শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ০৯:০১ পূর্বাহ্ন

ইতালির রূপকথা (মা)

  • Update Time : রবিবার, ১৯ মে, ২০২৪, ৮.১৩ পিএম

মাক্সিম গোর্কি

এবো জয়ধুনি দিই নারীর নামে, মায়ের নামে, সর্বজয়ী জীবনের সেই অক্ষর উৎস-মুখের নামে।

এ হল সেই খোঁড়া বাষ পাষান-হৃদয় তৈমুর-ই-লেও-এর কাহিনী, সেই ভাগ্যবান দিগ্বিজয়ী সাধিব-ই-কিরানি’র কাহিনী, কাফেররা মাকে বলে তৈমুরলেও, সেই তার কাহিনী যে তামাম দুনিয়াকে খুংস করতে চেয়েছিল।

পঞ্চাশ বছর ধরে যে পদদলিত করে ফিরেছে পৃথিবীটাকে, হাতীর পায়ে গুঁড়িয়ে যাওয়া উইঢিবির মতো তার রথচক্রের তলায় গুঁড়ো হয়ে গেছে রাষ্ট্রের পর রাষ্ট্র, নগরের পর নগর। তার জয়যাত্রার পেছনে পেছনে রক্তের লাল নদী বয়ে গেছে দিগ্বিদিকে। পর্যুদস্ত এক একটা জাতের হাড় দিয়ে সে বানিয়ে ফিরেছে উঁচু উঁচু মিনার। জীবনকে ধ্বংস করে যে তার ক্ষমতার প্রতিযোগিতা চালিয়েছে যমের সঙ্গে, কেননা এই হল তার পুত্র জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর প্রতিশোধ। তয়ঙ্কর এই মানুষটার ইচ্ছা ছিল যমের যা প্রাপ্য সোঁটা সে কেড়ে নেবে নিজে, ক্ষুধায় আর হতাশায় যম যেন মরে শুকিয়ে। যেদিন তার ছেলে জাহাঙ্গীর মারা গেল, আর কালো আর ফ্যাকাশে নীল পোষাক, ছাই আর ধুলো মাখা মাথা সমরগন্দের লোকেদের সামনে এসে দাঁড়াল জাট-বিজেতা তৈমুর, সেই দিন থেকে শুরু করে অবশেষে ওত্রাভ-এ যখন সে হার মানল যমের কাছে- এই তিরিশ বছর তৈদুর হাসেনি। এই তিরিশ বছর দাঁতে দাঁত চেপে থেকেছে সে, উচু করে রেখেছে মাথা, বুক থেকে দূর করে দিয়েছে দয়ামায়া এই তিরিশ বছর।

এসো জয়খুনি দিই নারীর নামে, মায়ের নামে, সেই একমাত্র শক্তির নামে যার কাছে মৃত্যুর মাথাও নুয়ে আসে! এসো, আজ বলি সেই মায়ের কাহিনী, বলি কেমন করে সেই পাষান-হৃদয় যমদূত তৈমুরলেও, সেই রক্তাক্ত প্রতিহিংসা মাথা নত করেছিল তার কাছে।

ঘটনাটা বলি:

ভোজসভা বসেছে তৈমুর-বেগের। ভোজসভা বসেছে সেই কানিগুলার রমনীয় উপত্যকায় যেখানে গোলাপ আর গাঁদার মেঘে ছেয়ে গেছে সবকিছু, সমরখন্দের কবিরা যার নাম’ দিয়েছিল ‘গুল পেয়ার’, যেখান থেকে দেখা যায় সেই মস্তো শহরখানার নীল নীল মিনার, আর মসজিদের নীল নীল গম্বুজ।

উপত্যকা জুড়ে পাখার মতো পনেরো হাজার গোল গোল ছাউনি যেন পনেরো হাজার তুলিপ ফুল, প্রত্যেকটা ছাউনির ওপর বাতাসে উড়ছে রেশমী নিশান।

