মাক্সিম গোর্কি
ঝিঁঝিঁ ডাকছে।
জলপাই গাছগুলোর ঘন পল্লবের সঙ্গে যেন হাজার হাজার তার টান করে বাঁধা। শক্ত পাতাগুলো নড়ছে বাতাসে, পাতাগুলোর ছোঁয়। লাগছে সেই তারগুলোয়, আর এই অবিরাম মৃদু স্পর্শে বাতাস ভরে উঠছে এক মাতিয়ে তোলা তপ্ত বাঙ্কারে। ঠিক সঙ্গীত নয় তা, তবু মনে হয় যেন অদৃশ্য হাতে কারা শত শত আশ্চর্য বীণায় সুর বাঁধছে, এ সুর বাঁধার পালা শেষ হয়ে সূর্য, আকাশ আর সমুদ্রের উদ্দেশ্যে এখুনি এক জয়জয়ন্তী স্তোত্র খুনিত হয়ে উঠবে তারযন্ত্রের বিপুল অর্কেস্ট্রায়- তার জন্যে তীব্র উৎকণ্ঠায় অপেক্ষ। করতে সাধ জাগে।
বাতাস বইছে, দুলিয়ে দিয়ে চলেছে গাছগুলোকে, মনে হয় গাছেদের মাথাগুলো যেন ঝাঁকুনি খেয়ে নুয়ে আসছে পাহাড় থেকে সমুদ্রে। শিলাতটের ওপর একঘেয়ে তালে তালে আছড়ে পড়ছে তবজভঙ্গ, সমুদ্র ভরে উঠেছে একাকার প্রাণচঞ্চল ফেনায়র-মনে হয় যেন দলে দলে গাথি এসে উড়ে বসেছে তার নীল বুকের ওপর। একদিক লক্ষ্য করে যে পাখিগুলো যেন ভেসে চলেছে, যেতে যেতে হঠাৎ তলিয়ে যাচ্ছে গভীরে, তারপর অস্ফুট কলরবে জেগে উঠছে আবার। আর যেন তাদের লোভানি দেখিয়ে এই তরঙ্গমালার পেছনে পেছনে বুসর দুটো পাখির মতো চক্রবালে ওঠানামা করে চলেছে তিন পাল্লা পাল তোলা দুটো নৌকো। বহুকাল আগের এক অর্ধবিস্মৃত স্বপ্নের মতো সমস্ত দৃশ্যটা কেমন অবাস্তব।
‘সূর্য ডোবার সময় জবর একখান ঝড় উঠবে।’ বলে এক বুড়ো জেলে, নুড়ি ভরা তটের ওপর এক শিলাখণ্ডের ছায়ার তলে বসে।
ঢেউয়ের তোড়ে গোছা গোছা বাদামী, হলুদ আর সবুজ রঙের সমুদ্রগুলুম ভেসে এসে পড়েছে তটের ওপর, জলন্ত সূর্যের রোদে গরম পাথর নড়িগুলোর মধ্যে শুকিয়ে উঠছে, লোনা বাতাস ভরে উঠেছে তাদের আইডিনের ঝাঁঝালো গন্ধে। তটের ওপর তরঙ্গের ছোটো ছোটো পাক ছুটে মরছে পরস্পরকে ধরার জন্যে।
বুড়োটার ছোটোখাটো শুকনো মুখ, শুকচক্ষু নাক আর চামড়ার কালো ভাঁজের তলে লুকনো গোল গোল কিন্তু নিঃসন্দেহে তীক্ষ্ণ চোখ দুটো- সব মিলিয়ে ওকে মনে হয় যেন একটা পাখি। লোকটার শুকনো গিঁট গিঁট আঙুলগুলো স্থির হয়ে আছে ওর হাঁটুর ওপর।
বুড়োটা কথা বলে, তরঙ্গের মর্মর আর ঝিঁঝির গুঞ্জনের সঙ্গে তার কণ্ঠস্বর বেশ মিলে যায়। বলে, ‘সে প্রায় পঞ্চাশ বছর হল সিনোর, মনে পড়ে সে দিনটাও ছিল এমনি ঝলমলে সুন্দর দিন, সবকিছুই যেন হাসছে, গাইছে, আমার বাপের বয়স তখন প্রায় চল্লিশ, আমি ষোলো বছরের প্রেমে পড়েছি, আমাদের মতো এই দক্ষিণের সূর্যের দেশে যোলো বছরের ছেলের পক্ষে ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক।
