শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৮:৩১ পূর্বাহ্ন

ইতালির রূপকথা (কর্মী)

  • Update Time : শনিবার, ১৮ মে, ২০২৪, ৮.০৮ পিএম

মাক্সিম গোর্কি

বসন্তকাল। উজ্জ্বল সূর্য। সকলেই বেশ হাসিখুশি। পুরনো পুরনো পাথুরে বাড়িগুলোর জানলা পর্যন্ত যেন হাসছে বলে মনে হয়।

ছোট্ট শহরখানার রাস্তা জুড়ে আসছে এক রঙীন জনস্রোত — পরনে তাদের পরব-দিনের পোষাক। সারা শহর এসে জুটেছে এখানে, মজুর, সৈন্য, ব্যবসায়ী, পুরোহিত, সরকারী অফিসার, জেলে- সকলেই, বসন্তের সুরায় সকলেই একটু মাতাল, কথা বলছে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে, হাসছে, গান গাইছে, আর সকলেই যেন এক সূত্রে মিলে ফেটে পড়ছে জীবনের আনন্দে।

মেয়েদের রঙীন টুপি আর ছাতা, আর ছেলেদের হাতে হাতে লাল নীল বেলুনগুলো- সবই মনে হয় অদ্ভুত কি এক ফুলের মতো। “রূপকথার এক রাজার জমকালো পোষাকের ওপর গাঁথা দামী দামী মণিমুক্তোর মতো সর্বত্রই ঝলমলিয়ে উঠছে হাস্যময় সেই শিশুরা – যারা এ পৃথিবীর আনন্দময় রাজা।

গাছের বিবর্ণ সবুজ পাতা এখনো ফোটেনি, শক্ত কোরকের বাঁধনে বাঁধা, সূর্যের গরম রোদ তারা পান করছে লোভীর মতো। দূরে কোথায় সুর বাজছে আমন্ত্রণ জানিয়ে।

মনে মনে ধারণা হয়, মানুষের দুঃখ কষ্ট বুঝি বা এক অতীতের কাহিনী, যেন যে-কষ্টের জীবন মানুষ এতকাল সয়ে এল তার অবসান হয়ে গেছে গতকাল, তারপর আজকে সকলেই জেগে উঠেছে শিশুর মতো এক হালকা মন নিয়ে, সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাবার মতো এক অদম্য ইচ্ছাশক্তির ওপর খুঁজে পেয়েছে তাজা এক ভরসা আর এখন বিশ্বাস ভরে পা মিলিয়ে চলেছে ভবিষ্যতের দিকে।

এই সজীব জনস্রোতের মধ্যে লম্বা শক্ত-সমর্থ চেহারার একটা লোকের করুণ মুখ দেখে অবাক লাগল, দুঃখ হল। একটি যুবতীকে বাহলগ্না করে লোকটা হেঁটে যাচ্ছিল। বয়স তার তিরিশের বেশি হতে পারে না, কিন্তু মাথার চুল পেকে গেছে। টুপিটা হাতে ধরা, গোল রূপোলী মাথাখানা অনাবৃত। পাতলা স্বাস্থ্যবান মুখখানা শান্ত, তবু দুঃখের ভাব ফুটে উঠেছে সেখানে; বড়ো বড়ো কালো চোখ দুটো পল্লবে আধো-ঢাকা, সে চোখ এমন একজনের যে অবিস্মরণীয় এক যন্ত্রণা পার হয়ে এসেছে।

বন্ধু বললেন, ‘ঐ দুটিকে দেখুন, বিশেষ করে পুরুষটিকে। ট্রাজেডির জীবন ওর, এ ট্রাজেডি উত্তর ইতালীর শ্রমিকদের মধ্যে ক্রমেই বেশি করে দেখা যাচ্ছে।’

তারপর বন্ধু আমাকে তার গল্পটা শোনালেন। বললেন:

ঐ লোকটা একজন সোশ্যালিস্ট, স্থানীয় একটি শ্রমিক পত্রিকার সম্পাদক। নিজেও একজন শ্রমিক, বাড়ি রঙ করার কাজ করে। সেই জাতের লোক, যাদের কাছে জ্ঞানের অর্থ হল বিশ্বাস, আর বিশ্বাসের অর্থ জ্ঞানপিপাসার আরো বৃদ্ধি। ভয়ানক গির্জা-বিরোধী, বুদ্ধিমান। ঐ দেখুন না, কালো পোষাকের পুরোহিতেরা ওর দিকে কি রকম ভ্রুকুটি করে তাকাচ্ছে।

