মাক্সিম গোর্কি
গুমোট দুপুর। সবে দুপুরের তোপ পড়ে দূরে, অতিকায় একটা পচা ডিম ফাটানোর মতো কেমন একটা ফাঁপা আওয়াজ করে। বিস্ফোরণে ঘুলিয়ে ওঠে শহরের যতো কটু গন্ধ- অলিভ তেল আর রশুন আর মদ আর রোদ-পোড়া ধূলোর গন্ধ যেন আরো ঝাঁঝালো লাগে।
কামানের চপচপে স্পন্দনটায় এই দক্ষিণাঞ্চলের ঝলসানো দিনের কোলাহল যেন রাস্তার তপ্ত পাথরগুলোয় ধাক্কা খেয়ে এক মুহূর্ত চুপ করেছিল। মুহূর্ত পরেই তা আবার রাস্তা ছাপিয়ে উঠে, চওড়া ঘোলা একটা স্রোতের মতো বইতে থাকে সমুদ্রের দিকে।
জমকালো নকসা তোলা এক ধর্মযাজকের পোষাকের মতো শহরটা বর্ণাঢ্য। তার আবেগঘন কথা, কোলাহল আর চিৎকার যেন জীবনের শুরগানে প্রস্তুত। সব শহরই হল মানুষের মেহনতে তোল্য এক একটা যদির, সব দেহদতই হণ ভবিষ্যতের কাছে এক একটি প্রার্থনা।
আকাশের মধ্যনিপুতে সূর্য। নীল আকাশ থেকে আগুন ঝরে। পৃথিবী আর সমুদ্রের ওপর দেখে-আসা এক একটি সূর্যকিরণ যেন আগুনের এক একটি তরবারির মতো বেঁবে জল আর পাথরের বুকে। ধন রূপোর বোনা আমদানি সিল্কের মতো সমুদ্রের রঙ-তার শ্যাম-তপ্ত তরঙ্গ এসে আছাড় খায় তটে, জীবন আর আনন্দের উৎস মুখ সুর্যের উদ্দেশ্যে এক প্রবুদ্ধ জুতিগানের মর্মর তুলে।
দলে দলে ধুলো-বাগা যানঝরা মানুষ চলে তাদের দুপুরের খাওয়ার জন্যে, আলাপ করে উচ্চ কণ্ঠে, খুশিতে। অনেকে ছুটে বার সৈকতের দিকে, ধুসর জামাকাপড় ছেড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে জলে। জলের মধ্যে তাদের প্রোজরত। শরীরগুলো দেখার আশ্চর্য ছোটো ছোটো, যেন বিরাট এক পাত্র সুরার মধ্যে কালো কালো কয়েকটা কুটো। জলের রেশমী তরঙ্গাযাত, স্নানার্থীদের উল্লাস, বাচ্চাগুলোর তীক্ষ্ণ হাসি আর চিৎকার- আর এই সবকিছুর সঙ্গে অসংখ্য পায়ে হলকিয়ে ওঠা রামধনুরঙা জলোচ্ছ্বাস যেন নিবেদিত হয়ে চলেছে সূর্যের কাছে এক সানল অর্য্যের মতো। পেভমেন্টের ওপর উঁচু একটা বাড়ির ছায়ায় খাবার আয়োজন করে চারটে রাস্তা-বন্দীর মজুর। যার ওপর তারা বসে আছে সেই পাখরগুলোর মতোই তারা শক্ত আর শুকনো, আর ধূসর। তীক্ষ্ণ চোখ কুঁচকুিয়ে পাকাচুলো একটা বুড়ো লম্বা রুটি কাটে। ফালাগুলো যাতে ছোটো বড়ো না হয়ে যায় সেই দিকে তার কড়া নজর। বুড়োটার সারা শরীর ছাইয়ের মতো পুরু ধূলোয় ঢাকা। মাথায় একটা হাতে- বোনা লাল টুপি। টুপির ঝালরটা ক্রমাগত তার চোখের ওপর এসে গড়ে আর থেকে থেকে সে তার প্রকাণ্ড ঋষিতুল্য মাথাটার ঝাঁকুনি দেয়, কেঁপে কেঁপে ওঠে তার লম্বা শুকচক্ষু নাসার ফুটো দুটো।
চেঙা মতো একটা ছেলে লোকটার পাশে গরম পাথরের ওপর চিতপাত দিয়ে শুয়ে। ছেলেটার গায়ের চামড়া ব্রোজের মতো, নাগার চুলগুলো কয়লার মতো কালো। মুখের ওপর তার ঝরে পড়ে গুঁড়ো গুঁড়ো রুটি, আর আলস্যে চোখ পিটপিট করে ছেলেটা, গুন গুন করে যেন ঘুমের মধ্যে। বাকি দুজন লোক বাড়িখানার শাদা দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে বসে ঢোলে।
এক হাতে এক পাত্র মদ আর অন্য হাতে একটা ছোটো বাণ্ডিল নিয়ে একটি ছেলে এগিয়ে আসে তাদের দিকে। মাথা হেলিয়ে পাখির মতো তীক্ষ্ণ চিৎকার করে কি যেন বলে ছেলেটা। ওর খেয়াল নেই যে বোতলের খড়ের মোড়ক থেকে চুনির মতো লাল যন মদ চুঁইয়ে পড়ছে মোটা মোটা ফোঁটায়।
