শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৫:৫০ পূর্বাহ্ন

জীবন আমার বোন (পর্ব-৯)

  • Update Time : শুক্রবার, ২৪ মে, ২০২৪, ১২.০০ পিএম

মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন। 

মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে। 

তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু। 

তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক

মাহমুদুল হক

বেবিট্যাক্সি থেমেছিলো হাত তোলা দেখে, তাতে চ’ড়ে বসলো সে। আপাতত সুনির্দিষ্ট কোনো গন্তব্য নেই, পালে যখন হাওয়া লেগেছে কোথাও না কোথাও গিয়ে ঠিকই ভিড়বে।

রমনা গ্রীন আর রেসকোর্সের মাঝের রাস্তার সেগুনবীথিতে মড়ক লেগেছে, পাতাগুলো ঝল্ল্সে যাচ্ছে, ন্যাতাকুডুনি, পাতা-কুড়ুনি ফ্যাল্লা মেয়েরা জাফরি কাটা ছায়ায় কেউ আসন-পিড়ি হ’য়ে কেউ ঠ্যাং ছড়িয়ে বাসে চুলে বিলি কেটে উঁকুন খোঁটাখুঁটিতে মশগুল। মাঠটাকে খোকার মনে হয় দুপুরবেলায় ঝল্ল্সে ওঠা সবুজপানায় ভরা একটা মস্ত দীঘি। কালিবাড়ি যেন শিয়ালমুখো আনুবিস; দীঘির দাম ফুঁড়ে মুখ তুলে রেখেছে, পারলৌকিক যাত্রায় গোটা শহরের আত্মাকে সে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিট্যুট পার হ’য়ে ডানে বাঁক নেওয়ার পর খোকার মনে হয় সারিবদ্ধ অশ্বথের বিপন্ন ডালগুলো ঝাঁ-ঝাঁ রৌদ্রে হাহাকার করছে। পিচ গলছে। সারা রাস্তার গায়ে ঝরাপাতা আঠার মতো লেপ্টে আছে, যেন অতিকায় চিতাবাঘের গায়ে ডাঁ ডাঁ ক’রে উঠছে এক প্রবল পরাক্রান্ত ক্রোধান্ধ দুপুর।

গণ্ডারের মতো দুপুর, ছ্যাকড়ামার্কা ঝরঝরে বেবিট্যাক্সির ঝাঁকুনি, চরম মানসিক বিশৃঙ্খলা, সবকিছু একজোট হ’য়ে ভিতরে ভিতরে রহস্যময় দিগদর্শনের কাজ করে, ‘বেবি, সেগুনবাগিচা’ ফশ ক’রে মুখ থেকে বেরিয়ে যায় খোকার।

আবার সেই সেগুনবাগিচা। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চ’লে যাচ্ছি ক্রমাগত, আমি খোকা, কতো কুকাণ্ডের যে পাণ্ডা, একজন পাজীর পা ঝাড়া; স্রেফ বাইরেই মনোরম প্লাস্টিক পেন্ট, ভিতরের সব দেয়াল নোনাধরা, চটা ওঠা, খাস্তা, উত্তাল তরঙ্গময় সামুদ্রিক বিছানায় উপুড় হ’য়ে পড়েছিলাম, ফেননিভ একটি শরীর মুহুর্মুহু তোলপাড় করছিলো বিছানায়, – এইভাবে খোকার যাবতীয় স্মৃতি মাংসাশী হ’য়ে যায়, সেখানে আতশবাজির ধুম শুরু হয়, উত্তেজনা যত তীব্র তত মধুর, যত মধুর তত অপবিত্র, অপবিত্রতা ইহলোকে যৌবনদান করে আমাদের, জাহাজের মতো বন্দর থেকে বন্দরে ভাসিয়ে নিয়ে যায় এই যৌবন।

এইসব মনে হয় খোকার। খোকা এও জানে, টাইটানিক যে জাহাজ, একদিন ভরাডুবি হয় তারও।

ভিজে কুকুরের মতো গা থেকে কাদা ঝাড়তে থাকে এক ধরনের অনুভূতি; অপরাধবোধ সম্পর্কে তার ধারণা খুব একটা স্বচ্ছ নয়, কেবল এই অনুভূতির আলগা স্পর্শে অল্পবিস্তর সঙ্কুচিত হ’য়ে পড়ে সে। আমাদের ভিতরে যে কতো প্রবল মানুষের আস্তানা পাতা, যারা প্রায় সকলেই অচেনা, কখন যে কার করায়ত্ত আমরা, ইহকালে তা জানা যাবে না কখনো, আগেও ভেবেছে খোকা এসব। যে স্তন দৃপ্ত খেলো- য়াড়ের হাতের বল হ’তে চায়, দন্তক্ষতের মালা জড়াতে চায়, নির্বোধ শিশুর ঠোঁটে তা অমন উগ্র অথচ মধুর হয় কিভাবে, খোকার মাথায় তা খেলে না; তার শুধু মনে হয়, একা নই, কেউ-ই আমরা একা নই।

 

জীবন আমার বোন (পর্ব-৮)

জীবন আমার বোন (পর্ব-৮)

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024