মাক্সিম গোর্কি
রোন আর জেনোয়ার মাঝখানে একটা ছোট্ট স্টেশনে আমাদের কামরার দরজা খুলে কণ্ডাক্টর একজন তেলকালিমাখা ‘অয়লার’-এর সাহায্যে প্রায় ধরাধরি করে নিয়ে এল একটা বুড়োকে। বুড়োটার একটা চোখ কাণা।
‘ভয়ানক বুড়ো।’ ওরা বললে একসঙ্গে, অমায়িকভাবে হেসে। কিন্তু দেখা গেল বুড়ো লোকটার জিয়ট আছে বেশ। কোঁচকানো হাতখানা নেড়ে বুড়ো তার সাহায্যকারীদের ধন্যবাদ দিলে, তারপর শাদা মাথাটা থেকে দলামোচড়া টুপিটা একটু তুললে অমায়িক ফুর্তিতে। তীক্ষ্ণ নজর করে বেঞ্চগুলোর দিকে তাকিয়ে বললে:
‘বসতে পারি?’
যাত্রীরা সরে জায়গা করে দিল। স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলে বুড়ো বসল, হাত দুখানাকে রাখলে হাড্ডিসার হাঁটুর ওপর, আর অমায়িক দন্তহীন হাসিতে ফাঁক হয়ে গেল ঠোঁট দুখানা।
আমার সঙ্গী জিগ্যেস করলে, ‘অনেক দূর যাবেন নাকি, দাদু?’ সঙ্গে সঙ্গেই জবাব এল, ‘না, না, এখান থেকে কেবল তিন পৌশন। যাচ্ছি আমার নাতির বিয়েতে…’
নিনিট কয়েক যেতে না যেতেই বুড়োটা সোৎসাহে শোনাতে শুরু বগুলে তার কাহিনী। সে কাহিনীর সঙ্গে সঙ্গত করে চলল ট্রেনের চাকার ছন্দ। আর গল্পের তালে তালে বুড়োটা দুলতে লাগল ঝড়ে ভাঙা ভালের মতো।
বললে, ‘আমি হলাম লিগুরিয়ান। আমরা লিগুরিয়ানরা হলান ভারি শক্ত জাত। আমাকেই ধরো না কেন, আমার তেরোটি ছেলে, চারটি মেয়ে, আর নাতিনাতনী যে কতো তা আমিই জানি না। নাতিদের একটির বিয়ে হয়ে গেছে, এবার এটির হতে চলেছে। মন্দ নয় ব্যাপারটা, কি বলো?’
নিষ্প্রড কিন্তু প্রফুল্ল ওই একখানা চোখ দিয়েই আমাদের সকলের মুখের দিকে সগর্বে তাকাতে তাকাতে বুড়ো মৃদু হাসল। ‘দ্যাখো, আমাদের রাজা আর দেশের জন্যে কতগুলি লোক দিয়েছি আমি!’
‘চোখ নষ্ট হল কি করে? ও, সে গেছে অনেকদিন আগে। আমি তখন এই এতটুকু এক ছোকরা, তখনই কিন্তু বাপের সঙ্গে কাজে লাগতে শুরু করেছি। আঙুর-ক্ষেতের মাটি খুঁড়ছিল বাপ- আমাদের ওদিকের জমি ভারি শক্ত আর পাথুরে, ভারি তোয়াজ করতে হয়- তা মাটি খোঁড়ার সময় বাপের কোদাল থেকে একটা পাথর ছুটে এসে সোজা লাগল আমার চোখে। তখন তেমন ব্যথা লাগল বলে মনে হয়নি। কিন্তু সেই দিন যখন দুপুরের খাওয়া খাচ্ছি, তখন আমার চোখটা খসে এল। সে ভারি ভয়ানক ব্যাপার, সিনোর!… সবাই মিলে তো আমার চোখটাকে ফের বসিয়ে গরম রুটির পুলটিশ লাগিয়ে দিলে, কিন্তু কিসের কি, চোখ আর ফিরল না।’
শিখিল হলদেটে গালটা সজোরে ঘসে নিয়ে আবার সেই অনায়িক ফুতির হাসি হাসলে বুড়োটা।
‘এখনকার মতো সেকালে তো অতো ডাক্তার ছিল না, লোকে বুন্ধুর মতো জীবন কাটাত। হাঁ, বুদ্ধর মতো ঠিকই, তবু হয়ত লোকের প্রাণে দয়ামায়া তখন একটু বেশি ছিল, কি বলো?’
