মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন।
মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে।
তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু।
তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক
বেরুবার আগে মুখ কালো ক’রে ফেলেছিল রঞ্জু। বলেছিলো, ‘না বেরুলে চলে না?’
‘তোর অসুবিধেটা কি?’
‘আমার ভয় করে। পাড়াটা কেমন থমথমে হ’য়ে আছে–‘
একবার মনে হ’লো খোকার, থাক, কোথাও গিয়ে কাজ নেই; কিন্তু ঘরে ফেরাও এই মুহূর্তে তার পক্ষে অসম্ভব। সমস্ত ব্যাপারটা খোকার কাছে নিছক খেয়ালখুশি চরিতার্থ করার মতো কিছু একটা মনে হয়, মিছিলের মানুষগুলোর মুখে দুরারোগ্য অসুস্থতার অক্ষর পড়তে থাকে সে। কোনো স্তরের মানুষের সঙ্গেই আমার কোনো সম্পর্ক নেই, কেমন একটু ভিন্নধাতে গড়া আমি–খোকা মনে মনে নিজেকে সামাল দিতে থাকে, কি ঘটছে না ঘটছে আমি তার কোনো তোয়াক্কাই করি না, অথচ ফুটপাতের পানওয়ালা থেকে মাটিকাটা কামলারাও কমবেশি কিছু না কিছু বলতে সক্ষম; সময় বদলে দেয় মানুষকে, অথবা মানুষই কান মুচড়ে চাঙ্গা ক’রে তোলে প্রাণশক্তি-বিবর্জিত নির্বীজ সময়কে, এবং আমি কোনো কিছুর ভিতর নেই। দেশ, দেশের কল্যাণ, দেশের ভবিষ্যৎ, দেশপ্রেম, এসবের মাথামুণ্ডু কিছুই তার মগজে ঢোকে না।
এইসব ভজকট ব্যাপারে নিরর্থক অপচয়িত না হ’য়ে বরং শিথিল আলসেমির ভিতর ডুবে থাকা ঢের ভাল, অন্তত নিরাপদ তো বটেই। রিকশার হাওয়া ছেড়ে দেওয়া, বাসে আগুন ধরানো, পুলিশের গায়ে ইট মারা, দেশের প্রতি নিজের প্রগাঢ় অনুরাগকে তুলে ধরার এতো অসংখ্য তীব্র ও আকর্ষণীয় পথ চারপাশে ছড়ানো থাকলেও কখনোই সে সুনিশ্চিত কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারে না, আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা তার হাত-পা। পঁয়ষট্টি সালের যুদ্ধের সময় চোর-ছ্যাঁচড় গাঁটকাটারাও ফৌত হ’য়ে হাতপা গুটিয়ে বসেছিলো, দেশপ্রেমের চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলো ব্যাটারা; কেউ কারো পকেট কাটেনি, চুরি-ডাকাতি-রাহাজানি বিলকুল বন্ধ ছিলো, সময় গিয়েছে একটা। রাজনৈতিক সঙ্কট কি নতুন কোনো ব্যাপার, শয়তানি আর বজ্জাতি কবে গা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পেরেছে মানুষ। মানুষ, অর্থাৎ শয়তানের সুযোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী, সে কখনো তোমাকে বাছা ব’লে হাতে তুলে খাঁটি ছানার রসগোল্লা খাওয়াবে না; যদি গেলাতে চায়, তার আগেই সাবধান হ’তে হবে।
খোকার ভিতরে একটা বিশাল মাঠ ধু-ধু ক’রে জেগে উঠলো, সেখানে লোলচর্ম নীতিবাগীশদের চিড় খাওয়া কবর; কিংবা ঠিক তাও নয়, সে স্বস্তি পায় বিরোধিতায়, এটা তার এমনই একটি আত্মনিমগ্ন স্বভাব যার মর্মোদ্ধার কোনোদিনই সে করবে না। খোকা জানে আর পাঁচজনের মতো গড্ডলিকা প্রবাহে ভেসে যাওয়া তার পক্ষে কোনো- মতেই সম্ভব নয়। ট্যানারি শ্রমিকরা রাজনীতির বোঝেটা কি, গিনিপিগ এক একটা। হাতের কবজিতে যারা সর্দি মোছে, এখনো যাদের পা গড়িয়ে পেচ্ছাব পড়ে, সেইসব হাফপ্যান্ট পরা ইস্কুলের গালটেপা ছেলেরাও চৌরাস্তার মোড়ে মোড়ে দীক্ষা দিচ্ছে। কোথায় আমেরিকা কোথায় চীন আর কোথায় ফৈজুদ্দিন ব্যাপারি প্রাইমারী স্কুলের লালট- মার্কা ছেলে; কোন অন্ধকারে ব’সে কে বিধাতার মতো কলকাঠি নাড়ছে ওরা তার সবকিছু বোঝে।
Leave a Reply