সব ছাউনির ঠিক মাঝখানে হল গুরুগান-তৈমুরের ছাউনি, যেন সখিদলের মাঝখানে রাণী। সে ছাউনির চারটে কোণার এক একটা দিক লম্বায় একশ পদক্ষেপ, তিন বল্লমের সমান উচু, মাঝখানটায় বারোটা সোনার খুঁটি- এক একটা খুঁটি এক একটা মানুষের মতো চওড়া। নাথার ওপরে ফিকে নীল রঙের গম্বুজ আর কালো, হলদে, নীল ডোরাকাটা রেশমী কাপড় দিয়ে পাশগুলো তৈরি। এ ছাউনি যাতে আকাশে উড়ে না যায় তার জন্যে লাল লাল পাঁচশ দড়ি দিয়ে মাটির সঙ্গে কষে বাঁধা। চার কোণে চার রূপোর ঈগল, আর গম্বুজের নিচে, ছাউনির ঠিক মাঝখানকার মণ্ডপের ওপর বসে আছে পঞ্চন জগল, খোদ শাহানশাহ্, অপরাজেয় তৈমুর-গুরুগান।

 

পরনে তার আকাশী রঙের মুক্তাখচিত ঢোলা রেশমী পোষাক, বড়ো বড়ো মুক্তোর সংখ্যাই পাঁচ হাজারের কম নয়। পাকা চুলে ভরা তার সেই ভয়ঙ্কর মাথার ওপর শ্বেত শীর্ষ উষ্ণীষ, তার চুড়োয় একটা লাল চুনী, এদিক ওদিক দুলে যেন একটা রক্ত চক্ষুর মতো নিরীক্ষণ করছে পৃথিবীটাকে।

চওড়া এক ফলা ছোরার মতো খোঁড়া তৈমুরের মুখখানা – হাজার হাজার বার রক্ত স্নানের ফলে তাতে যেন রক্তের মরচে ধরেছে। চোখ দুটো তার দুই তীক্ষ্ণ গর্তের মতো, কোনো কিছুই তার নজর ফসকায় না। সে চোখের ঝিকিমিকি যেন জারামুতের তুহীন ঝিকিমিকির মতো, আরবদের সেই প্রিয় মণির মতো, কাফেররা যার নাম দিয়েছে পান্না, আর যা দিয়ে মৃগী রোগীকেও ভালো করে দেওয়া যায়। কান থেকে তার যে নাকড়ি ঝুলছে তাতে সিংহলের চুনী বসানো-সে চুনীর রঙ একেবারে সুন্দরী মেয়ের ঠোঁটের মতো।

ছাউনির তলে মেঝের অপরূপ কার্পেটের ওপর সারি সারি সাজানো আছে তিনশ সোনার কলসী ভর্তি শরাব আর রাজকীয় ভোজের জন্যে যাকিছু দরকার সব। নহবত বসেছে তৈমুরের পেছনে, দু’পাশে কেউ নেই, আর পায়ের তলায় তার জ্ঞাতিকুটুম্ব, রাজা রাজন্য সর্দারদের দল। আর তৈমুরের সবচেয়ে কাছে বসেছে সেই কবি মাতাল কোরমানি-সেই কবি যাকে একদিন বিশ্ববিশ্বংসী তৈমুর জিগ্যেস করেছিল:

‘কোরমানি, আমাকে যদি বিক্রি করা হয়, তাহলে কত দাম ধরবে।’ মৃত্যু ও বিভীষিকার সেই পুরুষকে কোরমানি বলেছিল, ‘পঁচিশ সেপাই।’

অবাক হয়ে তৈমুর বলে উঠেছিল, ‘কিন্তু ওতো আমার কোমর- বন্ধটারই দান!’

কোরমানি বলেছিল, ‘আমি আপনার কোমরবন্ধটার কথাই ভাবছিলাম জাঁহাপনা, ওই জন্যেই পঁচিশ সেপাই, কেননা আপনার দাম একপয়সাও নয়।’

ভীম ভয়ঙ্কর সেই শাহানশাহ তৈমুরকে কবি কোরমানি বলেছিল এই কথা। জয় হোক কবির, তৈমুরলেঙের গৌরবের চেয়েও চিরকাল উঁচু হয়ে থাক এই সত্যসন্ধ কবির গৌরব!

