লুইজি তার মুখখানাকে রাগে নীল করে চেঁচাল, ‘আমার বউ সম্পর্কে ঐ ঘাঁড়টা কি বলেছিল তা ফের বলুক তো দেখি।’
চিরোত্তা সরে পড়তে চাইছিল, ছোটো ছোটো চোখ দুটো তার একাটা তাচ্ছিল্যের মুখভঙ্গিতে ঢাকা, কালো মতো গোল মাথাটাকে নাড়তে নাড়তে সে সেই অপমানকর কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করতে ‘আপত্তি করলে। সুতরাং মেতাই চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বললে:
দর্শকেরা গুনগুন করে উঠল, ‘তাই নাকি? উঁহু, এ তো ভারি গুরুতর কথা, তামাসা নয়। অস্থির হয়ো না লুইজি, তুমি এখানে বিরেন এলাকার লোক বটো, কিন্তু তোমার বউ তো এখানকারই মেয়ে, ওকে ওর ছেলেবেলা থেকে আমরা জানি। তোমার বউ যদি একটা অন্যায় কাজ করে থাকে তো তার পাপটা আমাদের সকলের ওপরেই পড়ছে। ন্যায্য বিচার করতে হবে আমাদের।’
চিরোত্তা বেশ সত্যভব্য মানুষ, স্বামী হিসেবে ভালো, ছেলের বাপ। ব্যাপারটা বিদঘুটে। লোকে চুপ করে গেল বিব্রতভাবে। লুইজি বাড়ি গিয়ে তার বউ কনচেত্তাকে বললে:
‘ওই বদমাইসটা যা বলছে তা মিথ্যে এ কথা প্রমাণ করতে না পারলে তোমার সঙ্গে এই আমার শেষ, আমি চললাম।’
বৌ অবিশ্যি কাঁদলে, কিন্তু কান্না দিয়ে তো আর কিছু প্রমাণ হয় না। লুইজি তাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ত্যাগ করলে,
ছেলে কোলে মেয়েটা পড়ল একা, না রইল টাকাকডি, না খাবার মতো রুটি।
তখন মেয়েরা এল মধ্যস্থতা করতে। সবার আগে এল শব্জীউলী কাতারিনা, শেয়ালের মতো মাগীটা বৃর্ত, দেখায় যেন একটা হাড়ে মাংসে বোঝাই পুরনো বস্তা, এখানে ওখানে মোচড় খাওয়া।
কাতারিনা বললে, ‘সিনোরি, তোমরা বাপু শুনেছো তো, এই ব্যাপারটায় আমাদের সকলের সম্মানেই কালি পড়ছে। চাঁদিনী রাতে এই একটু মজা পাওয়া গেল তেমন ব্যাপার তো নয়। দু’দুটি মায়ের ভাগ্য খুলছে এর ওপর। ঠিক কিনা? আমি কনচেত্তাকে নিয়ে চললাম আমার বাড়িতে, সত্যি কথাটা কি বার না করা পর্যন্ত ও আমার কাছে থাকবে।’
তাই ব্যবস্থা হল। এর কিছু পরে কাতারিনা আর তিন মাইল দূর থেকেও যার গলা শোনা যায় সেই বুড়ি ডাইনী লুচিয়া দুজনে গিয়ে লাগল বেচারা জ্যুসেপ্পের পেছনে। জ্যুসেপ্পেকে ডেকে এনে, লোকে যেমন করে ছেঁড়া কাপড় নেড়ে নেড়ে দেখে তেমনি করে ওরা আঙুল দিয়ে নেড়ে নেড়ে দেখতে লাগল ওর আয়াটাকে।
‘বলো বাছা, কতোবার তুমি কনচেত্তাকে বুকে নিয়েছো?’ মুটকো জ্যুসেপ্পে গাল ফুলিয়ে কি ভাবলে, তারপর বললে,’একবার।’
‘এই কথা বলার জন্যে এত ভাবনা।’ স্বগতোক্তির মতো মন্তব্য করলে লুচিয়া।
একেবারে কোথাকার কে এক ম্যাজিসেট্রটের মতো জেরা করে চলল কাতারিনা, ‘কখন ঘটেছিল ঘটনাটা, সন্ধেবেলা, নাকি রাত্রে, নাকি সকালে?’