‘বাপ বললে, “চল গৃতিদো, চল কিছু পেৎসনি মাছ পাওয়া যায় কিনা দেখি।” পেৎসনি হল ভারি সুস্বাদু এক মাছ সিনোর, ফিকে লাল পাখনা, প্রবাল মাছও ওদের বলে, কেননা প্রবাল-পানার একেবারে গভীরে ওদের পাওয়া যায়। ধরতে হয় নৌকো নোঙর ফেলে ভারী টোপের বঁড়শি করে। ভারি সুন্দর দেখতে মাছগুলো।
‘তা আমরা তো চললাম, বেশ ভালো মতো মাছ মারা যাবে এই আশা। আমার বাপ ছিল বেশ শক্ত-সমর্থ জেলে, অভিজ্ঞতাও ছিল বেশ। কিন্তু এই বার মাছ ধরতে যাবার কিছু আগে অসুখে পড়েছিল, বুকে ব্যথা ধরেছিল, আঙুলগুলো বেঁকে গিয়েছিল বাতে ঐ এক-অসুখ। জেলেদের ‘এই যে এখন ডাঙ্গা হতে বাতাসটা বইছে বেশ গা জুড়িয়ে, সমুদ্রের দিকে আস্তে করে ঠেলে ঠেলে নিয়ে যেতে চাইছে এ কিন্তু ভারি খারাপ বাতাস সিনোর, ভারি বেইমান। পিছে হতে চুপি চুপি এসে তারপর হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়বে গায়ের ওপর যেন বাতাসের কিছু একটা ক্ষতি করেছি আমরা। নাও একেবারে উড়িয়ে লিয়ে যাবে বাতাসে, মাঝে মাঝে এমন হবে কি যে নাও উল্টে গেল আর আমি পড়ে রইলাম জলে। এমন ঝড়াক্-সে হয়ে যাবে ব্যাপারটা যে দুটো গাল পাড়বে কি ভগবানের নাম লিবে, তারও সময় পাওয়া যাবে না- একেবারে হোই দূরে গিয়ে ফেলবে তোমাকে উল্টো পাল্টা করে। এই হাওয়াটার চাইতে ডাকাতরাও অনেক সাঁচ্চা সিনোর, কিন্তু প্রকৃতির চাইতে মানুষ তো চিরকালই অনেক সাঁচ্চ।।
‘ডাঙ্গা হতে আমরা চার কিলোমিটার দূরে, মানে কাছেই আছি এমন সময় এমনি একখান বাতাস এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমাদের ওপর, একেবারে আচমকা, বেইমান শয়তানের মতো।
‘বাঁকাচোরা হাত দিয়ে দাঁড় চেপে ধরে বাপ চিৎকার করে বললে, “বৃত্তিদো। সামলে ভিদো। জলদি নোঙর তোল।”
‘আমি নোঙর তুলছি ইদিকে বাপের হাত হতে ছিটকে গের দাঁড়টা, আর বুকের ওপর এমন ধাক্কা মারলে দাঁড়টা যে অজ্ঞান হয়ে টলে পড়ল গিয়ে একেবারে নাওয়ের তলায়। বাপকে গিয়ে তুলব এমন সময়ও আমার নেই, কেননা তখন নাও এই ডোবে কি সেই ডোবে। এমন চক্ষের পলকে সব ঘটে গেল, যে দাঁড়খানা যখন আমি চেপে ধরলাম, ততক্ষণে আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যেতে লেগেছে, চারপাশ হতে এসে পড়তে লেগেছে জলের ছিটে, কেননা ঢেউয়ের মাথাগুলো কেবলি ভেঙে ভেঙে পড়ছিল বাতাসে, আর পুরুতে যেমন করে জল ছিটোয় তেমনি করে জল ছিটুনি পড়ছে আমাদের গায়ে, তার চেয়েও বেশি জোরে, শুধু সে জলে পাপ খণ্ডাবার কাজ হবার নয়।