এসো আমরা জয়ধুনি করি কবির, সেই সব কবির যাঁরা একটি ঈশ্বরকেই মানেন- যানেন শুধু নির্ভীক সুন্দর সত্যবাণীকে! সেই তাঁদের কাছ চিরন্তন ঈশ্বর।

তারপরে তো সেই যখন ভোজ আর উল্লাস চলেছে পুরো দমে, লড়াই আর দিগ্বিজয়ের গল্প চলেছে সাহঙ্কারে, তখন, যখন উঁচু সুরে তান ধরেছে নহবত আর শাহের ছাউনির সম্মুখে চলছে জনপ্রিয় ক্রীড়ানুষ্ঠান- ডোরাকাটা পোষাকের অসংখ্য বিদূষক যেখানে ডিগবাজি খেয়ে চলেছে, কুস্তি করছে পালোয়ানেরা, দড়ির ওপর এমন সব কসরৎ দেখানো হচ্ছে যে মনে হবে বুঝি লোকগুলোর শরীরে হাড় বলে কিছু নেই, হত্যা করার নিখুঁত নৈপুণ্যে তরোয়াল চালাচ্ছে যোদ্ধারা, খেলা হচ্ছে লাল-সবুজ রঙ করা হাতী দিয়ে – তার হণে কোনো হাতীকে দেখাচ্ছে ভয়ঙ্কর, হাসি দেখে- তৈমুরের লোকলস্করদের সেই ফুতির মুহূর্তে পাচ্ছে কোনোটাকে সেই সব লোকলস্কর যারা তৈমুর সম্পর্কে ভয়, তার গৌরবে অহঙ্কার, তার জয়লাভের হয়রানিতে মাতাল, মাতাল শরাবে আর কুমিতে- তখনকার সেই উন্মাদ মুহূর্তে সমস্ত কোলাহল ভেদ করে একটি নারী কন্ঠের চিৎকার, একটি নারী ঈগলের অহষ্কৃত চিৎকার এসে পৌঁছল সুলতান-বায়াজেত বিজেতার কর্ণকুহরে-যেন বজ্রগর্ভ মেষ কুঁড়ে এল এক বিদ্যুতের ঝলক। যে শব্দ তৈমুরের পরিচিত, তৈমুরের আহত আয়ার সঙ্গে সে শব্দের মিল আছে, তৈমুরের সেই আয়া যা মৃত্যুর হাতে আহত তাই জীবনের ওপর মানুষের ওপর যা নিষ্ঠুর লোকেদের হুকুম করলে তৈমুর, দ্যাখো, কে অমন নিরানন্দ গলায় চেঁচিয়ে উঠল। ওরা বললে, একটা মেয়েমানুষ জাঁহাপনা, ছিন্নবাসা ধূলিধূসর এক উন্মাদিনী, আরবী ভাষায় কথা কইছে, আর দাবি করছে, হ্যাঁ, দাবি করছে আপনার কাছে আসবে, আসবে দুনিয়ার তিন প্রান্তসীমার মালিকের কাছে।

শাহ বললে, ‘ওকে নিয়ে এসো।’

এসে দাঁড়াল মেয়েটা। খালি পা, ছেঁড়া কাপড় বিবর্ণ হয়ে গেছে রোদ্দুরে। কালো চুল নেমে এসে ঢেকে দিয়ে গেছে নগ্ন বুক। ব্রোঞ্জের মতো মুখের রঙ, উদ্ধত এক জোড়া চোখ। খোঁড়া তৈমুরের দিকে প্রসারিত তার কালো বাহু দুটো একবারও কাঁপল না।

জিগ্যেস করলে, ‘সুলতান-বায়াজেতকে যে পরাজিত করেছে, সেই কি তুমি?’

‘হ্যাঁ, আমি তাকে জয় করেছি, জয় করেছি আরো অনেককে, জয়লাভে, এখনো আমি ক্লান্ত নই। কিন্তু তোমার কি বক্তব্য আছে, নারী?’