বছর পাঁচেক আগে তার সঙ্গে একটি মেয়ের দেখা হয় পাঠচক্রের জাগরে। মেয়েটি তার মনোযোগ আকর্ষণ করে। লোকটি ছিল পাঠচক্রটার নেতা ও প্রচারক। এ অঞ্চলের মেয়েদের মধ্যে একটা অন্ধ অবিচলিত ঈশ্বরবিশ্বাসের শিক্ষা আছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে পুরোহিতেরা এদের এই শিক্ষাই দিয়ে এসেছে, এবং তাতে সফল হয়েছে। কে যেন বলেছেন না, ক্যাথলিক গির্জা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে মেয়েদের বুকের ওপর, সে কথা অত্যন্ত ঠিক। মাডোনার যে ধর্মমত সেটা যে শুধু প্রতিমাপুজার অর্থেই সুন্দর তা নয়, মতবাদ হিসেবেও বেশ চতুর। খ্রীষ্টের চেয়ে মাডোনা অনেক সহজ। মাডোনার আবেদন বুকের অনেক কাছে। তার মধ্যে নেই কোনো মানসিক দ্বন্দ্ব, না আছে নরকের ভয়। মাডোনার সবখানিই হল ভালোবাসা, অনুকম্পা আর ক্ষমা। চিরজীবনের মতো মেয়েদের অন্তঃকরণ জয় করে নেওয়া মাডোনার পক্ষে সহজ।

কিন্তু পাঠচক্রের ঐ তরুণী মেয়েটি বলতে কইতে পারত বেশ, প্রশ্ন জিগ্যেস করত। লোকটা টের পেত সে প্রশ্নের মধ্যে শুধু যে লোকটার মতবাদ সম্পর্কে একটা সরল বিস্ময় প্রকাশ পাচ্ছে তাই নয়, প্রকাশ পাচ্ছে তার সম্পর্কে একটা অবিশ্বাসও, প্রায়ই সে অবিশ্বাসের সঙ্গে মিশে থাকছে ভীতি এমন কি তীব্র বিরূপতা। ধর্ম সম্পর্কে ইতালিয়ান কর্মীদের অনেক কিছু বলতেই হয়, এবং পোপ আর ধর্মযাজকদের সম্পর্কে কড়া কথাও শোনাতে হয় প্রায়ই। আর যতোবার যে এই সব কথা বলেছে, ততবারই তার নজরে পড়েছে মেয়েটির চোখে ফুটে উঠছে ওর সম্পর্কে ঘৃণা আর বিদ্বেষ। মেয়েটি যদিবা প্রশ্ন করেছে তো সে প্রশ্নে বিদ্বেষের সুর বেজেছে আর বিষ ঝরেছে তার কোমল কণ্ঠস্বরে। সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে ক্যাথলিক যে সব সাহিত্য আছে, বোখা যেত সে সব তার ভালোই জানা, এবং পাঠচক্রে যেয়োট যা যা বলত, তা লোকে কম মনোযোগ দিয়ে শুনত না।

এখানে, এই ইতালীতে, মেয়েদের সম্পর্কে পুরুষদের যা মনোভাব সেটা রুশের চেয়েও অনেক স্কুল, এবং তাঁর জন্যে ইতালিয়ান মেয়ের। নিজেরাই অনেকাংশে দায়ী- অন্তত অল্প কিছু দিন আগে পর্যন্ত এই অবস্থা ছিল। গির্জা ছাড়া যার কোনো কিছুতে তাদের আগ্রহ নেই, পুরুষদের সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে তারা বড়ো জোর নিস্পৃহ, তার বেশি কিছু নয়, এবং এ সব ক্রিয়াকলাপের তাৎপর্য তাঁদের কাছে বোধগম্য নয়।