‘জ্ঞান পেয়ে বাপ বললে, “সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার, রে বেটা!” তীরের দিকে তাকালে ও। বললে, “সহজে রেহাই দেবে নারে।”
‘কাঁচা বয়স হলে বিপদ বলে সহজে বিশ্বাস হতে চায় না। আমি জান কবুল দাঁড় বাইতে লাগলাম, বিপদ হলে মাঝির যা যা করা দরকার সব করতে লাগলাম আমি, কিন্তু ঝড় তো নয় পাজি শয়তানের নিঃশ্বাস- তোমার চার পাশে তারা তো তখন হাজারো কবর খুঁড়তে লেগেছে, বিনা পয়সায় শোনাতে লেগেছে ইষ্টনাম।
‘বাপ হেসে মাথা হতে জল ঝেড়ে ফেলে বললে, “চুপ মেরে বসে থাক গভিদো, দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে সমুদ্দুর খুঁচিয়ে লাভ কি? গায়ের শক্তি খরচ করিস না এখন, নইলে বাড়ি আর ফিরে যেতে হবে না।”
‘সবুজ সবুজ ঢেউয়ে আমাদের ক্ষুদে নাওখানাকে লিয়ে ছোড়াছুড়ি করতে লাগল যেন ছেলের হাতে বল। পাশ হতে এসে আমাদের মাথা ছাড়িয়ে উঁচু হতে লাগল ঢেউ, ডাক ছেড়ে ঝাঁকুনি দিতে লাগল পাগলার মতো। এই নামছি একেবারে খাদের নিচে, এই ঠেলে তুলছে একেবারে উঁচু উঁচু শাদা শাদা চুড়োর মাথায়। আর ক্রমেই দূরে সরে যেতে লাগল ডাঙ্গা, মনে হচ্ছিল যেন সে ডাঙ্গাও বুঝি নাচছে আমাদের নাওয়ের তালে তালে।
‘বাপ আমাকে বললে, “তুই হয়ত বেঁচে ফিরবি, কিন্তু আমি আর ফিরব না রে। মাছ ধরার জন্যে, কাজ বুঝে নেবার জন্যে যা বলছি শুনে রাখ এই বেলা…”
‘আর আমার বাপ তো বলতে লাগল তার যা বিদ্যে আছে সব- কোন মাছের কি ধরণ, কোথায় কখন কি করে তাদের ধরতে হয়।
‘আমাদের অবস্থাটা যে কি রকম কাহিল তা যখন বুঝলাম, তখন বাপকে বললাম, “এর চেয়ে ভগবানের নাম করাই এখন ভালো, না বাবা?” আমরা যেন তখন দুটি খরগোস, আর চার পাশে ঘিরে ধরেছে একপাল শাদা শাদা শিকারী কুকুর, ঘিরে ধরে দাঁত বার করছে।
‘বাপ বললে, “ভগবান সবই জানেন। তিনি তো দেখছেনই যে-মানুষগুলোকে ডাঙ্গায় বাস করার জন্যে বানিয়েছিলেন তারা এখন সমুদ্দুরের মধ্যে মরতে চলেছে, ওদের মধ্যে একজনের তো বাঁচার কোনো আশাই নাই, তাই তার যা কিছু জ্ঞান তা এখন ছেলেকে দিয়ে যাওয়া তার উচিত। কাজটা যে দরকার এ দুনিয়ার জন্যে, মানুষের জন্যে। ভগবান তা বোঝেন …”
‘মাছ ধরার সম্পর্কে যা কিছু বিদ্যে ছিল বাপের তা সব যখন বলা হয়ে গেল, তখন বলতে লাগল মানুষের সঙ্গে শান্তিতে বাস করার জন্যে কি কি করা দরকার।
‘আমি বললাম, “আমাকে শেখাবার এই কি সময়? ডাঙ্গায় থাকার সময় তুমি শেখাবার সময় পেলে না?”