মেয়েটা বললে, ‘শোনো তবে, যা কিছুই তুমি করো না কেন, তুমি একজন মানুষ ছাড়া আর কিছু নও, কিন্তু আমি না। তুমি সেবা করো মৃত্যুর, আমি সেবা করি জীবনের, আমার কাছে তুমি অপরাধী, তাই আমি এসেছি তোমার অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত নিতে। লোকে বলে তোমার মন্ত্র নাকি “ন্যায়েই শক্তি”। আমি সে কথা বিশ্বাস করি না, কিন্তু আমার কাছে তোমাকে ন্যায়পর হতেই হবে, কারণ আমি মা।’

এই কথার পেছনে যে জোর তা অনুভব করার মতো বুদ্ধি শাহের ছিল। বললে:

‘বসো, বলো কি বলবে, আমি শুনছি।’

আমীর ওমরাহদের ঘন মণ্ডলীর মধ্যে কার্পেটের ওপর বসে মেয়েটি তার কাহিনী শুরু করল:

‘আমি আসছি সালের্নো থেকে, ইতালীর এক সুদূর অঞ্চল সেটা- তুমি চিনবে না! আমার বাপ ছিল জেলে, আমার স্বামীও জেলে। সুখী মানুষেদের চেহারা যেমন সুন্দর হয়, তেমনি সুন্দর ছিল তার চেহারা, আর সে সুখ তাকে দিয়েছিলাম আমিই! একটি ছেলেও ছিল আমার, পৃথিবীর মধ্যে সেরা ছেলে সে…’

‘আমার জাহাঙ্গীরের মতো’, অস্ফুটস্বরে বললে সেই প্রাচীন যোদ্ধা। ‘আমার ছেলের মতো সুন্দর আর বুদ্ধিমান ছেলে আর কেউই নেই। ছ’বছর তখন তার বয়স, তখন আমাদের কূলে এসে হানা দিল সারাসান-বোম্বেটেরা। আমার বাপকে স্বামীকে আরো অনেককে খুন করলে তারা, আর লুট করে নিয়ে গেল আমার ছেলেটাকে। তারপর থেকে এই চার বছর আমি তার জন্যে দুনিয়া ঘুরে বেড়াচ্ছি। সে এখন আছে তোমার কাছে। এ আমি জানি, কেননা বায়াজেতের লোকেদের হাতে ধরা পড়েছিল বোম্বেটে দলটা, আর তুমি বায়াজেতকে হারিয়ে তার সব কিছু সম্পত্তি লুট করেছো। তুমি জানো আমার ছেলে কোথায় আছে, তাকে ফিরিয়ে দাও।’

সকলে হেসে উঠল। সুলতানের। সবসময়েই নিজেদের বিজ্ঞ বলে ভাবে। তারা বললে, ‘মেয়েটা পাগলী।’

পাগলী। বলে সুলতানেরা, আর তৈমুরের বন্ধুরা, আর আমীর ওমরাহ-সর্দারেরা হাসতে লাগল। শুধু গম্ভীরমুখে কোরমানি তাকিয়ে রইল মেয়েটার দিকে আর ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে রইল তৈমুর।

‘মেয়েটা পাগলী, যেমন পাগলী হয় মায়েরা’, আস্তে করে বললে মাতাল কবি কোরমানি, আর শাস্তির দুষমন শাহ বললে:

‘নারী। সেই অজানা দেশ থেকে তুমি নদী-সমুদ্র পর্বত পার হয়ে, বনজঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এলে কি করে? পশু আর মানুষের হাত থেকে কি করে রেহাই পেলে তুমি, কি করে রেহাই পেলে মানুষের হাত থেকে যারা সব চেয়ে বুনো জানোয়ারের চেয়েও ভয়ানক? অসহার মানুষের একমাত্র দোস্ত হল তার হাতিয়ার – যতদিন হাতিয়ার চালাবার ক্ষমতা থাকবে ততদিন সে কখনো বেইমানি করবে না। কিন্তু বিনা হাতিয়ারে তুমি কি করে এলে একা একা? তুমি যা বলছো, তা বিশ্বাস করতে হলে এ কথা আমার জানা দরকার, তোমাকে বোঝা দরকার যাতে বিস্ময় এসে আমার বুদ্ধিকে আচ্ছন্ন না করে।’