গভীর ভাঁজ পড়া, চামড়া-ঝোলা একচক্ষু মুখখানা তার ছাতা পড়ার মতো সবুজ-ধুসর দাড়িতে ভরা। এই মুহূর্তে সে মুখটার ওপর কেমন একটা চতুর ভাব ফুটে উঠল যেন সে জিতেছে।
‘আমি যতো দিন বাঁচলাম, ততো দিন বাঁচার পর মানুষ-জন সম্পর্কে কি ভাবছি তা বলার একটা হক আসে, না কি বলো?’
যেন কাউকে ধমক দিচ্ছে এমনি ভঙ্গিতে সে একটা গাঢ় রঙের বাঁকা আঙুল তুললে গম্ভীরভাবে।
‘মানুষ-জন সম্পর্কে দুটো কথা শোনাই, সিনোর…
‘আমি যখন তেরো, তখন বাপ মারা গেল, আমি এখন যা দেখতে তার চেয়েও খাটো ছিলাম তখন। কিন্তু চটপটে ছোকরা ছিলাম আমি, আর কাজে লাগলে থামতে জানতাম না। বাপ আমাকে এই গুণটুকুই শুধু ‘দিয়ে গিয়েছিল, কেননা আমাদের বাড়িখানা আর জনিটুকু খতম হয়ে গিয়েছিল দেনার দায়ে। তা এই ভাবেই তো আমি দিন কাটাতে লাগলাম, সম্বল একটি চোখ আর দুটি হাত; যেখানে কাজ পাই সেখানে গিয়ে কাজ করি… কষ্ট বটে কিন্তু জোয়ান বয়স কি আর কষ্ট দেখে ডরার, নাকি বলো?
‘আমার বয়স যখন উনিশ, তখন দেখা হল সেই মেয়েটির সঙ্গে, তাকে ভালোবাসা আনার প্রজাপতির নির্বন্ধ। আমার মতোই মেয়েট। ছিল গরিব, দেখতে পুরুষ্টু, গায়ে আমার চেয়েও জোর। থাকত তার অক্ষম বুড়ি মায়ের সঙ্গে, আমার মতোই যে কাজ জুটত, করত। দেখতে তেমন সুন্দরী ছিল না, কিন্তু মনে দয়ামায়া ছিল, আর ছিল খাসা একখানা মাথা। গলাখানাও ছিল বেশ মিষ্টি। আহ্ গান যা গাইত, একেবারে পেশাদার গাইয়ের মতো। মিষ্টি গলার দান অনেক। আমি নিজেও বেশ ভালো গাইতে পারতাম।
‘ওকে একদিন জিগ্যেস করলাম, “বিয়ে করব না আমরা?” ‘দুঃখ করে ও বললে, “বিয়ে করাটা বোকামি হবে রে একচোখো, তোরও কিছু নেই, আমারও কিছু নেই। খাব কি?”
‘কথাটা একেবারে ন্যায্য কথা। আমাদের কারো কিছু ছিল না। কিন্তু পীরিত হলে জোয়ান মেয়ে মরদের আর চাই কি? জানো তো, পীরিতের কাছে অভাব বলে কিছু নেই। আমি জোরজার, করলাম, করে জিতলাম।
‘শেষকালে আমার ইদা সায় দিলে, “তা তোর কথাই হয়ত ঠিক। আমরা আলাদা আলাদা আছি তাতে যদি মেরী মা আমাদের দেখতে পারেন, তাহলে একসঙ্গে থাকলে তো তাঁর পক্ষে দেখা আরো সোজা!” ‘তাই আমরা তো গেলাম পুরুতের কাছে।
‘পুরুত বললে, “পাগল হয়েছিস! এমনিতেই লিগুরিয়ায় কতো ডিখিরি দেখেছিস? দুঃখী লোক তোরা, তোরা হলি শয়তানের শিকার, শয়তানের প্রলোভন জয় কর। নইলে এ দুর্বলতার জন্যে পরে ভয়ানক খেসারত দিতে হবে!”