ইতস্তত না করেই এবার জ্যুসেপ্পে জানালো সন্ধেবেলা। ‘আলো ছিল তখনো?’
সবল মানুষটা ।’
‘বটে। তাহলে ওর গতরটা তুমি চেয়ে চেয়ে দেখেছো, নিশ্চয়?’ ‘দেখেছিই তো।’
‘বেশ, তাহলে ওর শরীরটা কি রকম, আমাদের বলো।’
জ্যুসেনের খেয়াল হল হঠাৎ এমন প্রশ্ন কোথায় ওকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। মুখখানা সে হাঁ করলে এমন ভাবে যেন এক দানা ঘব আটকে গেছে একটা চড়ুইয়ের গলায়। অস্ফুটভাবে কি বলার চেষ্টা করতে গিয়ে হঠাৎ এমন রেগে গেল যে তার প্রকাণ্ড কান দুটো লাল হয়ে উঠল টকটকে।
‘কি বলাবার মতলব আমাকে দিয়ে?’ গজরিয়ে উঠল জ্যুসেপ্পে, ‘আমি কি আর তাকে ডাক্তারের মতো পরীক্ষা করেছি নাকি?’
‘ও হো। তুমি তাহলে দেখছি ফলটা কেমন না দেখেই খেতে শুরু করো।’ বললে লুচিয়া। তারপর দুষ্টুমির একটা চোখ মটকানি দিয়ে ওকে খোঁচাতে লাগল, ‘কিন্তু কনচেত্তার একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য তোমার নজরে পড়েছিল, নিশ্চয়?’
জ্যুসেপ্পে বললে, ‘এত তাড়াতাড়ি ব্যাপারটা ঘটেছিল যে ভগবানের দিব্যি কিছুই আমার নজরে পড়েনি।’
‘তার মানে তুমি ওকে পাওনি, প্রমাণ হয়ে যাচ্ছে!’ চিৎকার করে উঠল কাতারিনা। ভালোমানুষ গোছের লোক, বুড়ি কাতারিনা, কিন্তু দরকার পড়লে কড়া হতেও সে পারত। মোট কথা, লোকটাকে ওরা এমন উল্টো-পাল্টা গেরোর মধ্যে ফেললে, যে শেষ পর্যন্ত সে তার নির্বোধ মাথাটা নিচু করে কবুল করলে:
‘কিছুই হয়নি, রাগের বশে আমি বানিয়ে বানিয়ে বলেছিলাম।’ বুড়ি দুজন একটুও অবাক হল না।
বললে, ‘আমরা জানতাম।’ তারপর লোকটাকে বাড়ি পাঠিয়ে সমস্ত ব্যাপারটা এবার তুলে দিলে পুরুষদের হাতে।
পরের দিন আমাদের মেহনতী মানুষগুলোর সমিতি বসল। চিরোত্তাকে আসামী করে অভিযোগ আনা হল, সে একজন পরস্ত্রীর মানহানি করেছে। বুড়ো কামার জিয়াকোমো ফাসকা ভারি সুন্দর একখান বক্তৃতা দিলো ‘নাগরিকবুল, কমরেডগণ ও ভাই সব! যদি আমরা চাই যে আমাদের সঙ্গে লোকে ন্যায় আচরণ করুক, তাহলে পরস্পরের প্রতি আমাদের ন্যায় আচরণ করতে হবে। সকলেই জানুক, যে আমরা যা দাবি করি তা আমরা নিজেরাও মানি, ন্যায় কথাটা আমাদের মনিবদের কাছে যেমন ফাঁকা কথা, আমাদের কাছে তা নয়। এই একটি লোক, একটি নারীর মানহানি করেছে, একজন কমরেডকে অপমান করেছে, একটি পরিবারে ভাঙন ধরিয়েছে, আর একটি পরিবারকে কষ্টের মধ্যে ফেলেছে, নিজের বৌকে ঠেলে দিয়েছে লজ্জা আর ঈর্ষার মধ্যে। লোকটার সম্পর্কে আমাদের কঠোর হতে হবে। কি করা যায় ওকে?’