আমার বন্ধুর পৌরুষে যা লাগল, এই তরুণীটির সঙ্গে দ্বন্দ্বে দক্ষ প্রচারক হিসাবে তার খ্যাতি ক্ষুণ্ণ হতে শুরু করল। মাঝে মাঝে ধৈর্যচ্যুত হয়ে পড়ত সে, বেশ কয়েকবার বিদ্রূপ করে সে মেয়েটির যুক্তি উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করলে, কিন্তু মেয়েটিও সমান তালে জবাব দিয়ে তার অনিচ্ছক শ্রদ্ধা আদায় করে ছাড়লে; মেয়েটির পাঠচক্রে পড়াবার আগে ভালো করে তার বক্তৃতা তৈরি করে আসতে লোকটি বাধ্য হল।

তা সত্ত্বেও লোকটার নজরে পড়ল, যখনই সে বর্তমান জীবনের কদর্যতার কথা বলত, বলত কি করে এ জীবনে মানুষ নিপীড়িত হচ্ছে, কি করে তার দেহমন পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে, অথবা যখনই সে ভবিষ্যৎ একটা জীবনের ছবি তুলে ধরত, মানুষ যেখানে দেহে মনে মুক্তি পাবে, তখনই তার প্রতিদ্বন্দিনীর মুখে চোখে খেলে যেত একটা আশ্চর্য পরিবর্তন। মেয়েটি সে কথা শুনত জ্বালা নিয়ে, সে জালা বুদ্ধিমান আর সবল। এক নারীর সে জ্বালা, যে জানে জীবনের শেকল কি কঠিন; অথবা শুনত শিশুর মতো উৎসুক এক বিস্ময় নিয়ে, যেন শুনছে একটা আশ্চর্য রূপকথার কাহিনী, তারই নিজের মন্ত্রমুগ্ধ জটিল আয়ার সঙ্গে সে কাহিনীর যেন ভারি মিল।

এ থেকে লোকটার মনে আশা হল, শেষ পর্যন্ত হয়ত প্রতিদ্বন্দ্বিনীকে জয় করা যাবে, চমৎকার এক কমরেড হতে পারবে মেয়েটি।

প্রতিযোগিতা চলল প্রায় বছর খানেক ধরে কিন্তু কারো মধ্যেই আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে অন্তরঙ্গের মতো বিতর্ক চালাবার ইচ্ছা জাগল না। শেষ কালে লোকটিই যেচে এল মেয়েটির কাছে। বললে:

‘সিনোরিনা, আপনি তো আমার চির প্রতিদ্বন্দী। আপনার কি মনে হয় না, কাজের দিক থেকে ভালোই হবে যদি আমরা পরস্পরকে আরো ভালোভাবে জানি?’

সানন্দে সায় দিলে মেয়েটি এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ঠোকাঠুকি লাগল। উত্তেজিতভাবে মেয়েটি গির্জাপ্রতিষ্ঠানের পক্ষ নিয়ে বললে, লেখানেই মানুষের তাপিত আত্মার শান্তি, করুণাময়ী মাডোনার কাছে। সবাই সমান, যে যা পোষাক পরেই আসুক না কেন, সকলেই সমান অনুকম্পার যোগ্য। প্রতিবাদ করে লোকটি বললে, মানুষের যা দরকার সেটা শান্তি নয় সংগ্রাম, বৈষয়িক সুখসুবিধার সাম্য ছাড়া সামাজিক সাম্য অসম্ভব, এবং মাডোনার পেছনে লুকিয়ে আছে এমন সব লোক যাদের স্বার্থ হল মানুষকে অসুখী ও অজ্ঞান করে রাখা।

তদবধি ওদের জীবন ভরে উঠল এই সব বিতর্কে। একই উত্তেজিত বিতর্কের জের চলল প্রতিটি সাক্ষাৎকারেই, এবং দিনদিনই পরিষ্কার হয়ে উঠতে লাগল দুজনের দুই বিশ্বাসের মধ্যে মিল একান্ত অসম্ভব। এর কাছে জীবন হল জ্ঞানের অন্বেষণ, প্রকৃতির রহস্যময় শক্তিকে মানুষের ইচ্ছাধীন করে তোলা। ওর যুক্তি হল, এই সংগ্রামের জন্যে সমস্ত লোককেই সমানভাবে সুসজ্জিত করে তোলা দরকার, এবং এ সংগ্রামের পরিণতি বুদ্ধির মুক্তি ও জয়লাভের মধ্যে; যুক্তিই হল এ বিশ্বের একমাত্র সচেতন এবং সবচাইতে পরাক্রান্ত শক্তি। মেয়েটির কাছে জীবন হল অজানার কাছে এক যন্ত্রণার আত্মনিবেদন, মনের আত্মসমর্পণ এমন একটা ইচ্ছাশক্তির কাছে, একটা বিধি, একটা লক্ষ্যের কাছে যা শুধু যাজকদেরই জানা।