‘সমাজের ছোকরারা আমাদের ঠাট্টা করতে লাগল, বুড়োরা নিন্দে করলে। কিন্তু যৌবন হল গে গোঁয়ার, যা বোঝে তা একরকম করে ঠিকই বোঝে। বিয়ের দিন এসে গেল, আগে যা ছিলাম তখনো আমরা তেমনি গরিব। বাসর রাতটুকু যে কোথায় কাটাবো, তারও কিছু ঠিক নেই। ‘ইদা বললে, “চলো যাই মাঠের মধ্যে। কি আছে তাতে? লোকে যেখানেই থাকুক না কেন, মা ভগবতীর কূপা থাকবেই।”
‘আমরা তো তাই ঠিক করলাম, বেশ তাহলে মাটিই হোক আমাদের শয্যা আর আকাশ হোক আমাদের ঢাকনি।
‘তারপরে যে এক আর এক কাহিনী, সিনোর। মন দিয়ে শুনুন একটু, কেননা এই হল আমার এতখানি জীবনের সেরা কাহিনী! বিয়ের ঠিক আগের দিন ভোর বেলা। বুড়ো জিয়োভান্নির ঘরে আমি চের দিন মুনিষ খেটেছিলাম। ভোর বেলা জিয়োভান্নি এসে বিড়বিড় করে বললে যেন ব্যাপারটা তেমন কিছুই নয়:
“উগো, যা ঐ ভেড়ার পুরোনো গোয়ালটা পরিষ্কার করে নিগে যা, কিছু খড় পেতে নে। জায়গাটা শুকনোই আছে, বছর খানেক ধরে ওখানে আর ভেড়া রাখা হয় না; ওখানে তুই আর ইদা যদি থাকতে চাস, তাহলে সব পরিষ্কার করে নিতে হবে কিন্তু।”
‘তা সেই হল আমাদের ঘর!
‘গান করতে করতে আমি ভেড়ার গোয়ালখানা সাফ করছি, এমন সময় তাকিয়ে দেখি, ছুতোর মিস্ত্রি কনস্তানজিয়ো দাঁড়িয়ে আছে দোর গোড়ায়।
“তুই আর ইদা তাহলে এখানেই ডেরা বাঁধছিস? কিন্তু বিছানা কই তোদের? আমার বাড়িতে বাড়তি একখান বিছানা আছে। ঘর সাফ হয়ে গেলে এসে নিয়ে যাস।”
কনস্তানজিয়োর কাছে যাচ্ছি এমন সময় মুখফোড় দোকানী মেয়ে মারিয়া গাল পাড়তে লাগল:
“বিয়ে করছে দেখো হাঁদাগুলো, অথচ নিজের বলতে না আছে একখান বালিশ, না আছে একটা চাদর! মাথা খারাপ হয়েছে একচোখোটার, তোর কনেকে পাঠিয়ে দিবি আমার কাছে…”
‘ওদিক থেকে খোঁড়া এত্তোরে ভিয়ানো, বাতে আর অসুখে সারা জীবন ধরে ভুগে আসছে, সেই ভিয়ানো তার বাড়ির দরজা থেকে দোকানীকে চেঁচিয়ে বললে:
“নেনস্তন্যের জন্যে কতো মদ জোগাড় করে রেখেছে সেই কথাটা একবার জিগ্যেস করে দেখো ওকে? আচ্ছা বেহিসেবী লোক বটে বাপু!””
