মাক্সিম গোর্কি
অল্প বয়সী এক সঙ্গীতকার কথা কইছিল নরম গলায়, কালো চোখ জোড়া হারিয়ে গেছে সুদূরে। বললে:
‘গানের মধ্যে দিয়ে আমি যা প্রকাশ করতে চাই, তা এই: ‘বড়ো একটা শহরের দিকে চলে গেছে একটা রাস্তা, তাতে হাঁটছে একটি ছেলে। ছেলেটার সামনে শহরটা পড়ে আছে যেন মাটি আঁকড়ে ধরা উঁচু নিচু পাথরের এক থমথমে বস্তুপিণ্ড, গোঙাচ্ছে, বিড়বিড় করছে। দূর থেকে দেখে মনে হয় যেন পুড়ে গেছে আগুনে, সূর্যাস্তের রক্তাক্ত অগ্নিশিখা তখনো তার ওপরে জ্বলন্ত। গির্জার ক্রশ, চুড়ো, আর হাওয়া-যন্ত্রটা থেকে আভা বেরুচ্ছে আগুনের মতো।
‘কালো কালো মেঘের পাড়গুলোতেও যেন আগুন ধরেছে। আকাশের লাল লাল ছোপের ওপর বড়ো বড়ো দালান কোঠার কোণা-কানাচগুলো ফুটে উঠেছে তীক্ষ্ণ হয়ে, এখানে ওখানে জানলার শার্সি দগ্দগ্ করছে খায়ের যতো। আনন্দের জন্যে ক্ষান্তিহীন লড়াই করে করে বিশ্বস্ত, যন্ত্রণাহত শহরটা যেন এখন আপন রক্তস্রোতের মধ্যে মরছে। হলুদরঙা দম আটকানো একটা ধোঁয়া উঠছে তার বুক থেকে।
‘গোধুলির আলোয় ছেলেটা হাঁটছে এক ফালি ধুসর রাস্তার ওপর। স্বান্তাটা যেন কোন এক পরাক্রান্ত অদৃশ্য হাতে ধরা একটা তলোয়ার, অবান্ত রক্ষ্যে সোজা গিয়ে বিঁধেছে শহরটার পাঁজরার মধ্যে। পথের দুধারে গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে যেন একসার অপ্রজলিত মশাল, তাদের
বড়ো বড়ো কালো কালো আকৃতিগুলো বাক্যহীনা প্রতীক্ষমাণ। মাটির ওপর স্তব্ধ। ‘আকাশ মেঘে ঢাকা, তারা দেখা যায় না কোথাও, কোথাও ছায়া পড়ছে না। অতিক্রান্ত সন্ধ্যা নামছে বিষণ্ণ, শুদ্ধ। নিদ্রাতুর প্রান্তরের অবসন্ন শুদ্ধতার মধ্যে অস্পষ্ট শোনা যায় শুধু ছেলেটার ধীর- গতি হালকা পদক্ষেপ।
‘ছেলেটার পেছনে পেছনে নিঃশব্দে এগিয়ে আসছে রাত, যে সুদূর থেকে তার যাত্রা, সেই সুদুরের বিস্মৃতির অন্ধকার আবরণের মধ্যে আড়াল নিয়ে।
‘শাদা-শাদা লাল-লাল নিঃসঙ্গ বাড়িগুলো আত্মসমর্পিতের মতো আঁকড়ে ধরেছে মাটি। বাড়িগুলো, বাগানগুলো, গাছগুলো পাহাড়ের ওপর ছড়িয়ে থাকা নিঃসঙ্গ চিমনিগুলোকে উষ্ণ আলিঙ্গনের মধ্যে জড়িয়ে ধরছে আসন্ন প্রদোষ। রাত্রির তামসে বিশ্বস্ত হয়ে কালো হয়ে উঠছে পৃথিবী, অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। যেন দণ্ডধারী এক মূর্তি দেখে মুখ ঢেকেছে তয় পেয়ে, অথবা লুকোচুরি শুরু করেছে তার সঙ্গে।
