শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৮:৪৮ পূর্বাহ্ন

ইতালির রূপকথা (টানেল)

  • Update Time : মঙ্গলবার, ১৪ মে, ২০২৪, ৮.৩৬ পিএম

মাক্সিম গোর্কি

চিরন্তন তুমার-মৌলি উঁচু উঁচু পাহাড়ের ফ্রেমে বাঁধাই শান্ত নীল হ্রদ। জমকালো ঢেউ তুলে কাননের ঘন গালিচা নেমে এসেছে জলের কিনারা পর্যন্ত। শাদা শাদা বাড়িগুলো মনে হয় বুঝি চিনি দিয়ে তৈরি, তাকিয়ে আছে জলের দিকে। শিশুর সুকুমার তন্দ্রার মতো নিস্তব্ধতা।

সময়টা সকালবেলা। পাহাড় থেকে ফুলের গন্ধ ভেসে আসে মধুর। সবে সূর্য উঠেছে, গাছের পাতা আর খাসের ফলায় শিশির বিন্দু তখনো শুকোয়নি। পাহাড়ের স্তব্ধ খাঁদের মধ্যে ছুঁড়ে দেওয়া একটা ধূসর ফিতের মতো রাস্তাটা। পাথর দিয়েই বাঁধালো তবু মনে হয় রাস্তাটার গা বুঝি বা মখমলের মতোই নরন হবে। ইচ্ছে হয় হাঁত বুলিয়ে দেখি।

ইট পাথরের একটা চিবির পাশে বসে আছে একটি মজুর, ভোমরার মতো কালো তার গায়ের রঙ, মুখের ভাবে সাহস আয় সহৃদয়তার ছাপ, বুকের ওপর একটি নেভেল।

পথচলতি একটা লোক দাঁড়িয়েছিল বাদামগাছের তলায়। ব্রোঞ্জরঙা হাতখানা হাঁটুর ওপর রেখে মজুরটা তার মুখের দিকে তাকায়।

বলে, ‘এই মেডেলটা, সিনোর, সিল্ড্রন টানেলে কাজের জন্য পেয়েছি।’

বুকের ওপর চকচকে জিনিসটার দিকে তাকিয়ে ও হাসে আস্তে করে।

‘ঠিকই, সব কাজই প্রথমটা কঠিন। কিন্তু তারপর ব্যাপারটা যখন মজ্জাগত হয়ে যায়, যখন কাজকে ভালোবাসতে শুরু করি, তখন একেবারে চঞ্চল হয়ে ওঠে মানুষ, কাজ আর তখন কঠিন মনে হয় না। তবে হ্যাঁ, আমাদের কাজটা সত্যিই খুব সহজ ছিল না।’ অল্প একটু মাথা নাড়ে সে, হাসে সূর্যের দিকে চেয়ে; তারপর হঠাৎ তাজা হয়ে উঠে হাত নাড়ে, উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ওর কালো চোখ দুটো।

‘কখনো কখনো ভয় লাগত বৈকি। মাটিরও বোধশক্তি আছে, তাই না? আমরা যখন পাহাড়ের গায়ে মস্ত এক খোঁদল করে একেবারে ভেতরে গিয়ে খুঁড়তে লাগলাম তখন সেখানে মাটির সে কি রাগ। গরম হয়ে উঠল মাটির ফোঁসফোঁসানি। বুকে ভয় ঢুকল আমাদের, মাথা তার হয়ে যেতে লাগল, ব্যথা করতে লাগল হাড়ের মধ্যে। আমাদের অনেকেরই হল ঐ এক দশা। তারপরে তো মাটি থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে লাগল পাথর, গরম জল দিয়ে একেবারে ভিজিয়ে দিলে আমাদের। ওহ্, সে কি ভয়ানফ। কখনো কখনো আলো পড়লেই সে জল হয়ে উঠত রাঙা রাঙা। আর আমার বাপ বলত, “মাটিকে জখম করেছি আমরা, মাটি এবার আমাদের সকলকে ডুবিয়ে ঝলসিয়ে মারবে তার রক্তের মধ্যে।” কথাটা অবিশ্যি নিছক মন গড়া। কিন্তু মাটির একেবারে অনেক তলে দম আটকানো অন্ধকারের মধ্যে যেখানে ঝিরঝিরিয়ে জল পড়ছে বিশ্রীভাবে, পাথরের ওপর ঠন ঠন করে চলেছে লোহা, সেখানে এই রকম একটা কথা শুনলে মনে হবে বুঝি বা সবই সম্ভব। সেখানে সবই ভারি ভয়ানক, সিনোর। মেঘ পর্যন্ত উঁচু হয়ে ওঠা পাহাড়গুলোর কাছে আমরা মানুষ কতোটুকু? আর সেই পাহাড়ের পেটের মধ্যেই খুঁড়ে চলেছি আমরা… চোখে দেখলে বুঝতেন কি বলতে চাইছি, যদি দেখতেন আমরা, – এই ক্ষুদে ক্ষুদে মানুষগুলোই পাহাড়ের গায়ে কি রকম একটা হাঁ-করা খোঁদল খুঁড়ে ফেলেছিলাম, যদি দেখতেন রোজ ভোরে সেই খোঁদলের মধ্যে গিয়ে কি করে আমরা ঢুকছি, পৃথিবীর পেটের মধ্যে কি করে সেঁধোচ্ছি, আর মনমরার মতো আমাদের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে সূর্য; যদি দেখতেন আমাদের মেশিনগুলোকে, পাহাড়ের গোমড়া মুখটাকে, যদি শুনতেন সেই কোন ভেতর ভাগে গমগম্ শব্দ, আর এক পাগলার অট্টহাসির মতো বিস্ফোরণের আওয়াজ।’