‘তাহলে কেন আপনি আমার বক্তৃতা শুনতে আসেন?’ অবাক হয়ে ও জিগ্যেস করলে, ‘সমাজতন্ত্র থেকে আপনার তাহলে কি লাভ?’

করুণভাবে মেয়েটি স্বীকার করল, ‘জানি, এটা আমার পক্ষে পাপ, আমার সবুদ্ধিকে অমান্য করা হচ্ছে তাতে। তবু এত ভালো লাগে আপনার কথা শুনতে, পৃথিবীর সমস্ত মানুষের জন্যে সুখসম্ভাবনার স্বপ্ন দেখতে!’

দেখতে যে খুব ভালো ছিল মেয়েটি তা নয়, একহারা চেহারা, বুদ্ধিমান মুখখানা, বড়ো বড়ো দুই চোখ, দৃষ্টি কখনো তুষ্ট কখনো রুষ্ট, কখনো কোমল কখনো কঠিন। সিল্কের এক কারখানায় মেয়েটি কাজ করত, বাড়িতে বুড়ি মা, পঙ্গু বাপ আর একটি ছোটো বোন। বোনটি পড়ে একটা কাজ শেখার ইস্কুলে। মাঝে মাঝে বেশ হাসিখুশি দেখাত মেয়েটিকে, তেমন একটা হৈহল্লা করা ফুর্তি নয়, কিন্তু সুন্দর হাসিখুশি। পুরনো পুরনো গির্জা আর যাদুঘরে যাবার সখ ছিল মেয়েটির। ছবি আর শিল্পকর্ম ভালোবাসত। এ সব দেখে মাঝে মাঝে সে বলত:

‘এই সব সুন্দর সুন্দর জিনিসগুলো লোকের ব্যক্তিগত কামরায় একদিন আটকা পড়েছিল, এ সব উপভোগ করার অধিকার থাকত শুধু একজনেরই! কি কাণ্ড! সৌন্দর্য হওয়া উচিত সকলের কাছেই উন্মুক্ত, তবেই তা সত্যি করে বেঁচে থাকে।’

মাঝে মাঝে মেয়েটি এমন অদ্ভুতভাবে কথা কইত যে ওর মনে হত, মেয়েটির বুকের কোন অবুঝ যন্ত্রণা থেকে বুঝি কথাগুলো বেরিয়ে আসছে, সে কথা শুনে ওর মনে হত যেন এক জখম লোকের গোঙানি। বুঝতে পারত, জীবন আর মানুষ সম্পর্কে মেয়েটির ভালোবাসা মায়ের মতো গভীর দরদে ভরা, সে ভালোবাসার যতো উদ্বেগ ততো অনুকম্পা। ধৈর্য ধরে লোকটি অপেক্ষা করতে লাগল, একদিন তার বিশ্বাস দিয়ে সে মেয়েটির বুকে আলিয়ে তুলতে পারবে এমন একটা স্ফুলিঙ্গ যাতে মেয়েটির কোমল ভালোবাসা উদ্দীপিত হয়ে উঠবে আবেগে। ওর মনে হল, মেয়েটি যেন আরো উৎসুক হয়ে তার কথা শুনতে শুরু করেছে, ভেতরে ভেতরে মেয়েটি বুঝি তার মত মেনে নিতে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই। আগের চেয়ে আরো আবেগ ঢেলে লোকটা মেয়েটিকে শোনাতে লাগল পুরনো শেকল ভেঙে মানুষের মুক্তির জন্যে অবিরাম সংগ্রাম কতো প্রয়োজন- ঘুণধরা এ শেকল মানুষের মনের মধ্যে কুড়ে কুড়ে খেয়ে সবকিছু বিষাক্ত করে তুলছে।

