মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন।
মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে।
তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু।
তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক
ধানমন্ডির একটা বড় রাস্তার কোল ঘেঁষে খোকাদের বাড়ি। মহম্মদপুরগামী বাসে ঈদগা অথবা মধুবাজার স্টপেজে নামলেই কয়েক পা হেঁটে তাদের বাড়িতে পৌঁছানো যায়।
বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে দূর থেকে নিজেদের বাড়ির গাড়ি বারান্দার ছাদে হুমড়ি খেয়ে পড়া বোগোনভিলিয়ার খুনখারাবি দেখতে পায় খোকা। ইউলিসিসের সমুদ্রগামী জাহাজ, মাসুলের মতো খাড়া ইউক্যালিপটাস গাছটা দেখে তাই মনে হয় এখন। কাতানের ফুরফুরে পাঞ্জাবি আর ধবধবে পায়জামায় ফিটফাট বাবুটি সেজে বেবিট্যাক্সির জন্যে অপেক্ষা করতে করতে সবকিছু কেমন নির্ভার মনে হ’লো খোকার।
আজ চারদিন পর ঘর থেকে বের হয়েছে সে। হয়তো বহু কিছুই ঘাটে গিয়েছে সারাদেশে। রাজনৈতিক সঙ্কট তো আছেই, তার ওপর চতুর্দিকে হাজার রকমের ডামাডোল। জাহাজ বোঝাই সৈন্য চট্টগ্রামের দিকে ছুটে আসছে, বেলুচিস্তানে ঈদের জামাতের ওপর বোমা দাগানো কসাই টিক্কা খান আসছে নতুন পাট-বাহাদুর হ’য়ে; দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার, ছবি, তবু এসবের কোনো গুরুত্ব খোকার কাছে নেই। রাজনীতির ব্যাপারটাই আগাপান্তলা একটা জমকালো ছেনালী; একজন শিক্ষিত নাগরিকের দায়িত্ব সম্পর্কে তার পুরোপুরি ধারণা থাকলেও ভোটার লিস্টে সে তার নাম তোলেনি। রাজনীতির ব্যাপারটা তার কাছে শিকার ফসকাতে না দেওয়া হুবহু সেই মাদামোয়াজেল ব্লাঁশের মতো।
কিন্তু যাওয়া যায় এখন কোন্ দিকে? কাজের অছিলায় তো বের হওয়া গেল, খোকা লক্ষ্য স্থির করতে করতে ভাবলো–আপদ আর কি, ভরা দুপুর এখন, রেক্সে গেলে একটা আড্ডা চলতে পারে, আড্ডা চলতে পারে গোপীবাগে ইয়াসিনের ওখানে। ইছাপুরায় তার কলেজ বন্ধ থাকায় দেদার মিটিং শুনে বেড়াচ্ছে ছোকরা; কথা বলার মানুষ পেলে ভরদুপুরে একটা হিল্লে হবে ওর। আর যাওয়া যায় রাজীব ভাইয়ের ওখানে, অবশ্য রাজীব ভাইকে এই সময় পাওয়া দুষ্কর; কুমিরের চামড়ার একটি ব্যাগ বগলদাবা ক’রে রাজীব ভাই নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও বেরিয়ে গিয়েছে। আর কেউ না থাকুক নীলাভাবী আছে: শোরগোলের পর আর ওদিকে যাওয়াই হয়নি খোকার।
মুরাদের ওখানে গেলে কি হয়। মুরাদকে সঙ্গে নিয়ে তারপর ইয়াসিনের ওখানে টু মারা চলে।
খোকা স্পষ্ট বুঝতে পারে এই মুহূর্তে নীলাভাবীর দখলে চ’লে গিয়েছে সে, হাতপা ছেড়ে দিয়ে ভেসে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই তার। সত্যি, আশ্চর্যের কথা, নীলাভাবীর জন্যে আজকাল আর অকারণে তার মন আকুল হয় না; যেন অভাবনীয় একটি বই, প্রথম কয়েকটি পাতা পড়ার পরই দুর্মদ কৌতূহল সামলাতে না পেরে অধৈর্য পাঠকের মতো সে শেষটা প’ড়ে ফেলেছে।
Leave a Reply