লোকটা তার হাত দুটোকে খুঁটিয়ে দেখে একবার, নীল কুর্তার ওপর মেডেলের ফিতেটাকে ঠিক করে নেয়, তারপর অস্পষ্ট দীর্ষনিঃশ্বাস ছাড়ে একটা।

সগর্বে সে বলে চলে, ‘কেমন করে কাজ করতে হয় তা মানুষ জানে বটে। সত্যি সিনোর, মানুষ ছোটো প্রাণী বটে, কিন্তু কাজে নামলে তাকে রুখতে পারবে না কেউ! হক কথা বলছি সিনোর, মানুষ যতো ক্ষুদেই হোক না কেন, যা করব বলে লেগেছে, তা করবেই। আমার বাপ কিন্তু প্রথমে তা কিছুতেই বিশ্বাস করেনি। “পাহাড়ের দেয়াল দিয়ে ভগবান নিজে একটা দেশ থেকে আর একটা দেশ আলাদা করে দিয়েছেন।” আমার বাপ বলত, “এ-দেশ থেকে ও-দেশ পর্যন্ত পাহাড় খুঁড়ে গেলে ভগবানের ইচ্ছা অমান্য করা হবে। মাভোনা আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন কিন্তু।” বাপের কথাটা ঠিক নয়। মাডোল্লাকে যারা ভালোবাসে মাডোনা তাদের কখনো ছেড়ে যায় না। পরে কিন্তু আমি যা ভাবতাম, বাপও প্রায় সেই রকমই ভাবতে শুরু করেছিল। কেননা পাহাড়ের চেয়েও আনরা বড়ো, পাহাড়ের চেয়েও যে আমরা শক্ত এটা আমার বাপের ঠাহর হয়েছিল। কিন্তু মাঝে মাঝে ভোজের সময় আমার বাপ এক বোতল মদ সামনে নিয়ে টেবিলে বসত, আর আমাকে আর অন্য সবাইকে উপদেশ দিয়ে বলত: “ভগবানের সন্তানেরা সব শোনো”, বাপ খুব ভালো মানুষ, ভগবান-বিশ্বাসী ছিল কি না, তাই তার পেয়ারের বুলি ছিল, “ভগবানের সন্তানেরা।” তা আমার বাপ বলত, “ভগবানের সন্তানেরা শোনো বাপু, এ করে মাটির সঙ্গে লড়া যাবে না। মাটির গায়ে যে জখম করেছি, মাটি তার শোধ তুলবে, হার মানানো যাবে না মাটিকে! যা বলছি দেখে নিয়ো, পর্বতের ভেতরকার কলজের কাছ পর্যন্ত আমরা পৌঁছব খুঁড়তে খুঁড়তে, তারপর যেই কলজের কাছে পৌঁছব অমনি দাউ দাউ আগুনের মধ্যে গিয়ে পড়ব আমরা, কেননা সকলেই জানে মাটির কলজেটা হল আগুন! মাটির ওপর চাষ করা সে এক জিনিস। প্রকৃতি হল পোয়াতী মেয়ে, তার পোয়াতী ব্যথায় সাহায্য করা মানুষের কাজ। কিন্তু মাটির দেহখানা কি তার চেহারাখানাকে উল্টো-পাল্টা করে দেওয়া- উর্দু সেটি করা আমাদের উচিত নয়। দেখছ না, যতোই পর্বতের মধ্যে গিয়ে খুঁড়ছি, ততই গরম হয়ে উঠছে বাতাস, ততই কষ্ট হচ্ছে নিঃশ্বাস নিতে…”” মজুরটা আস্তে করে হাসে, দুহাত দিয়ে মোচটা পাকিয়ে নেয় একবার।

