুলো বিচিত্র লোমশ প্রাণী। এক এক সারে পাঁচ জন করে দাঁড়িয়ে হাতে হাত দিয়ে ওরা হাঁটে, দেখায় কেমন ছোট, খুলিধূসর, ক্লান্ত। মুখগুলো ওদের গম্ভীর, কিন্তু চোখগুলো উজ্জ্বল। বাজিয়েরা গ্যারিবন্ডি স্তোত্রের বাজনা শুরু করতেই তাদের উপবাস ক্লিষ্ট ছোটো ছোটো শুকনো মুখের ওপর আনন্দের হাসি খেলে যায়।
ভবিষ্যতের এই নরনারীদের জনতা স্বাগত করে এক কর্ণভেদী চিৎকার তুলে, তাদের সামনে অবনত হয় নিশান আর ছেলেগুলোকে বিমূঢ় বিস্মিত করে দিয়ে বেজে উঠে পেতলের রামশিঙা। আচমকা এই অভ্যর্থনায় কিছুটা খতমত খেয়ে ছেলেগুলো এক মুহূর্তের জন্যে পেছিয়ে যায় তারপর দাঁড়ায় সিধে হয়ে, আর মনে হয় যেন তারা আগের চেয়ে লম্বা হয়ে উঠেছে; আরো ঘন হয়ে আসে ছেলেরা আর
শত শত কণ্ঠে জেগে ওঠে একটি ঐকান্তিক খুনি: ‘ভিভা ইতালিয়া! ইতালীর জয় হোক।’
ছেলেগুলোর দিকে ছুটে যেতে যেতে বজ্রকণ্ঠে জনতা বলে; ‘তরুণ পার্মা জিন্দাবাদ!’
‘এভৃতিভা গ্যারিবল্ডি। জয় হোক গ্যারিবল্ডির।’ ধুসর একটা কীলকের মতো ভিড়ের মধ্যে প্রবেশ করতে করতে, ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যেতে যেতে চিৎকার করে ছেলেগুলো।
হোটেলের জানলাগুলো থেকে আর ঘরবাড়ির ছাত থেকে শাদা শাদা পাখির মতো নড়তে থাকে রুমাল আর নিচের ছেলেদের মাথার ওপর নেমে আসে পুষ্পবৃষ্টি আর উচ্ছল ফুর্তির চিৎকার।
সব কিছুতেই একটা উৎসবের আবহাওয়া জেগে ওঠে, সবকিছুই যেন উঠে বাঁড়ার প্রাণ পেরে, এখন কি ধুসর বর্বর লাখরগুলো পর্যন্ত যেন ফুটে উঠে রতের পলেস্তারায়।
বাতাসে পত পত করে বিশাব, দুল আর চুপি ভাড় আকাণে, ডিড়ের যাথার ওপরে উচু হয়ে ওঠে বাচ্চাগুলোর ছোটো ছোটো যাধা, গাঁঢ় রঙের ছোটো ছোটো হাত বাড়িয়ে তারা অভিনন্দন থানার, আর বুকতে শুরু করে ফুলগুলো, আর বাতাস খুণিত হতে থাকে গ্রচণ্ড অবিয়ার এক উল্লাসে।
‘ডিভা ইন সোশ্যালিজমো। সোশ্যালিস্থ নিন্দাবাদ।’
‘এভূতিতা ইতালিয়া।’
সবকটি বাচ্চাকেই কেউ না কেউ তুলে নেয়, কেউ কেউ ওঠে বয়স্কদের কাঁবে, কেউ কেউ বাঁধ্য গড়ে কঠোর-বর্শন সওক্ষ লোকগুলোর চওড়া বুকের ওপর। চিৎকার আর হাসির গণ্ডগোলে বাজনার শব্দ প্রায় শোনাই যায় না।
ভিড়ের মধ্যে ছোটাছুটি করে অবশিষ্ট আগন্তকদের কোলে তুলে নিতে নিতে পরস্পর চিৎকার করে চলে মেয়েরা।
‘আন্নিতা, তুমি দুজনকে নিচ্ছো তো?’
‘হাঁ, আর তুমি?’