এসো আমরা জয়ধুনি দিই নারীর নামে, মায়ের নামে, সেই না, যার স্নেহের কাছে কোনো বাধা বাধা নয়, যার বুকের দুধে বেড়ে উঠেছে তামাম দুনিয়া! মানুষের মধ্যে যা কিছু সুন্দর, তা এসেছে শুধু সূর্যের আলো আর মায়ের দুধ থেকে। এই থেকেই জেগেছে আমাদের জীবনের প্রতি ভালোবাসা!

মেয়েটি জবাব দিলে:

‘শুধু একটি সদুত্ব পড়েছিল আমার পথে। যে সমুদ্রে অনেক বাগ, অনেক ছেলে দৌকো। আর লোকে যখন প্রিয়জনের জন্য বার হয়, তখন যাতাস থাকে সর্বদাই অনুকুল। আর সমুদ্রতটের ওপর যে জন্মিলোয়, বেড়ে উঠেছে, নদী সাঁতরে পার হওয়া তার কিছুই নর। আর পাহাড়-পর্বত? সে তো আমি নজরেই আনিনি।’

আর সহর্থে বলে উঠল মাতাল কোরমানি:

‘ভালোবাসার কাছে পর্বত যে তো উপত্যকা।

‘বদজঙ্গল ছিল সত্যি, বনগুয়োর, ভালুক, বনবিড়াল আর শিশু বাগানো ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর বুনোদোষের দেখা পেয়েছিলাম আমি। বাঘের চোখে পড়েছিলাম দুবার-তোমার মতো চোখে তাকিয়েছিল ওরা। কিন্তু প্রাণী মাত্রেরই হহৃদয় আছে। তোমার সঙ্গে যেমন করে কথ্য কইছি, তেমনি করে কথা কয়েছিলাম ওদের সঙ্গেও। যখন বললাম আমি মা, তখন ওরা আমাকে বিশ্বাস করে সরে গেল নিঃশ্বাস ফেলে, কেননা ওদেরও দয়া হয়েছিল। তুমি কি জানো না যে, পশুরাও তাদের সন্তানদের ভালোবাসে, সন্তানের স্বাধীনতা আর জীবনের জন্য কি করে লড়াই করতে হয় তা তারা মানুষের চেয়ে কম জানে না?’

তৈমুর বললে, ‘সাধু! সাধু, তোমায় নারী! আমিও জানি মানুষের চেয়েও মাঝে মাঝে পশুর ভালোবাসা হয় তীব্রতর, লড়াই করে দৃঢ়তর ভাবে।’

মেয়েটি বলতে লাগল ছেলেমানুষের মতো, কেননা প্রত্যেক মা-ই ভেতরে ভেতরে একশ গুণ শিশু। ‘মানুষেরা তার মায়ের কাছে সবসময়েই শিশু, কেননা প্রত্যেক মানুষেরই মা আছে, প্রত্যেক লোকই কোনো না কোনো মায়ের ছেলে, এমন কি তুমি, হে বৃদ্ধ, তুমি জানো, তুমিও নারীর পেটে জন্মেছো। ভগবানকেও অস্বীকার করতে পারো তুমি কিন্তু এ কথা অস্বীকার করার সাধ্যি নেই।’

‘সাধু! সাধু, তোমায় নারী।’ বলে উঠল সেই নির্ভীক কবি কোরমানি, ‘সাধু! যতো যাঁড়ই থাক, তা থেকে বাছুর হবে না, সূর্য ছাড়া ফুল ফুটবে না, ভালোবাসা ছাড়া সুখ হবে না, ভালোবাসা নেই নারী ছাড়া, আর মা নইলে না হবে কবি না বীর।’

মেয়েটা বললে:

‘ছেলে ফিরিয়ে দাও আমার, কেননা আমি তার না, তাকে ভালোবাসি।’

প্রণাম করি নারীকে, নারী থেকেই জন্য মোজেসের, মোহাম্মদের, সেই মহান যীশুর, কু-লোকের হাতে যিনি প্রাণ দিয়েছেন কিন্তু শরীফ-উদ্দিন বলেছে, আবার উঠে দাঁড়াবেন তিনি, বিচার করবেন জীবিত আর মৃত সকলের, আর তা ঘটবে এই দানস্কস-এ, এই দামস্কস-এ!