“ডাঙ্গার যে কখনো এত কাছে মরণ টের পাইনি রে।”
‘বুনো জানোয়ারের মতো বাতাস গজরাচ্ছে, ঢেউয়ের আওয়াজ হচ্ছে এত জোরে যে বাপ কথা বলছে চিৎকার করে করে:
“মানুষের সঙ্গে ব্যবহার করবি এমন ভাবে যেন তোর চেয়ে ওরা কেউ খারাপ নয়, তোর চেয়ে ভালোও নয়- সেই হবে ন্যায্য কাজ। জমিদারই বলো আর জেলেই বলো, পুরোহিতই বলো আর সেপাই বলো- এ সবই হল একই দেহের নানা অঙ্গ। এই দেহের জন্যে ওদের যতো দরকার, তোমারও ততো দরকার। কখনো এই ভেবে লোকের কাছে যাবি না, যে ওর মধ্যে খারাপটা বেশি ভালোটা কম। ধরে নিবি ওর মধ্যে ভালোটাই বেশি, দেখবি আসলেও তাই। মানুষের কাছ থেকে যে রকম আশা করা হয়, মানুষ কাজও করে তেমনি।”
‘এই সব কথা সে যে এক লহমায় বলে গিয়েছিল তা অবিশ্যি নয়। ঢেউয়ের নাগর দোলায় তখন আমরা এই ডুবছি, এই উঠছি। তারই মধ্যে ফেনা আর জলের ছিটের মাঝে মাঝে শুনতে পাচ্ছিলাম কথাগুলো। অনেক কথা আমার কান পর্যন্তও পৌঁছয়নি বাতাসে ভেসে গিয়েছিল, অনেক কথা আমি বুঝিওনি, কেনে না মরণ সামনে রেখে কখনো বিদ্যে শিক্ষে করা যায়, সিনোর? ভয় ধরে গিয়েছিল আমার, সমুদ্দুরের এমন রাগ আমি কখনো দেখিনি, অমন অসহায় আর কখনো লাগেনি। তখন, নাকি পরে, নাকি যখন ঐ সময়টার কথা মনে মনে ভাবছিলাম কখন কে জানে, এমন একটা অনুভূতি আমায় পেয়ে বসেছিল, যে যতদিন বাঁচৰ সে কথা ভুলব না।
‘বাপের চেহারা আমার এখনো চোখে ভাসছে যেন ঘটনাটা ঘটেছে এই গতকাল, নাওয়ের নিচেতে বসে আছে বাবা, দু’হাত বাড়িয়ে ধরে আছে নাওয়ের দুই পাশ, ধরে আছে তার টাঁস ধরা বাঁকাচোরা আঙুলগুলো দিয়ে। মাথার টুপিখানা উড়ে গেছে, আর এই ডাইনে নেমে এই বাঁয়ে থেকে এই সামনে থেকে এই পেছন হতে বাপের ঘাড়ে আর মাখায় ঢেউ ভেঙে পড়ছে, আর প্রতিবার বাপ মাথা ঝাকিয়ে নাক খাড়া দিয়ে আবার চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলে চলেছে আমাকে। ভিজে একেবারে একশা হয়ে গেছল বাপ, মনে হচ্ছিল যেন দেহখানাও তার ছোটো হয়ে গিয়েছে, আর বড়ো বড়ো হয়ে উঠেছে চোখ ভয়ে, কিংবা হয়ত বা যন্ত্রণায়। যন্ত্রণাই হবে বোধ হয়।
‘চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বাপ বলে, “শোন। শুনতে পাচ্ছিস?”
‘মাঝে মাঝে আমিও জবাব দিই, “শুনতে পাছি।”
“মনে রাখিস, যা কিছু মঙ্গল তা আসে মানুষের কাছ থেকে।”
‘আমি বলি, “মনে রাখব।”
‘ডাঙ্গার ওপর কখনো বাপ এমন করে আমার সাথে কথা কয়নি। হাসিখুশি লোক ছিল বাপ, বুকে দয়ামায়া ছিল কিন্তু আমার সঙ্গে ব্যবহার করত যেন খানিক তামাসা করে। ভরসা করত না আমাকে, যেন আমি তার কাছে তখনও একটা বাচ্চা। মাঝে মাঝে এতে রাগ হত আমার, কেননা জোয়ান বয়েসে অল্পতেই রাগ হয়ে যায়।
‘বাপের এই চিৎকার শুনতে শুনতে কিন্তু আমার ডর কমে গিয়েছিল – হয়ত সেই জন্যে এই সবকিছু আমার এত স্পষ্ট করে মনে রয়ে গেছে।’
বুড়ো জেলে চুপ করে গেল, চোখ দুটো তার ফেনিল সমুদ্রের পানে চেয়ে। তারপর একটু হেসে চোখ মটকে বলে চলল:
‘এতগুলো বছর ধরে চের লোকজন আমি দেখেছি, সিনোর। আমি দেখেছি যেটা মনে রইল সেইটেই হল আসল বুঝ, আর যতো বুঝবে, ততই মঙ্গল চোখে পড়বে মানুষের মধ্যে – খাঁটি কথা বলছি, সিনোর!