বুড়ো লোকটার চোখে পড়ে তা। শুয়ে থাকা ছোকরাটার বুকের ওপর রুটি আর ছুরি নামিয়ে রেখে সে ছেলেটার দিকে হাত নেড়ে চিৎকার করে বলে: ‘জলদি! কাণা কোথাকার। মদ পড়ে যাচ্ছে যে।’
মদের পাত্রটা উঁচু করে তোলে ছেলেটা তারপর মুখ হাঁ করে দৌড়ে ছুটে আসে মজুরগুলোর দিকে। সঙ্গে সঙ্গেই চঞ্চল হয়ে ওঠে তারা, চিৎকার করে উত্তেজনায় আর পাত্রটাকে নেড়ে চেড়ে দেখতে থাকে। ছেলেটা ছুটে চলে যায় একটা বাড়ির আঙিনায়। ফিরে আসে একটা বড়োসড়ো হলদে রঙের জাগ নিয়ে।
মাটির ওপর জাগটা নামিয়ে রাখে ছেলেটা। তার মধ্যে লাল সঞ্জীবনী ধারা বুড়োটা ঢালে সাবধানে। চারজোড়া চোখ সস্নেহে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে, রোদ্দুরে ঝিলিক দিচ্ছে নদ। শুকনো ঠোঁটগুলো তাদের কাঁপে।
পেভমেন্টের ওপর উঁচু হিলের শব্দ তুলে আসতে দেখা যায় একাট মেয়েকে, পরনে তার ফিকে নীল রঙের পোষাক, কালো চুলে সোনালী লেসের উড়নী। সঙ্গে হাত ধরা একটি কোঁকড়া-চুল ছোট মেয়ে, হাতে তার দুটি গোলাপী ফুল। ফুল দুটো দোলাতে দোলাতে যে গেয়ে চলছে: ‘ও না, ও মা, ও মিয়া, মা-না…’
বুড়ো মজুরের পেছনে এসে মেয়েটার গান থামে। পায়ের ওপর ভর দিয়ে উঁচু হয়ে যে তাকিয়ে দেখে বুড়োটার কাঁধের ওপর দিয়ে। দেখে হলদে জাগের ভেতর মদ ঢালা হচ্ছে, যে কল কল শব্দটা উঠছে সেটা যেন তার গানেরই একটা অনুরণন।
হাত ছাড়িয়ে নিয়ে মেয়েটা চটপট কুটি কুটি করে ছেঁড়ে ফুলের পাপড়িগুলো, তারপর চড়ুইয়ের ডানার মতো ঘোর রঙের ছোট্ট হাতখানা তুলে ছেঁড়া পাপড়িগুলো ছুঁড়ে দেয় সুরা পাত্রের মধ্যে।
চারজন লোক চমকে উঠে ধূলিধূসর মুখ তোলে রাগে। বাচ্চা মেয়েটা হাততালি দেয়, হাসে, ছোট পা দুখানা ঠোকে মাটিতে। বিব্রত হয়ে মা ওর হাত চেপে ধরতে যায়, ধমক দিতে থাকে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে। হাসিতে গড়িয়ে পড়ে ছোঁড়াটা আর জাগের ভেতর গাঢ়বর্ণ মদের ওপর ফুলের পাপড়িগুলো ভাসতে থাকে ছোটো ছোটো গোলাপী কতকগুলো নৌকার মতো।
একটা গেলাসে ফুলসমেত মদ ঢেলে নিয়ে বুড়োটা হাঁটু গেড়ে বসে। তারপর ঠোঁটের কাছে গেলাসটা এনে গম্ভীর স্নেহ মাখা গলায় বলে: ‘ঠিক আছে, সিনোরা, ঠিক আছে। শিশুর দেওয়া হল ভগবানের দেওয়া… আপনার স্বাস্থ্য, সুন্দরী সিনোরা, আর তোরও স্বাস্থ্য, মেয়ে। মায়ের মতোই তুই সুন্দরী হয়ে ওঠ, সুখী হোস মায়ের দ্বিগুণ।’
পাকা মোচের শেষ প্রান্তটা বুড়োর ডুবে যায় গেলাসের মধ্যে। চোখ কুঁচকে ধীরে ধীরে সে চুমুক দিতে শুরু করে মদে, ঠোঁট চাটতে থাকে সশব্দে, আর কাঁপতে থাকে তার বাঁকা নাকখানা।
মা হেসে, নিচু হয়ে অভিবাদন করে চলে যায়, হাত ধরে নিয়ে যায় মেয়েটাকে। পেভমেন্টের ওপর ছোট পা দুখানা ‘ঘসতে ঘসতে, এদিক ওদিক দুলতে দুলতে মেয়েটা গাইতে থাকে: ‘ও, মা-আ… ও, মিয়া, মা-আ…’মজুরগুলো মুখ ফেরায় আলস্যে। একবার মদের দিকে আর একবার ছোটো মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ওরা হাসে, আর দক্ষিণাঞ্চলের উপভাষায় পরস্পর কি যেন বলাবলি করে তড়বড় করে। আর জাগের মধ্যে রক্তিম মদের ওপর ফুলের গোলাপী পাপড়ি- গুলো ভেসে থাকে তখনো।
আর গান গেয়ে ওঠে সমুদ্র, গুঞ্জন করে চলে শহর, আর ইন্দ্রজালের কাহিনী রচনা করে উজ্জ্বল হয়ে থাকে সূর্য।
Leave a Reply