মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন।
মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে।
তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু।
তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক
খুব কোন্ত দেখায় রঞ্জুকে। এত মলিন কেন রঞ্জুর মুখ? মা মারা গিয়েছে আজ প্রায় দু’বছর হতে চললো; এই দু’বছরে রঞ্জুই তার সবচেয়ে ধারে-কাছের মানুষ, উঠতে বসতে দু’বেলা সমানে সে তাকে দেখে আসছে, অথচ অনেক কিছুই সে জানে না, বুঝতে পারে না, কখনো কখনো এমন দুর্বোধ্য এমন অচেনা মনে হয় রজ্জুকে যার ফলে সেই খেই হারিয়ে ফেলে। কে জানে, হয়তো এই দীর্ঘ ছ’বছরে নিঃশব্দ পদসঞ্চারে একটি ছায়া প্রসারিত হয়েছে রঞ্জুর মনের গহনে, যে ছায়া মানুষের একটি খণ্ডিত অতীতকে চিরকালের জন্যে অবিচলভাবে ধ’রে রাখে, নিয়ন্ত্রণ করে সমগ্র ভবিষ্যৎকে। অনেক কিছুই মনে হয় খোকার; বিশেষ একটি অভাব বয়েসের সঙ্গে সঙ্গে রঞ্জুর মুখের ছবিটিকে বিষাদের আচ্ছন্নতায় হিম-শীতল ক’রে তুলছে, বেঁচে থাকা উচিত ছিলো মা’র।
প্রসঙ্গ পরিবর্তনের জন্যে খোকা বললে, ‘বাইরে বেরুনোর মতো জামা-কাপড় আছে তো?’
‘বোধহয় আছে, দেখছি-‘ বোঝা গেল রাজু চালাকিটার বিন্দু-বিসর্গও ধরতে পারেনি।
সত্যি, রজুটা একটা ল্যাঠা; এই আলো, এই আঁধার, থেকে থেকে একটা কিছু ঘটে ওর ভিতর। স্বভাবটাও তৈরি করেছে বিদকুটে। ইসকুলের পাট চুকিয়ে এ বছর থেকেই কলেজে যাচ্ছে, ব্যাস্, ওই পর্যন্তই। সমবয়েসী কারো সঙ্গে মেলামেশা, ছিটেফোঁটা শপিং-এ বেরুনো, কোনো ফাংশন অথবা সিনেমায় যাওয়া, কখনো কোনো কিছুতেই ও নেই। সময়মতো কলেজে যাওয়া, লেবু আর ময়নাকে দিয়ে সংসারের কাজ গুছিয়ে নেওয়া, মাঝে মাঝে দু’একটা গল্প-উপন্যাসের পাতা ওল্টানো, নিজের পড়া করা, এইসব নিয়েই সময় পার হয়ে যায় রজুর। বাগানের ব্যাপারে তুমুল উৎসাহ ছিলো তার এক সময়। বাগান পরিচর্যার জন্যে রমনা পার্কের এক মালীর সঙ্গে বন্দোবস্ত ক’রে নিয়েছে তারা। হাতেম আলী অর্থাৎ ঐ গুণধর মালীরত্নটি নিয়মিত তার মাসো- হারাটি গুণে নিয়ে যাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু বাগানে আগাছা-কুগাছা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এই কিছুদিন আগে পর্যন্ত নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সবকিছুর তদারকি করেছে রঞ্জ, দু’ঘন্টার মাঝে দম ফেলার ফুরসৎ মিলতো না ছোকরা হাতেম আলীর। কিন্তু এখন। সেখান থেকেও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে রঞ্জু। আগে হপ্তায় ক’দিন সে কামাই করছে রঞ্জুর তা হিসেব থাকতো, এখন গা ছেড়ে দিয়েছে। বয়েস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনিবার্যভাবেই কিছু না কিছু পরিবর্তন ঘটে, রজুর সেই পরিবর্তন কোন খাতে বয়ে চলেছে সে জানে না, গা ছমছম করে খোকার, তার অন্তরাত্মা কেঁপে যায়। তার নিজের এখন বাইশ বছর চলছে; ‘টু লিটল ডাকস্–টয়েন্টি টু’ তার মনে হয় না, তার মনে হয় এক জোড়া উদ্ধত রাগী গোখরো ফণা তুলে রেখেছে তার দিকে, সুযোগ পেলেই ছোবল মারবে।
বয়েস কতো হলো রঞ্জুর? গালে রেজর টানতে টানতে হিসেব করলে খোকা, সাত বছরের ছোট রঞ্জু। আরো দু’টি বোন ছিলো রঞ্জু আর তার মাঝখানে, একজন অঞ্জু অপরজন মঞ্জু। বাঞ্ছারামপুরে মামাবাড়ির পুকুরের শান বাঁধানো ঘাটের শ্যাওলায় পা হড়কে পানিতে প’ড়ে যায় অজু, মঞ্জু নামে তাকে ধরতে; বাঁচানো যায়নি দু’জনের একজনকেও। রঞ্জু যেন মামাবাড়ি সেই আশ্চর্য শান্ত তিরতিরে পুকুর যার গভীর গোপন তলদেশে চিরকালের মতো ঘুমিয়ে আছে অজু আর মঞ্জু।
দাড়ি কামানো শেষ ক’রে গোসলখানায় গেল থোকা; একটানা চারদিন বিরতির পর শরীর জুড়ানো দীর্ঘ গোসল চাই।
Leave a Reply