একদিন মেয়েটিকে বাড়ি পৌঁছে দেবার সময় ও বললে, মেয়েটিকে সে ভালোবাসে, তাকে বিয়ে করতে চায়। এর যা প্রতিক্রিয়া হল তাতে বিমূঢ় হয়ে গেল সে। মেয়েটি এমন ভাবে চমকে পিছিয়ে গেল যেন সে কি এক আঘাত পেয়েছে। বিস্ফারিত চোখে বিবর্ণ মুখে হাত দুখানা পেছনে রেখে মেয়েটি দাঁড়াল দেয়ালে ভর দিয়ে।

আতঙ্কিতের মতো কেমন একটা দৃষ্টি নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে বললে, ‘আমি জানতাম, আমি টের পাচ্ছিলাম, কেননা অনেকদিন ধরে আমিও তোমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছি। কিন্তু, হে ভগবান, কি করি এখন?’

আবেগে ও জবাব দিলে, ‘এসো, আমরা সুখী হই! তুমি আর আমি, একসঙ্গে কাজ করব আমরা!’

‘না’, মেয়েটি বললে মাথা নিচু করে, ‘না, না! আমাদের মধ্যে ভালোবাসার কোন কথাই চলতে পারে না।’

‘কেন?’

মৃদু কণ্ঠে জিগ্যেস করলে মেয়েটি, ‘গির্জায় গিয়ে বিয়ে করতে রাজী আছো?’

তাহলে বিধায়।’

ওর কাছ থেকে দ্রুত চলে গেল মেয়েটি।

ও এগিয়ে এসে সঙ্গ ধরে বোঝাবার চেষ্টা করলে। মেয়েটা নীরবে শুনন ওর সব কথা, তারপর বললে:

‘আমি, আমার না, বাবা- সকলেই আমরা ধর্মভীরু, ধর্ম নিয়েই আমরা মরতে চাই। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে গিয়ে বিয়ে-সে আমার দ্বারা হবে না। এ রকম বিয়ে থেকে যে ছেলেপুলে হবে তারা হতভাগ্য হবেই হবে। আমি জানি। গির্জায় গিয়ে বিয়ে করলে তবেই প্রেম শুদ্ধ হয়ে উঠবে, তবেই সুখ শান্তি সম্ভব।’

ও দেখলে যেয়োট সহজে মানবে না, কিন্তু এই প্রশ্নে সেও হার মানতে রাজী নয়। ফিরে এল ও। বিদায় নেবার আগে মেয়েটি বললে:

‘পরস্পরের যন্ত্রণা বাড়িয়ে আর লাভ নেই। আমার সঙ্গে আর দেখা কোরো না। তুমি যদি এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যেতে পারতে। আমার যে উপায় নেই, আমি বড়ো গরিব…’

ও বললে, ‘সে রকম কোনো কথা দিতে পারছি না।’

এমনি করেই এই দুটি দৃঢ়চেতা মানুষের মধ্যে লড়াই শুরু হল। দেখা সাক্ষাৎ ওদের অবশ্য হত, এবং আগের চেয়ে ঘন ঘনই। তা হত কারণ দুজনেই ওরা চাইত দেখা করি, দুজনেরই আশা ছিল অসফল প্রেমের যন্ত্রণা হয়ত অন্য জন আর বহন করতে পারবে না- এবং সে প্রেম আগের চেয়ে আরো তীব্রভাবে জ্বলতে শুরু করেছিল। কিন্তু দেখা করে শুধু যন্ত্রণা আর হতাশাই বেড়ে উঠত। প্রত্যেকবার সাক্ষাতের পর ছেলেটি আরো ভেঙে পড়ত আরো অসহায় বোধ করত, আর কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটি যেত গির্জায় স্বীকারোক্তি করতে। ছেলেটি তা জানত। ওর মনে হত, মুণ্ডিতমস্তক পুরোহিতেরা যেন এক কালো

দেয়ালের মতো উঁচু হয়ে উঠে ওদের দুজনকে চিরকালের যতো বিচ্ছিন্ন করে দিতে চাইছে। দিন দিন সে দেয়াল আরো উঁচু ভারো অনতিক্রমনীয় হয়ে উঠছে।

একদিন এক ছুটির দিনে ওরা যখন শহরতলীর একটা মার্চের ওপর একসঙ্গে বেড়াচ্ছিল, তখন ছেলেটি একবার বলেছিল:

‘মাঝে মাঝে মনে হয় তোমাকে আমি যেন খুন করে ফেলতেও লারি।’ ভয় দেখাবার জন্যে কথাটা ও বলেনি, যা ভাবছিল সেইটেই যেন বেরিয়ে এসেছিল ওর মুখ দিয়ে।

মেয়েটি উত্তর দেয়নি।

‘কি বললাম শুনেছো?’