আমার বাপ একাই যে এই সব ভাবত তা নয়। তাছাড়া ব্যাপারটাও গত্যি- যতোই এগোই ততই গরম। আমাদের মধ্যে ক্রমেই লোকে অসুখে পড়ে মরতে লাগল। গরম জলের ঝোরা আসতে লাগল বেশি বেশি তোড়ে, চাঙ চাঙ মাটি পড়তে লাগল খসে আর আমাদের দলের লুগানে। এলাকার দুটো লোক গেল পাগল হয়ে। রাত্রে ব্যারাকে ফিরে কত লোকে ঘুমের ঘোরে ভুল বকত, আতঙ্কে গঙিয়ে উঠে লাফিয়ে পড়ত বিছানা থেকে…’বাপ বলত, “দ্যাখ, ঠিক বলেছিলাম কি না?” বাপের চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। ওর কাশিটাও ক্রমেই খারাপের দিকে চলছিল … বলত, “কি বলেছিলাম। প্রকৃতিকে হার মানানো অসাধ্যি কাজ।”।

‘শেষ কালে তো আমার বাপ সেই যে শয্যা নিল আর উঠল না। বেশ শক্ত জান ছিল আমার বাপের। তিন হপ্তারও বেশি দিন ধরে যমের সঙ্গে লড়াই করলে একগুঁয়ের মতো, নিজের তাকত যাদের জানা আছে, তারা যেমন নালিশ করে না, তেমনি বিনা নালিশে।

‘একদিন রাত্রে আমায় বললে, “আমার কাজ ফুরুল, পাওলো, নিজের ওপর নজর রাখিস, বাড়ি ফিরে যাস, মাডোনা তোকে কূপা করুন।” তারপর অনেকক্ষণ ধরে চুপ করে রইল আমার বাপ, চোখ বুজে শুয়ে শুয়ে শ্বাস টেনে টেনে নিঃশ্বাস ফেলতে লাগল।’

লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে পর্বতের দিকে তাকায়, তারপর এমন ভাবে আড়িমুড়ি ভাঙে যে মট মট করে ওঠে তার দেহখানা।

‘তারপর আমার বাপ আমার হাত ধরে কাছে টেনে এনে বললে- সত্যি বলছি সিনোর, ভগবানের দিব্যি বললে, “জানিস, পাওলো, ও হবেই হবে। এ দিকে আমরা আর পর্বতের অন্য দিক থেকে যারা খুঁড়ে আসছে, ওই পর্বতের পেটের মধ্যে এ আমরা মিলবোই মিলবো। তাই না বেটা? কথাটা তুই মানিস না?” হাঁ, মানছি।

“বহৎ আচ্ছা, বেটা! যে মরদ হবে সে যে কাজটা করছে তাতে বিশ্বাস রাখবেই রাখবে। হবেই হবে এ ভরসা তার থাকতে হবে বাপ আর মানতে হবে ভগবানকে, কেননা মাডোনার কুপায় ভগবান ভালো কাজে সাহায্য করবেনই। আমি তোকে বলে যাই বাপ, যদি তাই হয়, যদি পর্বতের পেটের মধ্যে লোকগুলো এসে মেলে, তবে আমার কবরে এসে বলিস, বাবা, হয়েছে। তাহলে ঠিক শুনতে পাবো আমি।”

‘ভালোই হল সিনোর, আমি কথা দিলাম। পাঁচ দিন পরে মারা গেল বাপ। মরার দুদিন আগে আমাকে আর অন্য সবাইকে বললে, টানেলের ভেতরে যেখানে সে কাজ করছিল সেইখানটায় যেন তাকে কবর দেওয়া হয়। খুব মিনতি করে বললে আমাদের। কিন্তু আমার মনে হয় তখন ও ভুল বকছিল।

‘বাপ মারা যাবার তেরো হপ্তা পর আমরা আর ওপাশ থেকে যারা আসছিল তারা একসঙ্গে মিললাম পর্বতের ভেতরে। আহ্, সে একটা পাগল। দিন ছিল বটে সিনোর, সেই প্রথম দিন, মাটির নিচে অন্ধকারে আমরা প্রথম শুনলাম অন্য দলটার কাজের আওয়াজ। ছোটো ছোটো আমরা মানুষ, মাথার ওপরে মাটি-সে মাটির জগদ্দল চাপে এক লহমায় আমরা সকলেই পিষে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারি। তবু সেই মাটির পেটের মধ্যেই আমাদের সঙ্গে মিলতে আসছে যারা তাদের শব্দ!