প্রণাম করি সেই তাকে যে অবিশ্রান্ত জন্ম দিয়ে চলেছে মহতের! তারই পুত্র অ্যারিস্টটুল, আর ফিদৌসী, আর মধু’র মতো মধুর সাদী, বিষ মেশানো শরাবের মতো ওমর খৈয়াম, ইসকেন্দার আর কাণা হোমার- সকলেই তারা তারই সন্তান। তারই দুধ খেয়ে তারা মানুষ, যখন তারা তুলিপ ফুলের মতো এই এতটুকু তখন তাদের সকলকে সেই হাতে ধরে এগিয়ে দিয়েছে পৃথিবীর পথে। দুনিয়ার যা কিছু সেরা তা এসেছে মায়েদের কাছ থেকে!

আর সেই শ্বেতকেশ পুরন্দর, সেই খোঁড়া বাঘ তৈমুর-গুরুগান চুপ করে বসে বসে কি ভাবলে। তারপর অনেকক্ষণ পরে তার আশেপাশের লোকেদের দিকে চেয়ে বললে:

‘মায় টেংড়ি কুলি তৈমুর! আমি আল্লার নোকর তৈমুর বলছি যা বলা উচিত। এমনি ভাবেই আমি চলেছি, বছরের পর বছর আমার পায়ের নিচে মাটি কেঁপেছে, আমার বুকের মধ্যে জীবনের সূর্যকে নিভিয়ে দিয়ে নারা গেছে আমার ছেলে জাহাঙ্গীর। তার প্রতিশোধ নেবার জন্যে তিরিশ বছর আমি দুনিয়া ধ্বংস করে ফিরছি। রাজ্য আর নগরের জন্যে লোকে আমার সঙ্গে লড়াই করতে এসেছে, কিন্তু কেউ আসেনি মানুষের জন্যে লড়াই করতে। আমার চোখে মানুষের কোনো দাম ছিল না। কে যে, কেন যে আমার পথ রোধ করতে এসেছে, এ আমি কখনো তাকিয়ে দেখিনি। আমি তৈমুর, বায়াজেতকে পরাজিত করে আমিই তাকে বলেছিলাম, “দ্যাখো বায়াজেত, আল্লার কাছে দেশ আর মানুষের কোনো দাম নেই। নইলে দ্যাখো না কেন, তাদের মনিব হয়ে বসেছি কিনা আমরা কাণা একটা লোক তুমি, আর খোঁড়া একটা লোক আমি!” এই কথাই আমি বলেছিলাম বায়াজেতকে যখন তাকে শেকলে বেঁধে নিয়ে আসা হয়েছিল আমার কাছে, শেকলের ভারে সে দাঁড়িয়ে থাকতে পর্যন্ত পারছিল না। তার দুর্দশার দিকে তাকিয়ে আমি বলেছিলাম এই কথা, আর জীবন তখন আমার কাছে পোড়ো জমির কাঁটাগাছের মতো তেতো।

‘আল্লার নোকর, আমি তৈমুর বলছি যা বলা উচিৎ! আমার সামনে বসে আছে অনেক নারীর মধ্যেকার একজন সাধারণ নারী, কিন্তু সে আমার বুকের মধ্যে এমন একটা অনুভূতি জাগিয়েছে যা আমি কখনো অনুভব করিনি। সমানে সমানে সে কথা বলেছে আমার সঙ্গে, ভিক্ষে চায়নি, দাবি জানিয়েছে। এখন আমি বুঝতে পেরেছি, কিসে এই মেয়েটির এত জোর- কারণ সে ভালোবাসে, ভালোবাসা তাকে শিখিয়েছে যে তার সন্তান হল জীবনের একটা স্ফুলিঙ্গ, শতাব্দীর পর শতাব্দী যা থেকে শিখা জ্বলতে থাকবে। সব নারীই কি একদিন শিশু ছিল না, সব বীরই একদিন অসহায়? জাহাঙ্গীর রে। নয়নের মণি আমার। হয়ত তোকে নিয়ে এ দুনিয়া উঠত কবোষ্ণ হয়ে, পৃথিবীকে ভবে তুলতিস হখ স্বাচ্ছন্দ্য দিয়ে, আর আমি তোর বাপ রক্তের বন্যায় যাটি ভাসিয়ে তাকে উর্বর করেছি।’