‘খোঁড়া মার্গারেটকে একটা দিতে হবে, ভুলো না…’
চারিদিকে একটা সানন্দ উত্তেজনার স্রোত। স্মিত মুখ আর করুণাষন সজল চোখের আসর চারিদিকে। ইতিমধ্যেই কিছু কিছু ছেলে
রুটি পেয়ে চিবুতে শুরু করে দেয়।
‘আমাদের কালে এমন কাণ্ড ভাবতেই পারত না কেউ।’ মন্তব্য করে একটা বুড়ো: নাকটা তার শুকপাখির ঠোঁটের মতো, দাঁতের ফাঁকে কালো একটা চুরুট।
‘অথচ কি সোজা ব্যাপার…’
‘ঠিকই, সোজাও বটে, উচিতও বটে।’
মুখ থেকে চুরুট খসিয়ে বুড়োটা তাকায় চুরুটের ডগায়, ছাই ঝাড়তে ঝাড়তে নিঃশ্বাস ফেলে। তারপর কাছেই দুটি পার্মার ছেলেকে দেখতে পেয়ে- বোঝাই যায় ওরা দুটি ভাই- ভয়ানক রকনের একটা মুখের ভাব করে। তা দেখে তাকিয়ে থাকে গম্ভীর মুখ ছেলেদুটো। লোকটা ইতিমধ্যে চোখের ওপর টুপি টেনে দিয়ে দুই হাত ছড়িয়ে দেয়। তারপর ছেলে দুটো ভ্রু কুঁচকে যেই পেছিয়ে যাবার চেষ্টা করে অমনি হঠাৎ বসে পড়ে ডাকতে শুরু করে মোরগ-ডাক। আর পাথর বাঁধা রাস্তার ওপর নগ্ন পা ঠুকে হো হো করে হেসে ওঠে ছেলেরা। আর উঠে টুপি ঠিক করে নিয়ে বিচলিত পদক্ষেপে হেঁটে চলে যায় লোকটা, ভাবখানা এই যেন সেও তার কর্তব্যটুকু করে গেল।
কলম্বাসের মূর্তির পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে একটি কুঁজো মেয়ে, মাথায় পাকা চুল, মুখখানা যেন ডাইনীর মতো, হাড্ডিসার খুতনির ওপর শক্ত শক্ত পাকা পাকা কিছু লোম। মেয়েটা কাঁদতে শুরু করে আর লাল চোখ দুটো মুছতে থাকে তার বিবর্ণ শালের প্রান্ত দিয়ে। এই উচ্ছল ভিড়ের মধ্যে কুৎসিত ময়লা রঙের মেয়েটাকে লাগে, কেমন নিঃসঙ্গ …
জেনোয়া-র এলাকার একটি কালোচুলো যুবতী আসে তড়বড় করে। সঙ্গে তার সাত বছরের বাচ্চা। বাচ্চাটার পায়ে কাঠের জুতো, মাথার এতো বড়ো একটা ধূসর টুপি যে সেটা প্রায় তার কাঁধ পর্যন্ত নেমে এসেছে। ছোট্ট মাথাটা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে ছেলেটা চেষ্টা করে যাতে টুপিতে তার চোখ ঢাকা না পড়ে যায়, টুপিটা কিন্তু ক্রমাগত তার মুখের ওপর ঝুলে ঝুলে পড়ে। তাই দেখে মেয়েটা টুপিখানা খুলে নিয়ে হাওয়ায় দোলাতে শুরু করে, আর হাসতে থাকে, গাইতে থাকে। মুখ-ভরা হাসি নিয়ে ছেলেটা মাথা তুলে একবার দেখে তারপর লাফাতে শুরু করে টুপিটা ধরবার জন্যে। লাফাতে লাফাতেই ওরা সরে যার দৃষ্টির বাইরে।
চামড়ার এপ্রণ-পরা একটা লম্বা লোক: বলিষ্ঠ হাত দুটো তার অনাবৃত। কাঁধের ওপর চাপিয়েছে একটা ছয় বছরের বাচ্চা মেয়েকে। ছোটখাট ধূসর কেমন একটা ইঁদুরের মতো দেখায় মেয়েটাকে।
লোকটার পাশে পাশে হাঁটে একটা মেয়ে। আগুনের মতো লালচুলো একটা বাচ্চাকে সে সঙ্গে নিয়ে চলেছে। মেয়েটাকে লোকটা বলে:
‘কি বলছিলাম জানো। এই রকম ব্যাপার যদি বেশ রপ্ত হয়ে যায়, তাহলে আমাদের হারানো সহজ হবে না, না?’
তারপর বিজয়ের এক গভীর হাসি হেসে সে তার কাঁধের ওপরকার ছোট্ট বোঝাটাকে নীল শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে চিৎকার করে ওঠে:
‘এভিভা পার্মা-আ। পার্মা জিন্দাবাদ!’
ধীরে ধীরে চলে যেতে থাকে লোকজন। চলে যায় ছেলেগুলোকে কেউ কাঁধে চাপিয়ে, কেউ হাত ধরে সঙ্গে নিয়ে। শূন্য হয়ে যায় স্কোয়ার, পড়ে থাকে শুধু দলিত ফুলগুলো, লজেন্সের মোড়ক, একদল ফুর্তিবাজ কুলী আর তাদের সকলের ওপর সেই মহান মূর্তি-
মানব যে আবিষ্কার করেছিল নতুন জগৎ।
আর নতুন জীবনের দিকে যারা এগিয়ে চলেছে সেই জনগণের উল্লাসধ্বনি রাস্তা জুড়ে ধ্বনিত হতে থাকে এক বিপুল রামশিভার আরাবের মতো।
Leave a Reply