‘অনেকদিন ধরে ওই আওয়াজগুলো কানে আসত আমাদের, কাঁপা ফাঁপা আওয়াজ, দিন দিন সে আওয়াজ বেড়ে উঠতে লাগল, স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল- আর জিতছি এই পাগলা আনন্দে ক্ষেপে উঠলাম আমরা। দত্যির মতো, ভূতের মতো কাজ করে চললাম আমরা, না টের পেলাম হয়রানি, না দরকার হল তাগাদা দেবার। আহ্, সে যে কি সুন্দর, সত্যি সিনোর, যেন রোদের দিনে নাচ। ছেলেমানুষের মতো কেমন সরল আর দরদী হয়ে উঠলাম আমরা। আহ্, ওই অন্ধকার গহ্বরের মধ্যে ছুঁচোর মতো মাসের পর মাস গর্ত করে চলার পর অন্য দলটার সঙ্গে মিলতে পারার জন্যে যে কি দারুণ কি ব্যাকুল ইচ্ছেই না আমাদের পেয়ে বসেছিল সিনোর, যদি দেখতেন।’

স্মৃতির আলোড়নে লোকটার মুখখানা লাল হয়ে ওঠে আবেগে। আরো কাছে এগিয়ে এসে অদ্ভুত একজোড়া মানবিক চোখ মেলে ও তাকায় তার শ্রোতার দিকে। তারপর মৃদু কণ্ঠে সানন্দে বলতে থাকে: ‘তারপর শেষ কালে যখন মাঝখানের মাটির দেয়ালটা ভেঙে পড়ল আর সেই হাঁ’য়ের মধ্যে দিয়ে দেখা গেল মশালের ঋক্কঝকে হলুদ আলো, তখন আমাদের চোখে পড়ল একটা কালো মুখ, আনন্দে তার চোখ বেয়ে জল পড়ছে। তার পেছনে আরো মশাল, আরো সব মুখ। কানফাটা চিৎকার উঠল জয়ের, আনন্দের আহ্, জীবনের সেই হল আমার সবচেয়ে সুখের দিন সিনোর, সে কথা মনে পড়লেই ভাবি জীবন আমার বৃথা যায়নি। একে বলে কাজ সিনোর, আমার কাজ, পবিত্র কাজ। তারপর যখন বাইরের আলোয় বেরিয়ে এলাম আমরা, আমাদের অনেকেই মাটির ওপর লুটিয়ে পড়ে চুমু খেতে লাগল মাটিকে, কাঁদতে লাগল। রূপকথার কাহিনীর মতো সবটাই এমন আশ্চর্য যে কি বলব! হ্যাঁ সিনোর, হেরে যাওয়া পর্বতটাকে চুমু খেলাম আমরা, চুমু খেলাম মাটিকে; আর সেই দিন সিনোর, মাটিকে যতখানি আপন বলে মনে হয়েছিল, তা আর কখনো হয়নি। পিরিতের মেয়েমানুষের মতো সেদিন ভালোবেসেছিলাম মাটিকে।

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, বাপের কবরখানায় গিয়েছিলাম বৈকি! মরে গেলে মানুষ শুনত পায় না, তবু গিয়েছিলাম, কেননা আমাদের জন্যে যারা মেহনত করল, আমাদের মতো যারা অনেককিছু সহ্য করল, তাদের ইচ্ছাকে মান্য করা তো উচিত, তাই না?

‘হ্যাঁ, বাপের কবরখানায় গিয়ে পা দিয়ে মাটিকে নাড়া দিয়ে দিয়ে যা বলতে বলেছিল তাই বললাম। বললাম: “হয়ে গেছে, বাবা। আমরা মানুষেরা জিতেছি। কাজটা হয়ে গেছে।””

 

ইতালির রূপকথা (ফুল)

ইতালির রূপকথা (ফুল)

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024