মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন।
মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে।
তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু।
তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক
‘মেইরেছে, এ শালার আর এক জেন ডিকসন।’
‘গতরাতে আমি একটা বিশ্রী স্বপ্ন দেখেছি–‘ কাছে স’রে এসে খুব অন্তরঙ্গ হ’য়ে রজু বললে, ‘হাতিয়া-সন্দ্বীপের সাইক্লোনের সেই ফোলা ফোলা পচাখসা লাশগুলো খবরের কাগজ থেকে বের হ’য়ে অলিগলি, রাস্তা-ঘাট এখানে-ওখানে লুকোচুরি খেলছে আর কুর-কুট্টি দিয়ে হাসছে।”
বাঁ হাত দিয়ে রজুর বিনুনি ধ’রে মুঠো পাকালো খোকা। বললে, ‘এইসা থাপ্পড় মারবো যে গুলতাপ্পি ভুলে যাবি। আব্বে ছুড়ি, ওটা বোকাচিও সেভেনটির অনিতা, বেমালুম কপিরাইট ঝাড়ন্তিফাই করা হচ্ছে, এ্যাঁ।’
‘ঠাট্টা নয়, বিশ্বাস কর দাদা, ভোররাতে মাকেও দেখলাম। অনেক দিন হ’লো তুই ঘরে ফিরিসনি, আমি একা থাকি আর ভয় পাই ব’লে মা আমার কাছে শুতে আসে, এইসব। তোর জন্যে মা খুব কাঁদলো। কবে নাকি তুই বন্ধুদের পাল্লায় প’ড়ে জুয়া খেলেছিস, হাতের আংটি বেচে দিয়েছিস, আরো অনেক অভিযোগ, পরিষ্কার মনেও নেই সব–‘ মুখের কথা কেড়ে নিয়ে খোকা বললে, ‘তাই বল! তোর স্বপ্নেরও দেখি মারাত্মক রকমের একটা মোর্যাল থাকে, তা ভালো–‘
‘দুৎ। সবকিছুতেই তোর ঠাট্টা!’
থোকা একটা চিমটি দিয়ে বললে, ‘মা তোর কাছে কান্নাকাটি তো করবেই, তুই তো আমার লোকাল গার্জেন–”গার্জেনই তো–‘ ‘তবু ভালো, আজকাল আর আগেকার মতো কায়দা ক’রে গার্জিয়েন বলিস না।’
কিছু একটা ভেবে রঞ্জু বললে, ‘বাড়িতে একটা মিলাদ-টিলাদের ব্যবস্থা কর না। আমার কেমন লাগছে ক’দিন থেকে।’
‘চল, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই তোকে।’
বস্তু কোনো উত্তর দিলো না। খুব খুশি হয়নি সে, বরং ধ’রে নিয়েছে এটা খোকার নিছক কুড়েমিসুলভ এক নিষ্ঠুরতা, গাছে আলসেমির ভাঁজ ভাঙে এই ভয়ে সে বহু কিছুই করতে নারাজ। রজু যে সন্তুষ্ট নয় এই মুহূর্তে অতি সহজেই তা খোকার কাছে ধরা পড়ে; বুঝতে অসুবিধা হয়ে না ভিতরে ভিতরে ও কিভাবে গুমরে উঠছে।
বুঝলেও, বিশেষ কতোগুলো ক্ষেত্রে বেশি আমল দেওয়াটা খোকার স্বভাববিরুদ্ধ: রঞ্জটা এখনো বড় ছেলেমানুষ–বরং এইভাবে ভাবতে তার ভাললাগে, সে অভ্যস্তও এই জাতীয় ধ’রে নেওয়া চিন্তা-ভাবনায়। বিশেষ ক’রে রঞ্জ যখন বয়েসে ছোট, জাতে মেয়ে, সর্বোপরি মাথার উপরে তেমন কেউ নেই, এক্ষেত্রে তার সব আকাংক্ষাই তার কাছে সুলত অথবা সহজসাধ্য হোক খোকা তা চায় না। খোকা মনে করে এটা একটা সঙ্কট, ফলে তার পদক্ষেপ অযথা হিসেবের ফেরে পড়ে, এবং তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। এটা এক ধরনের সংস্কার, খোকা জানে। কিন্তু একটি বিশেষ ক্ষেত্রে সে সজ্ঞানেই এই সংস্কারকে মেনে নিয়েছে। এই সংঙ্কার তার দায়-দায়িত্বকে অল্পবিস্তর আচ্ছন্ন ক’রে রাখলেও, খোকা একতরফা সিদ্ধান্ত নিতে ভালবাসে।
খুব ছোটবেলায় একবার, বেশ মনে পড়ে খোকার-তখন মহা- মারী চলছে গোটা দেশ জুড়ে, লুকিয়ে লুকিয়ে দু’পয়সার চালতার আচার কিনে খেয়েছিলো সে ছেঁড়া ধুড়ধুড়ি ন্যাতাকাপড় জড়ানো এক নড়বড়ে বুড়োর কাছ থেকে; অথচ বারণ ছিলো, বারণ এবং কড়া পাহারা। তা সত্ত্বেও দু’পয়সার আচার সেই বয়েসে এমন ঈপ্সিত এমন বাঞ্ছিত হ’য়ে উঠেছিলো যে, নিষেধের বেড়া ডিঙাতে তিলবিন্দু দ্বিধান্বিত হয়নি সে। ফলে যা অনিবার্য তাই ঘটেছিলো, কলেরায় আক্রান্ত হয়েছিলো সে। মা তখনো বেঁচে; যমে-মানুষে টানাটানি যাকে বলে, সমানে তা-ই চললো। রজুর ব্যাপারটা ঠিক এই ধরনের না হ’লেও খোকা তার বিচারের মাপকাঠি এইভাবেই তৈরি করেছে।
Leave a Reply