সাতষট্টি জন লোক এক কণ্ঠে বললে, ‘ওকে একঘরে করা হোক।’
কিন্তু পনেরো জন বললে, সেটা খুবই গুরুতর শাস্তি হয়ে যাচ্ছে। তর্ক বাধল। গলা ফাটিয়ে চেঁচাল সবাই, কেননা, যাই হোক না কেন, সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে একটা মানুষের সম্পর্কে, এবং শুধু একটা মানুষ নয়, কেননা, যাই হোক না কেন, লোকটা যে বিবাহিত, ছেলেপুলে আছে তিনটি- তার বৌ আর ছেলেপুলের কি অপরাধ? লোকটার বাড়ি আছে একখানা, আছে একখানা আঙুর-বাগিচা, এক জোড়া ঘোড়া, বিদেশীদের ভাড়া দেবার জন্যে চারটে গাধা- এ সবই ও রোজগার করেছে নিজের মেহনতে, মেহনত করেছে লোকাটা খুব। বেচারা দু্যুসেলে বসে রইল কোণের দিকে চেয়ারের ওপর উঁচু হয়ে, মুখখানা তার শয়তানের মতো কালো, মাথাটা নোয়ানো। দুই হাতে দলামোচড়া করে চলেছে টুপিখানা। টুপির ফিতেটা তার ইতিমধ্যেই ছেঁড়া হয়ে গিয়েছিল, এবার লেগে পড়েছে টুপির কানাটা নিয়ে; আঙুলগুলো তার নাচছে যেন বাজনদারের আঙুলের মতো। তারপর যখন ওকে জিগ্যেস করা হল, তার কিছু বক্তব্য আছে কি না, অতি কষ্টে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে সে বললে:
‘আমি দয়াভিক্ষে করছি! কেউই আমরা নিষ্পাপ নই। এ জমি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া আমাকে উচিত নয়, এ জনিতে তিরিশ বছরেরও বেশি আমার বাস, এ জনিতেই আমার পিতৃপুরুষেরা মেহনত করে গিয়েছে।’
মেয়েরাও নির্বাসনের পক্ষে ছিল না। শেষ পর্যন্ত ফাস্কা পরামর্শ দিলে: ‘আমার মনে হয়, লুইজির বৌ আর ছেলেকে খাওয়াবার ভার দেওয়া হোক ওর ওপর, তাতেই যথেষ্ট শাস্তি হবে। লুইজি যা রোজগার করত তার অর্ধেকটা ও দিক লুইজির বৌকে।’
আরো এক পশলা তর্ক হল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই পন্থাই সাব্যস্ত হল, জ্যুসেঙ্গে চিরোত্তাও বুঝলে, যে অরে পার পেয়ে গেছে। বস্তুত পক্ষে খুশি হয়ে গেল সকলেই, আদালতে না গিয়ে আর দাঙ্গা না করেই নিজেরাই ব্যাপারটা মিটিয়ে নিতে পারা গেছে যা হোক। না সিনোর, আমাদের ব্যাপার-স্যাপার খবরের কাগজের ভাষায় লেখা হোক এ আমরা চাই না, সেখানে আমরা বুঝব এমন কথা বুড়ো মানুষের দাঁতের মতোই বিরল। আমরা চাই না যে আমাদের অপরিচিত জজ সায়েবরা যাঁরা আমাদের জীবন সম্পর্কে কিছুই প্রায় বোঝেন না, তাঁরা এসে আমাদের সম্পর্কে এমন ভাবে কথা কইবেন যেন আমরা হলাম এক দল বুনো অসত্য, আর তাঁরা হলেন একেবারে ভগবানের দেবপুত-মদ, বাছ, মেয়ে কখনো ও যেও দেখেননি। निता সহজ লোক সিনোর, জীবনকেও দেখি সহজভাবে।
হতবাং সিদ্ধান্ত হল। জ্যুসেরে চিবোত্তা লুইজির নৌ আর ছেলের কনো খোরপোষ দিয়ে যাবে। কিন্তু ব্যাপারটা ওখানেই নিটল না। লুইজি যখন জানন যে চিরোয়া নিছে কথা বলেছিল, এবং তার সিনোয়ার কোনো দোষ নেই, এবং যখন তাকে আমাদের রারটা শোনানো হল, সে তার বৌকে চিঠি লিখলে তার কাছে চলে আসতে। লিখবে চলে এসো আমার কাছে, আমরা আবার সুখে স্বচ্ছন্দে বাস করি। ঐ লোকটার কাছ থেকে একটা পয়সাও তুমি নেবে না। যদি কিছু নিয়ে থাকো, তা ওর মুখের ওপর ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এসো। আমারও দোষ নেই। ও লোকটা যে প্রেমের মতো একটা ব্যাপারে মিছে কথা বলবে তা কে জানতো?’
