শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২:৩৯ অপরাহ্ন

জীবন আমার বোন (পর্ব-১০)

  • Update Time : শনিবার, ২৫ মে, ২০২৪, ১২.০০ পিএম

মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন। 

মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে। 

তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু। 

তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক

মাহমুদুল হক

দুপুরে সামান্য একটা গা ঢেলে দিয়ে বিছানায় নিছক আরাম ক’রে বসার সূত্র থেকে কত বড় অঘটনই না ঘটতে পারে। ঝপ ক’রে, যেন কারো হাত ফস্কে প’ড়ে গিয়েছিলো এক সুগোল স্বপ্নের ইঁদারায়, যেখানে নিজের কণ্ঠস্বর ঠাণ্ডা-হিম পলেস্তারার গায়ে পাক খেয়ে শঙ্খিল গতিতে ব্যর্থই প্রতিধ্বনিত হয়। হাঁসফাঁস করতে থাকে খোকা। বহুদিন আগে গাছ থেকে খ’সে পড়া একটা ঝুনো নারকেল সে, গরু-ছাগল মুতে ভাসানো মাটিতে প’ড়ে আছে, একটা ফোঁপল সন্তর্পণে ধীরে ধীরে প্রাকৃতিক নিপুণতায় চাপ দিচ্ছে ভিতরে। খোকা যেন একটা নিরেট জগদ্দল গুণ্ডার নাম। বডি বিল্ডার খোকা, ন্যূইয়ার্স ডে-তে বলরুমের শ্যান্ডেলিয়ার ওয়ালথার পিপিকের গুলিতে চূর্ণ-বিচূর্ণ ক’রে হোটেল ইন্টারকন কালো র‍্যাপারে ঢেকে দিয়েছিলো খোকা, খোকা গুণ্ডা, গুণ্ডা আর কোন্ড ব্লাড মার্ডারার। রাক্ষুসে আকাশ থেকে বস্তার মুখ খুলে রাশি রাশি ধাতব মুদ্রা ঢেলে দিচ্ছে কেউ মাথার উপর, কানের পাশে বৃষ্টির মর্মান্তিক কলরোল, ভয়ঙ্কর এবং প্রচণ্ড, কানে তালা লেগে যায় খোকার।

কি বিশ্রী কি জঘন্য এই নামটা! তার আসল নাম অর্থাৎ জাহেদুল কবির এই খোকা নামের আড়ালে ঢাকা প’ড়ে যায় বারবার। ভোজবাজির মতো এমনভাবে শিকড় গেড়ে গ্যাঁট হ’য়ে আছে নামটা, যে, কখনো তার মূলোচ্ছেদ সম্ভব নয়। তলে তলে বজ্জাতি আর নষ্টামির শক্ত বর্মের কাজ করে এই নামটা। নাম তো নয়, একটা বিষের ভাঁড়। ‘ক্ষুদ্র মাকড়সা নিজ হইতে সুতা ও জাল সৃষ্টি করিতে সমর্থ, সৎ সেরূপটি পারেন না, যদি সৎ নিজেকে বিকৃত না করেন তবে সৃষ্টি হয় না’ খোকার ভিতরের ঘোঁট পাকানো ঝড়ে তুশ ভুশ ক’রে ধুলো উড়তে থাকে; জোড়া ঘোড়ার চালে প’ড়ে মার খাচ্ছে এবার। ছেঁড়া কাগজের মতো ফরফর ক’রে উড়তে থাকে খোকা; যৌবন এমন ক্ষমাহীন কেন, সে শুধু তার আপন অধিকার খুঁজে বেড়ায়, এক অসতর্ক মুহূর্তে অন্যায়েরও একটা অধিকার আবিষ্কার ক’রে ফেলে সে।

কি ভাবে নীলাভাবী এখন, জেনে দেখলে কি হয়, নীলাভাবীর উত্তরটা কি ধরনের হবে? আর যদি ধ’রে নেয় একজন লম্পট কামাচারী নিছক কূট উদ্দেশ্য হাসিল করার ফিকির এঁটে নতুন ক’রে উস্কে দিচ্ছে, তাহলে উল্টো বিপদ। ঠিক সেইদিন থেকে তার মানসিক স্থৈর্যের পাট ভাঙ্গা লাট খাওয়া অবস্থা যেদিন সামান্য একটু আঙ্কারা পেয়ে নীলাভাবীর সারা বয়েস দু’হাতে ঘাঁটাঘাঁটির পর একেবারে তছনছ ক’রে দিয়েছিল সে, এবং খোকা খুব ভালো ক’রেই জানে, এসব অন্য কারো বোঝার ব্যাপার নয়; যেমন নীলাভাবী। সেদিন সেই আকস্মিক ছন্দপতনের পরও বিন্দুমাত্র তারতম্য ঘটেনি নীলাভাবীর চলনে-বলনে, খোকার মনে হয়েছে এক অপ্রত্যাশিত নিপুণতায় সমানে সূক্ষ্মতর ভারসাম্যও রক্ষা ক’রে চলেছে নীলাভাবী।

নিজেকে লাগসই ক’রে মানিয়ে নেওয়া, নিজেকে ঠেলেঠুলে চালিয়ে নেওয়ার ভিতর আড়ষ্টতা না থাকাটাই সম্ভবত বাহ্যিক পরিচ্ছন্নতা, নিদেনপক্ষে এই ধরনের একটা হালকা সাদা প্রবোধ খাড়া ক’রে স্বস্তির উৎসমুখের দিকে যায় খোকা; জেলি-ফিশের মতো এই থলথলে মেরুদণ্ডহীন স্বস্তির গায়ে থুথু ছিটিয়ে কোনো লাভ নেই, দুর্গন্ধময় হাজতের ঘুটঘুটে অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসতে চায় খোকা, তোমরা যারা আমার পরাক্রান্ত প্রতিদ্বন্দ্বী তাদের উদ্দেশ্যেই বলা: পৃথিবীর সকল নীলাভাবীরাই এক একটি জ্বলন্ত কামকুণ্ড, ফুটন্ত টগবগে আগ্নেয়গিরি, যার নিদারুণ লাভাস্রোতে পীত ধবল কালো বাদামী রাশি রাশি খোকার দগ্ধাবশেষ গড়ান খেয়ে চলে।

 

জীবন আমার বোন (পর্ব-৯)

জীবন আমার বোন (পর্ব-৯)

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024