‘তা আমার বাপের সেই স্নেহের ভিজে মুখখানা আমার এখনো চোখে ভাসছে, বড়ো বড়ো বিস্ফারিত চোখ দুটো দিয়ে আমার দিকে গম্ভীরভাবে সস্নেহে এমন করে তাকিয়ে আছে যে আমি বেশ বুঝতে পারছিলাম, মরতে আমাকে হবে না। ভয় লাগছিল আমার কিন্তু জানতাম বেঁচে যাবো।
‘আমাদের নাওখানা অবশ্য শেষ পর্যন্ত উল্টেই গিয়েছিল। ফুঁসে ওঠা জলের মধ্যে গিয়ে পড়লাম আমরা, ফেনায় কানা হয়ে যাবার যোগাড়, ঢেউয়ের তোড়ে আমাদের ছুঁড়ে ফেলছে এদিক ওদিক, বাক্কা খাছি নাওয়ের গলুইয়ের সঙ্গে। বাঁধার মতো যা পেলাম তাই দিয়ে তো নৌকার কানার সঙ্গে বেঁধে শক্ত করে, দড়ি ধরে রাখলাম হাতে। যতক্ষণ ও দড়ি ধরার শক্তি থাকছে ততক্ষণ নাও থেকে বেশি দূরে আমাদের নিয়ে ফেলতে পারবে না। কিন্তু জলের ওপর মাথা ভাসিয়ে রাখাই হল মুশকিল। বাপ আর আমি এক একবার গিয়ে ধাক্কা খেলাম নৌকার পেটের সঙ্গে, এক একবার আবার ভাসিয়ে নিয়ে গেল আমাদের। সব চাইতে মুশকিল হল এই যে মাথা বোঁবোঁ করতে লাগল, চোখে দেখা যায় না, কানে শোনা যায় না, জল ঢুকছে কানে, গাদা গাদা জল গিলছি কেবল।
‘এমনি চলল অনেকক্ষণ প্রায় ঘণ্টা সাতেক, হঠাৎ ঝড়ের টান ঘুরে গেল, ঘুরে গিয়ে তোড়ে বইতে লাগল তীরের দিকে, আর ডাঙ্গার পানে জোরে ভেসে যেতে লাগলাম আমরা।
খুশিতে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি, “চেপে ধরে থাকো!” বাপও চিৎকার করে কি যেন বললে, কিন্তু আমার কানে এল শুধু একটা শব্দ।
…… পাথরগুলো!”
‘বাপ ভাবছিল তীরের পাথরগুলোর কথা। কিন্তু সে সব তখনে। অনেক দূরে আমি ওর কথায় কান দিলাম না। কিন্তু আমার চেয়ে বাপের জ্ঞান ছিল বেশি, পাহাড়-প্রমাণ জলের মধ্যে দিয়ে আমরা ভেসে চলেছি, গা হাত পা অসাড় অসহায়, শামুকের মতো আঁকড়ে ধরতে চাইছি নৌকার খোলখান। আর বেদম ধাক্কা যাচ্ছি তার সঙ্গে। এমনি করেই চলল অনেকক্ষণ। কিন্তু শেষ কালে তীরের কালো কালো বালিয়াড়ি চোখে পড়ল। এর পর সব কিছুই ঘটে গেল যেন মুহূর্তে। দুলতে দুলতে সেই তট যেন জলের ওপর ঝুঁকে পড়ে তেড়ে আসতে লাগল আমাদের দিকে, আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বার জন্যে। এক বার, দুই বার ফেনিল তরঙ্গে আমাদের দেহগুলোকে আছড়ে ফেললে, আমাদের নাওখানা থেকে যেন বুটের তলায় বাদাম ভাঙার মতো শব্দ উঠল মড়মড়, দড়ি হাতছাড়া হয়ে আমি দেখলাম ছুরির ফলার মতো পাথরগুলোর কালো কালো ভাঙা পাঁজরা, দেখলাম আমার অনেক উঁচুতে বাপের মাথাখানা, ওই শয়তানের থাবাগুলোর ওপরে কে যেন তাকে ছুড়ে দিয়েছে। এক ঘণ্টা কি দু’ঘণ্টা বাদে বাপকে লোকেরা তুলে নিয়ে গিয়েছিল, তখন তার পিঠের শিরদাঁড়া ভেঙে গেছে, চূর্ণ হয়ে গিয়েছে মাথার খুলি। মাথাটা তার এমন হাঁ হয়ে গিয়েছিল যে জলের