চিরোত্তার কাছে সে আর একটা চিঠি লিখলে:
‘আরো তিনটে ভাই আছে আমার, চার ভাই মিলে আমরা প্রতিজ্ঞা করেছি, তুমি যদি তোমার চর ছেড়ে সরেন্টো কি কাস্টেল্লামারে কি তোরে কি অন্য কোথাও আসো, তাহলে ভেড়া জবাই করার যতো তোমাকে জবাই করে ছাড়ব। যেই দেখব তুমি তোমার গাঁ ছেড়েছো, সঙ্গে সঙ্গে তোমাকে খুন করব কিন্তু, মনে থাকে যেন। তোমার সমাজের লোকগুলো যেমন খাঁটি লোক, এই কথাটাও আমার তেমনি সত্যি কথা। তোমার সাহায্য আমার সিনোরার দরকার নেই, আমার শুয়োর পর্যন্ত তোমার রুটি ছোঁবে না। যা আছো আছো, কিন্তু আমি যতদিন না ‘হাঁ’ বলছি তত দিন চর ছেড়ে কোথাও যেতে চেয়ো না।’
লোকে বলে, চিরোত্তা সেই চিঠিখানা নিয়ে গিয়েছিল ম্যাজি- স্ট্রেটের কাছে, জিগ্যেস করেছিল তার জান নেবে বলে ভয় দেখাচ্ছে এই অপরাধে লুইজিকে জেলে পাঠানো যায় কিনা? জজ নাকি বলেছিল:
‘হ্যাঁ, ওকে জেলে আমরা পাঠাতে পারি, কিন্তু তা করলে ওর ভাইরা নিশ্চয় তোমাকে খুন করে বসবে। এখানে এসেই তোমাকে খুন করবে। আমার পরামর্শ চাও তো অপেক্ষা করে দেখো। সেই বরং ভালো। রাগ তো আর প্রেমের মতো নয়, বেশি দিন রাগ বাঁচে না…’
জজ এ কথা বলতেও পারে: লোকটা সহৃদয় গোছের ভালোমানুষ, বেশ ভালো ভালো কবিতাও লেখে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না, চিরোত্তা ঐ চিঠি নিয়ে তার কাছে গিয়েছিল। না, চিরোত্তার ভেতরটা সত্যি সত্যি খুব ভালো, ফের একটা অবিবেচনার কাজ সে করবে বলে মনে হয় না। কেননা ওর কমরেডরা টের পেলে যে ওকে ঠাট্টা করে জ্বালিয়ে মারবে।
আমরা সাধাসিধে মেহনতী লোক সিনোর, আমাদের নিজেদের মতোই আমরা থাকি, আমাদের নিজেদের মতোই আমাদের ধ্যান ধারণা। যেমন খুশি যা আমরা ভালো বুঝি তেমনি বাঁচার অধিকার তো আমাদের আছে।
আমরা সমাজতন্ত্রী, আরে দোস্ত, মজুর মাত্রেই যে জন্ম থেকে সমাজতন্ত্রী। বই আমাদের অবিশ্যি পড়া নেই, কিন্তু সত্যি জিনিসটা ধরার মতো নাক আমাদের আছে-কেননা যা সত্যি তা থেকে মেহনতী মানুষের ঘামের গন্ধ যে আসবেই।
Leave a Reply