‘চুপ করে হেঁটে চলেছে ছেলেটা, পদক্ষেপে তার আগের মতোই কোনো তাড়া নেই- হাঁটছে একটা নিঃসঙ্গ ছোট্ট মূর্তি, সামনের শহরটার দিকে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ। যেন দীর্ঘদিন ধরে একান্ত প্রয়োজনীয় যে কিছু একটার জন্যে শহর প্রতীক্ষা করে আছে- তাই বহন করে আনছে ছেলেটা, তার অভ্যর্থনায় আগে থেকেই মিটমিটিয়ে উঠছে শহরের নীল আর লাল আর হলদে আলোগুলো।
‘ডুবে গেছে সূর্য। ক্রশ, আর লৌহ-চূড়া আর হাওয়া-যন্ত্রটা গলে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে। শহরটাকে এখন দেখে মনে হচ্ছে কেমন সংক্ষিপ্ত, গুটিয়ে আসা; নিঃশব্দ মাটির সঙ্গে যেন নিবিড় করে বাঁধা।
‘শহরের মাথার ওপর নেমে এসেছে একটা উপলমণি মেঘ। গায়ে গায়ে জড়াজড়ি করা ধুসর দালান কোঠাগুলোর ওপরে একটা হরিদ্রাভ ভাস্বর কুয়াশা ভাসছে। রক্তে আগুনে বিশ্বস্ত বলে এখন আর মনে হচ্ছে না শহরটাকে। ছাত আর দেয়ালগুলোর অসমান রেখার মধ্যে এখন কি যেন একটা রহস্য, কি একটা অসম্পূর্ণতার আভাস। মনে হয় বুঝি মানুষের বসবাসের এই বিরাট নগরটাকে গড়তে গড়তে কে যেন হঠাৎ ক্লান্ত হয়ে চলে গেছে বিশ্রামে, কিংবা বুঝি বা যেটুকু গড়া হল তা দেখে হতাশ হয়ে সব ফেলে রেখে উধাও হয়ে গেছে, বিশ্বাস হারিয়ে মরেছে।
‘কিন্তু বেঁচে আছে শহরটা। বুকে তার অসহ্য বাসনা, সগর্ব শোভায় সে মাথা তুলবে সূর্যের দিকে। আনন্দের আকাঙ্ক্ষায় প্রলাপের ঘোরে গঙিয়ে চলেছে শহরটা, বাঁচার উদগ্র কামনায় সে চঞ্চল। আর চারপাশের প্রান্তরের অন্ধকার স্তব্ধতার মধ্যে থেকে ভেসে আসে অস্পষ্ট শব্দের মৃদু ধারা, আর আকাশের অন্ধ গহ্বর ক্রমে ক্রমে ভরে ওঠে এক আবছা-অন্ধকার নিরানন্দ আলোয়।
‘ছেলেটা দাঁড়িয়ে মাথা তোলে, তারপর শান্ত সাহসী দৃষ্টি মেলে দূরের দিকে তাকিয়ে পা চালায় জোরে।
আর তার পায়ে পায়ে অনুসরণ করে আসা রাত মায়ের মতো স্নেহকোমল গলায় বলে:
“সময় হয়ে এল রে, চল, চল। ওরা অপেক্ষা করে আছে তোর জন্যে…””
…মুখে একটা চিন্তার হাসি এনে তরুণ সঙ্গীতকার অবশেষে বললে, ‘কিন্তু এরকম সঙ্গীত রচনা করা অবশ্যই অসম্ভব।’
তারপর দুই হাত জোড় করে কেমন একটা কষ্ট আর ভালোবাস।
নিয়ে মৃদু স্বরে বলে উঠল:
‘মেরী মাতা! শহরে গিয়ে কি পাবে ছেলেটা?’
ইতালির রূপকথা (টানেল)
Leave a Reply