বুড়ো মানুষটার গালের গভীর একটা খাঁজের ওপর চিকচিক করে উঠল উজ্জ্বল এক ফোঁটা অশ্রু। মাথাটা পেছনে হেলিয়ে নিঃশব্দে হাসলে বুড়ো, হাড় খোঁচা গলকণ্ঠটা উঠানামা করতে লাগল, কাঁপতে থাকল শিথিল চামড়াগুলো।
হাসিতে দম আটকে ছেলেমানুষী খুশিতে হাত নাড়তে নাড়তে ও বললে, ‘ও সিনোরি, সিনোরি! কি বলব, বিয়ের দিন সকালে ঘরে যা যা দরকার সব এসে গেল- মাডোনার একটা মূর্তি, ডিশ, কাপড়চোপড়, আসবাব, দিব্যি করে বলছি, সব কিছু। ইদা যত হাসে তত কাঁদে। আমিও তাই। অন্য সবাই অবশ্য শুধুই হাসল, কেননা বিয়ের দিন কাঁদতে নেই- আর আমাদের যতো আপনার লোক সব ঠাট্টা করতে লাগল আমাদের।
‘সত্যি সিনোরি, লোক জনকে আপনার লোক বলে ডাকতে পারা যে কি সুন্দর! নিজের আত্মীয় কুটুম্ব বলে ভাবতে পারলে তো আরো ভালো; এই হল সব লোক, দেখুন, আমার জীবনটা তাদের কাছে তামাযার ব্যাপার নয়, আমার সুখ সুবিধাটা জুয়া খেলার মতো নয়!
‘আর যে কি একখান বিয়ে। সে কি দিন। গাঁয়ের গোটা সমাজ এল অনুষ্ঠানে, সকলেই এল আমাদের সেই ভেড়ার গোয়ালে, হঠাৎ সেটা একেবারে মটালিকার মতো হয়ে উঠেছে… সব কিছু পেরে গিয়েছিলাম আমরা! মদ আর ফল, মাংস আর রুটি, সকলেই খেতে লাগল, সকলেই হাসিখুশি… তার কারণ সিনোরি, লোকের উপকার করার চেয়ে বড়ো সুখ আর কিছু নেই, সত্যি বলছি শুনুন, তার চেয়ে চমৎকার, তার চেয়ে সুন্দর আর কিছু হতে পারে না!
‘পুরুতও এসেছিলেন। ভারি সুন্দর একখানা ভাষণ দিয়েছিলেন তিনি। বললেন, “এই দুটিতে তোমাদের সকলের বাড়িতে কাজকর্ম করেছে, তোমরাও তাদের এই দিনটাকে সেরা দিন করে তোলার জন্য যথাসাধ্য করলে। এইটেই উচিত। কেননা ওরা তোমাদের জন্য খেটেছে আর খাটুনির দাম তামার পয়সা রূপোর টাকার চেয়েও বেশি, খাটুনির জন্যে যে মজুরি পাওয়া যায়, তার চলে যায়, কিন্তু থেকে যায় খাটুনিটা চেয়েও অনেক বেশি। টাকা এই দুটি মানুষ হাসিখুশি, বিনয়ী। ওদের জীবন কষ্টে কেটেছে কিন্তু তার জন্যে ওরা নালিশ করেনি, ওদের জীবনে আরো কষ্ট আসবে কিন্তু তার জন্যে ওরা গজ গজ করবে না। ওদের দরকারের সময় তোমরা সাহায্য কোরো। ওদের কাজের হাত ভালো, দিল দুখানা আরো ভালো …”
‘আমাকে আর ইদাকে আর গোটা সমাজকে প্রশংসা করে আরো অনেক কথা বলে গেলেন পুরুত।’
বুড়োর এক চোখের দৃষ্টি আবার যেন তরুণ হয়ে উঠেছে। সেই চোখে আমাদের সকলকে সগর্বে একবার নজর করে দেখে বললে: ‘এই হল গে সিনোরি, লোক সম্পর্কে কিছু কথা, তা তোমাদের শোনালাম। ভারি ভালো ঘটনাটা। না কি বলো?’
Leave a Reply