জাতির পর জাতির কাছে যে লোকটা বিভীষিকা, সে আবার ডুবে গেল নিস্তব্ধতার মধ্যে। তারপর বললে:

‘আমি আল্লার নোকর তৈমুর বলছি যা বলা উচিত। আমার রাজ্যের কোণে কোণে এই মুহূর্তে ছুটে যাক আমার তিনশ ঘোড়সওয়ার, এই নারীর সন্তানকে তারা খুঁজে নিয়ে আসুক, মেয়েটি এইখানে অপেক্ষা করে থাকবে, আর আমিও অপেক্ষা করে থাকব মেয়েটির সঙ্গে। ঘোড়ায় চাপিয়ে যে ছেলেটিকে নিয়ে ফিরবে, তার কপাল ফিরে যাবে- এই কথা বলছি আমি, তৈমুর! ঠিক বলেছি, নারী?’

মাথা ঝাঁকিয়ে মুখের ওপর থেকে কালো চুলের গোছ। সরিয়ে দিয়ে মেয়েটি হেসে বললে:

‘ন্যায় কথাই বলেছো, রাজা।’

তারপর উঠে দাঁড়াল সেই ভয়ঙ্কর বৃদ্ধ, নীরবে অভিবাদন করলে মেয়েটিকে, আর সোল্লাসে সেই ফুর্তিবাজ কবি কোরমানি শিশুর মতো গেয়ে উঠল:

ফুলের গান, তারার গান, এ থেকে ভালো কিবা? ভালোবাসার গান ভালো ভাই এ সব কিছুর চেয়ে। বৈশাখের রোদের চেয়েও মোহিনী কার রূপ? প্রেমিক বলে, যাহারে ভালোবেসেছি, সেই মেয়ে। নিশীথ রাতের তারার পাঁতি অতি অপরূপ তাহা বসন্তের দ্বিপ্রহরে সূর্য মনোলোভা। ফুলের চেয়েও রম্য তবু প্রিয়তমার আঁখি বসন্তের রোদের অধিক তার সে হাসির শোভা।

কিন্তু সবার সেরা যে গান যে গান আছে বাকি, হও কিছু এই দীন দুনিয়ায়, তার যে সূচনা, যায়ার ভরা হৃদয়ের গান, বিশ্বভুবনের বুকের যে গান, গান সেই তার, যাহারে ডাকি, না।

আর তৈমুর বললে তার কবিকে।

‘সাধু কোরমানি। আন্নার গুণগান করার জন্য তোমার ঠোঁট দুখানা পছন্দ করে আন্না ভুল করেনি।’

‘আন্না নিজেই যে এক মহান কবি।’ বললে মাতাল কোরমানি। আর হাসল মেয়েটি, হাসন রাজা রাজড়া আমীর সর্দারদের দল, শিশুর মতো হয়ে গেল তারা যখন তারা তাকালে মেয়েটির দিকে তাকালে মায়ের দিকে।

এর সব কিছু সত্যি, প্রত্যেকটি কথা সত্যি। আমাদের মায়েরা জানে যে কথা। জিগ্যেস করলে তারা বলবে:

‘এ সবই হল শাশ্বত সত্য। মৃত্যুর চেয়ে আমরা সবলা, চিরকাল পৃথিবীতে আমরা জন্ম দিয়ে এসেছি জ্ঞানীর, কবির, বীরের, পৃথিবী তরে আমরা বপন করে যাই তার গৌরব।’

 

 

ইতালির রূপকথা (কর্মী)

ইতালির রূপকথা (কর্মী)

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024