তোড়ে কিছুটা ঘিলু আগেই ধুয়ে গিয়েছিল। আমার এখনো মনে আছে, জখমের মধ্যে ছাই ছাই রঙের ঘিলুগুলোর মধ্যে লাল লাল শিরাগুলোকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন ফেনা কিংবা শেত পাথরের সঙ্গে রক্ত মিশেছে। লাসটা তার ভয়ানক দলামোচড়া হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু মুখখানা ছিল বেশ শান্ত ছিমছাম, চোখ দুটো সবখানি দোঁজা।
‘আমি? হ্যাঁ, আমিও ভয়ানক থেঁতলানি খেয়েছিলাম। লোকে যখন আমাকে ভাঙ্গায় টেনে তুলল তখন আমার জ্ঞান নেই। আমালফি ছাড়িয়ে ডের দূর আমরা ভেসে গিয়েছিলাম, আমাদের ঘর থেকে অনেকটা পথ। কিন্তু ওখানকার লোকেরাও অবিশ্যি জেলে, এরকম ঘটনায় ওদের অবাক লাগে না। এতে বরং ওরা শান্ত আর সদত হয়ে ওঠে। যারা বিপদ নিয়ে ঘর করে তারা চিরকালই খুব সদয়।
‘বাপের সঙ্গে সেই যে আমার শেষ কথাবার্তা, তা থেকে আমার যে কি রকম লাগছিল, তা হয়ত আমি ঠিক বোঝাতে পারলাম না- একান্ন বছর ধরে মনের মধ্যে আমি সেই অনুভূতিটা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছি। সে জিনিসটা বোঝাতে হলে আলাদা এক রকমের ভাষা দরকার, দরকার বোধ হয় গানের। কিন্তু আমরা জেলেরা হলাম ঠিক মাছের মতোই সরল, যে রকম ভালো করে কথা কইবার ইচ্ছা আমাদের, তা পারি না। যেটুকু মুখে বলে বোঝাতে পারি তার চেয়ে অনেক বেশি আমরা জানি, অনেক বেশি আমরা টের পাই।
‘বড়ো কথাটা হল এই, আমার বাপ তখন মরণের সামনে দাঁড়িয়ে, জানছে যে তার নিস্তার নেই, তবু ভয় পেলে না, আমার কথা তার ছেলের কথা ভুললে না যে; আমার যা জানা দরকার। বলে তার মনে হয়েছিল সব কিছু আমাকে জানিয়ে যাবার মতো সময় আর জোর তার তা সত্ত্বেও ছিল। সাতঘটি বছর আমার বয়স, আমি বলতে পারি, সে সময় বাপ বা যা বলেছিল, তার সব কথা সত্যি।’
যে টুপিটার রঙ এককালে লাল ছিল কিন্তু এখন বাদামী হয়ে গেছে হাতে বোনা সেই টুপিটা মাথা থেকে খুলে নিলে বুড়োটা, পাইপ নামালে, তারপর ব্রোঞ্জ রঙের নগ্ন মাথাটাকে নুইয়ে বললে জোর দিয়ে:
‘এর সব কথা সত্যি, সিনোর। মানুষকে যে রূপে দেখতে চাইবেন, তারা ঠিক তাই। তাদের দিকে যদি দয়ামায়া নিয়ে তাকান, তাহলে তাদেরও মঙ্গল আপনারও মঙ্গল। তারাও ভালো হবে উঠবে আপনিও ভালো হয়ে উঠবেন! সোজা কথা, নাকি বলেন, সিনোর?’
ক্রমেই বেগ বেড়ে উঠছিল বাতাসের, উঁচু আর তীক্ষ্ণ আর শাদা হয়ে উঠছিল ঢেউগুলো। তরঙ্গের ঝাঁকটা যেন ছুটে চলেছে দূরে আরে। দূরে। তিনপাল্লা পাল তোলা নৌকা দুটো চক্রবালের নীল রেখার পিছনে অদৃশ্য হয়ে গেছে কখন।
দ্বীপখানার খাড়া তটভূমি শাদা হয়ে উঠেছে ফেনায়, আন্দোলিত হয়ে উঠছে সমুদ্রের নীলাভ কালো জল, আর অক্লান্ত বেজে চলেছে ঝিঁঝিঁর আবেগমুখর কোলাহল।
Leave a Reply