ওর দিকে সস্নেহে তাকিয়ে মেয়েটি বলেছিল, ‘হ্যাঁ। শুনেছি।’ আর ওর বুঝতে বাকি রইল না, মেয়েটি মরবে তবু ওর কাছে হার মানবে না। এই ‘হ্যাঁ, শুনেছি’র আগে অবশ্য মাঝে মাঝে সে মেয়েটিকে আলিঙ্গন করেছে, চুনু খেয়েছে। একটু আধটু ঠেকাবার চেষ্টা করেছে মেয়েটা, কিন্তু প্রতিরোধ তার ক্ষীণ হয়ে আসতে শুরু করেছিল। ছেলেটির আশা হয়েছিল একদিন মেয়েটি হার মানবে তার কাছে, মেয়েটির নারীসুলভ প্রবৃত্তি জাগিয়ে তুলে সে তাকে জয় করতে পারবে। কিন্তু এই ঘটনার পর সে বুঝলে, সেটা জয় হবে না, হবে শৃঙ্খল। এরপর থেকে মেয়েটির মধ্যেকার নারীকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা সে আর করেনি।

এমনি করেই মেয়েটির সঙ্কীর্ণ জীবনবোধের অন্ধকার প্রান্তসীমায় ও ঘুরে বেড়াল মেয়েটির সঙ্গে। জ্ঞানের আলো দিয়ে এ অন্ধকারকে প্লাবিত করে দিতে চাইত সে। কিন্তু মেয়েটি তার কথা শুনে যেত যেন এক দৃষ্টিহীন জীব, মুখে স্বপ্নাতুর হাসি, কিন্তু বুকের গভীরে অবিশ্বাস। মেয়েটি একবার তাকে বলেছিল:

‘মাঝে বাঝে আমার বেশ মনে হয়, তুমি যা বলছো তা সত্যিই গম্ভব। কিন্তু তারপর ভাবি, তা মনে হচ্ছে কারণ আমি তোমায় ডালোবাসি। আমি বুঝি কিন্তু বিশ্বাস করি না, বিশ্বাস করা অসম্ভব আমার পক্ষে। তারপর তুমি যখন আমার কাছ থেকে চলে যাও, সঙ্গে সঙ্গে তোমার সবকিছুও চলে যায় আমাকে ছেড়ে।’

এমনি চলন দু’বছর, তারপর একদিন অসুখে পড়ল মেয়েটি। ছেলেটি তার কাজকর্ম সব জলাঞ্জলি দিলে, রাজনৈতিক সংগঠনের কাজ ছেড়ে ছুড়ে দেনা করতে থাকল এবং কমরেডদের এড়িয়ে মেয়েটির ঘরের দোর গোড়ায় কিংবা বিছানার পাশে বসে রুগ্ন মেয়েটিকে দেখে দেখে সময় কাটাতে লাগল মেয়েটি ক্ষয় পেতে শুরু করেছিল, আর রোগের আগুন বেড়ে উঠছিল দিনের পর দিন।

মেয়েটি অনুনয় করে বলত, ‘ভবিষ্যতের কথা আমায় বলো না গো।’

কিন্তু ও বলত শুধু বর্তমানের কথা, যা কিছু আমাদের ধ্বংস করে ফেলছে, যার বিরুদ্ধে যে চিরকাল লড়াই চালাবে, নোংরা ছেঁড়া ন্যাতাকানির মতো যে জিনিসগুলোকে ঝেটিয়ে দূর করতে হবে মানুষের জীবন থেকে, তার ফিরিস্তি দিয়ে চলত ও ক্ষেপার মতো।

মেয়েটি শুনত, তারপর ব্যথা অসহ্য হয়ে উঠলে ওকে থামাতো ওর হাতখানা ছুঁয়ে, ওর চোখের দিকে অনুনয়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে। ডাক্তার ওকে বলেছিল মেয়েটির রাজ যক্ষ্মা হয়েছে, বাঁচার আশা নেই। মেয়েটি একদিন ওকে জিগ্যেস করলে, ‘আমি কি মরতে চলেছি?’

ও মুখ ফিরিয়ে নিলে।

‘আমি জানি আমার দিন ঘনিয়ে এসেছে,’ মেয়েটি বললে, ‘তোমার হাতখানা একটু দেবে।’

ছেলেটি তার হাতখানা বাড়িয়ে দিলে। সে হাতে যেয়েটি তার তর ঠোঁট দুটি ঠেকিয়ে বলবে:

‘আমায় ক্ষমা কোরো, আমি তোমার কাছে অপরাধ করেছি। ভুল করে তোমাকে অত যন্ত্রণা দিয়েছি। এখন মরণ কালে জেনেছি, আমার নিজের ইচ্ছা আর তোমার চেষ্টা সত্ত্বেও আমি যেটা বুঝতে পারছিলাম না, আমার বিশ্বাস সেটা এক না-বোঝার আতঙ্ক ছাড়া আর কিছুই নয়। ওটা আতঙ্কই বটে, কিন্তু যে আতঙ্ক যে আমার রক্তে। এই আতঙ্ক নিয়েই আমি জন্মেছি। মনটা আমার নিজের, অথবা বুঝি সেটা তোমারই, কিন্তু হৃদয়টা যে আমার নিজের নর। আমি জানতাম তুমি ঠিক, কিন্তু আমার হৃদয় সে কথা মানত না।’

কয়েকদিন পরে মেয়েটি মারা গেল। মেয়েটির মৃত্যু যন্ত্রণা দেখতে দেখতে ছেলেটির চুল শাদা হয়ে যেতে লাগল-সাতাশ বছরেই চুল পেকে গেল তার।

অল্প কিছু দিন আগে ছেলেটি বিয়ে করেছে ওই মেয়েটিরই এক- মাত্র বান্ধবীকে, সেও তারই পাঠচক্রের ছাত্রী। ওরা এখন চলেছে কবরখানায়। প্রতি রবিবার ওরা ওখানে গিয়ে মেয়েটির কবরে ফুল দিয়ে আসে।

ছেলেটি বিশ্বাস করেনি সে জিতেছে। মেয়েটি যখন বলছিল, ‘তুমিই ঠিক’ তখন সে শুধু তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্যেই মিথ্যা করে বলেছিল- এই ওর দৃঢ় ধারণা। ওর স্ত্রীও তাই তাবে। ওদের দুজনের কাছেই মেয়েটির স্মৃতি পবিত্র। মেয়েটির জীবনের এই ট্রাজেডি থেকে ওরা প্রতিজ্ঞা নিয়েছে চমৎকার একটি মানুষের এই মৃত্যুর শোধ নেবে তারা, ওদের মিলিত প্রচেষ্টার পেছনে এ থেকে জেগে উঠেছে এক অপরিসীম কর্মদ্যোতনা আর দেখা দিয়েছে একটা আশ্চর্য সৌন্দর্য।

… রোদে ঝলমল এক নদীর মতো বয়ে চলেছে হাসিখুশি বর্ণবহুল জনস্রোত, সে স্রোতের সঙ্গে জেগে উঠছে ফুর্তির কোলাহল, যেতে যেতে চিৎকার করছে ছেলেরা, হাসছে। এ কথা সত্যি, সকলেরই মন খুশি এমন নয়। সন্দেহ নেই অনেকের বুক দুঃখে ভারাক্রান্ত অনেকের মন সন্দেহে, ক্ষতবিক্ষত। কিন্তু সকলেই আমরা যাত্রা করেছি মুক্তির দিকে, মুক্তির দিকে!

যতো ঘনিষ্ঠ হবে আমাদের একত্র পদক্ষেপ, ততোই দ্রুত’ হবে আমাদের অগ্রগমন!

 

ইতালির রূপকথা (শুভ-বিবাহ)

ইতালির রূপকথা (শুভ-বিবাহ)

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024